‘গোয়ায় কিন্তু সানগ্লাস পরা ছেলেদের থেকে সাবধান।’ ফ্লাইট থেকে নেমে মোবাইল খুলতেই অভির মেসেজ। আমার বন্ধু অভি ছোটোবেলায় ঠাকুমার সঙ্গে গোয়া গিয়েছিল। বিকিনি পরিহিতা সুন্দরীদের দেখে তার চোখ তো ছানাবড়া। ঠাকুমা বললেন, ‘কী দেখছস্?’ পরদিন থেকে সানগ্লাস চোখে অভির সুন্দরী দর্শন। ঠাকুমা টেরও পেতেন না। মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে দেখি আমার দুই বান্ধবীর চোখে রোদচশমা। নিজের চোখ সানগ্লাস-এ ঢেকে অভিকে উত্তর দিলাম, ‘সানগ্লাস পরা মেয়েদের থেকেও সাবধান।’ এবার গরমটা টের পাচ্ছি। ৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। গোয়ায় সারাবছর এরকমই গরম থাকে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি একটু ঠান্ডা। বন্ধুরা বলেছিল, গোয়া, শীত আর বর্ষায় সবথেকে মনোরম। কিন্তু সবার সবরকম উপদেশ উপেক্ষা করে আমরা তিন কন্যা এসেছি Travel Diary অক্টোবরের শেষে।
ডাবোলিন এয়ারপোর্ট ছোটো, কিন্তু সুন্দর। ভারতবর্ষের ক্ষুদ্রতম রাজ্যের মাঝামাঝি জায়গায়। প্রিপেড ট্যাক্সি ড্রাইভারকে আমাদের গন্তব্যস্থল ক্যালানগুটে বলতেই, তিনি জানালেন দেড় ঘণ্টা লাগবে। গরম, খিদে সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা, আরও দেড় ঘণ্টা! মাঝে একটা রেস্তোরাঁ থেকে গোয়ান বিরিয়ানি (আসলে মাংস-ভাত) প্যাক করে নিলাম, গাড়িতে খেতে খেতে চললাম ক্যালানগুটে। সুন্দর মসৃণ রাস্তা, দুপাশে পাহাড় আর সবুজ। পার হলাম মাণ্ডবী নদী। দুপাশে কখনও ধান খেত, কখনও সারি সারি নারকেল গাছ। কখনওবা মাঠের মাঝে ছোট্ট একটা গির্জা। সাইন বোর্ড-এ লেখা ক্যালানগুটে রোড, ব্যস্ত রাস্তা, অনেক গাড়ি আর মানুষের ভিড়।
একটা বিরাট পর্তুগিজ স্ট্রাকচার-এর বাংলোর সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল। দরজায় দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, ডা. রাউল বারবারা আর ডা. মিসেস প্রিসিলা বারবারা। এঁরা দুজনেই ডাক্তার। একদিকে নিশ্চিন্ত, অচেনা জায়গায় বাড়িতে দুজন ডাক্তারও আছেন। আছে এখানে অনেককিছুই। ক্যালানগুটে উত্তর গোয়ার ব্যস্ততম জায়গা। প্রচুর দোকানপাট, খাওয়ার জায়গা, আর বিচ পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। এই বিরাট বাংলো সংলগ্ন বেশ কয়েকটা কটেজ, যার একটা আগামী পাঁচ দিন আমাদের। গোয়ায় এরকম অনেক বাড়িই গেস্টহাউস হিসাবে ভাড়া দেওয়া হয়। এছাড়া ছোটো-বড়ো হোটেল তো আছেই। গোয়ানদের সঙ্গে থাকব অথচ বড়ো হোটেলের সবরকম সুবিধা থাকবে, এই ভেবেই বারবারার গেস্টহাউস-এ থাকার সিদ্ধান্ত। একটা বড়ো ঘর, তাতে সবরকম আধুনিক ব্যবস্থা আর সুন্দর অ্যাটাচড বাথ। বাড়তি পাওনা ছোট্ট বারান্দা আর সামনের বাগান।
ঠিক করেছিলাম দিনটা বিশ্রাম নেব। কিন্তু স্নান সারতেই তিনজনের উৎসাহ বেড়ে গেল। এক ফোনে বাজারে হাজির আমাদের দুধসাদা ইন্ডিকা। কাল সকাল থেকে এটিকে নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হবে। গোয়ায় এরকম সেল্ফ ড্রিভেন কার ভাড়া পাওয়া যায়। পাওয়া যায় সাইকেল, বাইক, স্কুটি-ও। গোয়ায় গাড়ি চালানো খুব সহজ। ক্যালানগুটে বা ওল্ড গোয়া-র দু-একটা জায়গায় যা একটু ভিড়, বাকি রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। ট্রাফিক পুলিশ চোখেই পড়ে না, আর ট্রাফিক লাইটের কোনও ব্যবস্থাই নেই। তবু সবাই ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালায়।
সুবিধা হবে ভেবে কিনে ফেললাম একটা ম্যাপ। আগামী চারদিনের মোটামুটি একটা প্ল্যান করে সোজা ইনফ্রানটারিয়া। গোয়া আসার আগে বন্ধুরা যে ‘মাস্ট ভিজিট’-এর লিস্ট দিয়েছিল, তার মোটামুটি গোড়ার দিকে রয়েছে পাব, রেস্তোরাঁ, বেকারি। ইনফ্রানটারিয়ায় ঢুকতেই নাকে কেক-এর গন্ধ, কানে এলভিস-এর সুর। বাকি সন্ধেটা লাইভ মিউজিক, ওয়াইন অ্যান্ড ডাইন।
দ্বিতীয় দিনে ঘুম ভেঙে বারান্দায় এসে বুঝলাম বেশ ঠান্ডা লাগছে। তাহলে কি গোয়ায় শীত পড়ে গেল? হালকা একটা চাদর গায়ে বারান্দায় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে তিনজনের আড্ডা। ক্যালানগুটে তখন অন্য মেজাজে। শান্ত, নিস্তব্ধ। তৈরি হয়ে ইনফ্রানটারিয়ায় অনবদ্য চিকেন আর ফ্রুট জুস খেয়ে ‘জয় মা’ বলে গাড়িতে উঠলাম। রঞ্জনা চালকের আসনে, আমি খালাসির। হাতের ম্যাপ, রাস্তার অ্যারো আর স্থানীয় মানুষ ভরসা। আমরা শুধু কয়েকটা জায়গার নাম জানি। উত্তেজনায় খেয়াল ছিল না গাড়িতে তেল ভরতে হবে। এদিকে রাস্তায় পেট্রোল পাম্প খুবই কম। যাও বা পাম্প পাওয়া গেল, পেট্রোল পাওয়া গেল না। তবে উপায় আছে। রাস্তার ধারে জলের বোতলে পেট্রোল বিক্রি হয়। তাই কিনলাম ৫ লিটার।
রাস্তা খুঁজে খুঁজে পৌঁছোলাম মরজিম বিচ-এ। নিষ্পাপ কিশোরীর মতো এর সৌন্দর্য। গুটিকয়েক মানুষ, একটি মাত্র দোকান, ব্যস। চারিদিকে জল আর বালিয়াড়ি। মন না চাইলেও এগোতে হল। পরের বিচ ম্যালড্রেম-এ বুড়ি ছুঁয়েই আরামবোল। এই আরামবোলেই আছে পরশুরামের মন্দির। আরামবোলে পৌঁছে চোখ ধাঁধিয়ে গেল, সমুদ্রের এমন সৌন্দর্য আগে কখনও দেখিনি। কেন প্রতি বছর এক থেকে দেড় লাখ মানুষ গোয়ায় বেড়াতে আসেন এবার বুঝতে পারছি। তাপমাত্রা সেই ৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। কিন্তু সেটা আর টের পাওয়া যাচ্ছে না। আরামবোলের সমুদ্রের ধারে বেশ কয়েকটি স্যাক। সমুদ্রস্নানে কয়েকজন বিদেশি পর্যটক, কয়েকজন হ্যামকে বসে বই পড়ছেন বা গল্প করছেন। ছুটি বোধহয় এভাবেই উপভোগ করতে হয়। জুস হাতে আমরাও বসে পড়লাম একটা স্যাক-এ, নাম লাফিং বুদ্ধ। সামনের সমুদ্র চোখ ঝলসে দেয়। এখানে নাকি সুইট ওয়াটার সি আছে। যা দেখতে, চড়াই উতরাই পেরিয়ে, দোকানপাটের মধ্যে দিয়ে পৌঁছোতে লাগল পাক্বা ১৫ মিনিট। এখানে ঝরনার জল এসে মিশেছে সমুদ্রে। বড়ো কালো পাথর মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে সমুদ্রের বুক থেকে। নদী-পাহাড়-সমুদ্র সব একাকার। সঙ্গে মিশেছে ডুবন্ত সূর্যের লাল আভা। কখন যে লাঞ্চ টাইম পেরিয়ে গেছে খেয়ালও হয়নি। সমুদের ধারের স্যাকে বসে খেলাম গোয়ান ফিশ কারি আর রাইস। এবার ফেরা। ফিরতে লাগল ৪৫ মিনিট। একটু ফ্রেশ হয়ে বাগা বিচ। একদিকে সমুদ্রের গর্জন, অন্যদিকে গিটারের মূর্ছনা। রাত ১২টা-তেও প্রচুর মানুষের ভিড়, কিন্তু কোলাহল নেই। রাত্রে সমুদ্রের এক অন্যরূপ, চাঁদের আলো যেন রুপোর গয়না পরিয়ে দিয়েছে। আজ পূর্ণিমা, তাও আবার কোজাগরি।
তৃতীয় দিনে ঘুম থেকে উঠেই পাড়ার বিচ কালানগুটে-এ চলে এলাম। সকাল ছটাতেই কত মানুষ! বাংলা শব্দ কানে আসছে অহরহ। সমুদ্রে নেমে পড়েছেন অনেকেই, অনেকে স্নান সেরে উঠে আসছেন সমুদ্র থেকে। ক্যালানগুটে একটু ব্যস্ত বিচ। সমুদ্র খুবই সুন্দর কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে বিচ নোংরা করে ফেলছেন ভ্রমণার্থীরা। এখানে খাবারদাবার বেশ সস্তায় পাওয়া যায়। পাওয়া যায় জিনিসপত্র, তবে দরদাম করতে হবে গড়িয়াহাটের মতো। আজ ব্রেকফাস্ট রাস্তার ধারের ছোট্ট এক সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁতে। উপমা আর ক্ষিরা খেয়ে ওল্ড গোয়ায় পাড়ি।
পথে অ্যাকুয়াডা ফোর্ট। বিরাট এই ফোর্ট ১৬১২ সালে তৈরি। নিরাপত্তার কারণে জল দিয়ে ঘেরা ছিল বলে অ্যাকুয়াডা। অ্যাকুয়া মানে জল। জল এখন নেই কিন্তু পরিখা আছে, আর আছে মানুষের কৌতূহল আর ছবি তোলার উৎসাহ। ‘দিল চাহতা হ্যায়’-এর শুটিং হয়েছিল! অ্যাকুয়াডা ফোর্ট থেকে রাজধানী পাঞ্জিম হয়ে ওল্ড গোয়া। ওল্ড গোয়া ঢুকতেই পুরোনো সব ছোটো ছোটো বাড়ি। একেবারে ছবির মতো, ছোট্ট বারান্দা, আর টালির চাল। প্রসঙ্গত বলি, গোয়ার প্রায় সব বাড়িরই টালির চাল।
আমাদের যাবতীয় কৌতূহল সেন্ট ফ্রানসিস চার্চ ঘিরে গড়ে উঠেছিল। সেখানে নাকি সেন্ট ফ্রানসিস নামে এক ধর্ম প্রচারকের মৃতদেহ ৪৫০ বছর ধরে সংরক্ষণ করা আছে। গিয়ে জানলাম সেই চার্চ এখন সংগ্রহশালা আর উলটোদিকের একটা পুরোনো ব্যাসিলিকায় (যা চার্চ-এর উপরে) রাখা আছে সেন্ট ফ্রানসিস-এর দেহ। বেশ গা ছমছম করে উঠল ভিতরে ঢুকতে গিয়ে। সেন্ট ফ্রানসিস রয়েছেন বেশ একটা উঁচু জায়গায়, কফিনের মধ্যে। আশ্চর্যজনকভাবে এখনও তাঁর শরীরের বেশ কিছু অংশ অবিকৃত রয়েছে।
কাছেই গোয়ার সব থেকে পুরোনো চার্চ ‘আওয়ার লেডি অফ দি রোসালি’। কেউ বিশেষ যায় না পোড়ো বাড়ির মতো দেখতে বাগান ঘেরা এই চার্চটিতে। সাহস করে গিয়ে জানলাম সেন্ট ফ্রানসিস-এর জন্মের আগে ১৫০৫-এ এটি তৈরি হয়েছিল। এই পুরো জায়গাটাতেই বিশেষ একটা থমথমে পরিবেশ। ভূতুড়ে জায়গা থেকে বেরিয়ে এবার মিরামার। মিরামার-এ বিচ কম, পার্ক বেশি। আমরা সমুদ্রের কাছে না গিয়ে উলটো দিকের কফি শপ-এ বসলাম। ততক্ষণে রোদে, গরমে ভাজা ভাজা অবস্থা। আর হাতে অনেক সময়, পরের গন্তব্যে যাওয়ার আগে। তাই কফি আর স্যান্ডউইচ সহযোগে মিরামারের সমুদ্র উপভোগ।
এরপর যাব ‘ডোনা পাওলা’। গোয়াতে এলে এখানে আসা নাকি মাস্ট, আর যেতে হয় সূর্যাস্তের সময়। আমরা ৪টে-তেই হাজির। গিয়ে দেখি কাতারে কাতারে মানুষ। কোনওমতে গাড়ির একটা ব্যবস্থা করে, প্রচুর মানুষের ভিড় ঠেলে অনেকটা হেঁটে যেখানে পৌঁছোলাম, সেখানে ভিড় আরও বেড়ে গেছে। মাথা গলিয়ে বুঝলাম দক্ষিণি ছবির শুটিং চলছে। বিচিত্র জায়গা এই ডোনা পাওলা, একটা ভিউ পয়েন্ট যেখান থেকে আরবসাগর আর মাণ্ডবীর মোহনা দেখা যায়। নানারকম মানুষ। মূলত বাঙালি আর কেরলবাসীর ভিড়। ছেলেরা অনেকেই গোয়ার বিখ্যাত ফুলছাপ শার্ট আর টুপি পরে ঘুরছেন আর অনেক মেয়েই প্রথমবার সাহস করে পরে ফেলেছেন পিঠ খোলা, পা খোলা জামা। খোলা পিঠে শোভা পাচ্ছে প্রজাপতি বা কাঁকড়ার ট্যাটু। এক কোণে বসে এক বিদেশিনি তার বন্ধুদের চুলে নানান কায়দায় বেণি করে দিচ্ছেন। সেখান থেকে নাকে আসছে দেশি মাদকের গন্ধ। এটির টানেও অনেকেই গোয়ায় আসেন।
পরদিন খুব সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম দক্ষিণ গোয়া দেখতে। উত্তর থেকে দক্ষিণ অনেকটা পথ। তাই আজ আমাদের সফরসঙ্গী নারায়ণ। নারায়ণ নামটা শুনে অবাক হওয়ায় সে জানাল গোয়ায় ৬৫ শতাংশ হিন্দু, ৩৫ শতাংশ ক্রিশ্চান আর বাকি অন্য ধর্মের মানুষ। নারায়ণ গড়গড় করে ইংরেজি বলে, গোয়ার আর সব বাসিন্দাদের মতো। এরা সবাই ৩-৪ টে ভাষা অনর্গল বলতে পারে। হিন্দি, ইংরেজি, কন্নর, মারাঠি, আর স্থানীয় ভাষা কোঙ্কণ। পাঞ্জিম পেরিয়ে দক্ষিণ গোয়া যাওয়ার পথে গোয়া ইউনিভার্সিটি। নারায়ণ জানাল এখানকার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ শিক্ষিত।
যত দক্ষিণের দিকে যাচ্ছি গরম ক্রমশ কমছে। পাহাড় আর সবুজে ঘেরা রাস্তা, উত্তরের থেকেও সুন্দর আর শান্ত। ভ্রমণার্থীর সংখ্যাও অনেক কম। বেশিরভাগই ভিনদেশি। কয়েকটা বিচ-এ যাব ঠিক করেছিলাম। এমনিতেই গোয়ায় ৩৫টা বিচ। একটা সফরে সবকটা দেখা সম্ভব নয়। প্রথমে ‘মাজোরজা’। একটা বাঁধানো ঘাট দিয়ে সমুদ্রে নামতে হয়। সাদা বালির সমুদ্রতট, কিছু নাম না জানা কাঁটা ঝোপ আর ফুল। একপাশে একটা পুকুরের মতো ব্যাক ওয়াটার। বালিতে ছোটাছুটি করে ব্যাক ওয়াটার-এ পা ধুয়ে গাড়িতে উঠলাম।
এবার যাচ্ছি নামকরা এক বিচ ‘কোলভা’-তে। কোলভায় সবসময় ভিড় থাকে। শুটিং-ও হয় অহরহ। মূল আকর্ষণ সাদা বা রুপোলি বালি আর ওয়াটার স্পোর্টস। বোটিং, স্কুটার ড্রাইভিং, প্যারাগ্লাইডিং-এ মেতে আছেন অনেকে। বাকিরা সমুদ্র স্নানে। আমি বেছে নিলাম ওয়াটার স্কুটার। এসব দেখতে দেখতে ভিউ পয়েন্ট-এর আসল ভিউ-এর কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। সুতপাদির ডাকে সিঁড়ি ভেঙে টাওয়ার-এ উঠে দাঁড়াতেই কয়েক সেকেন্ডে আকাশের রং বদলে গেল। তিনদিকে জল, নদী, সমুদ্র এখানে একাকার। আর পশ্চিমের আকাশে লাল, গোলাপি, বেগুনি রঙের খেলা। অন্ধকার নামতেই ভিড় কমে গেল।
আমরা রিভার ক্রুজ-এর টিকিটের খবর নিতে শুরু করলাম। ডোনা পাওলার ২-৩ টে দোকান থেকে পাওয়া যায় ১ ঘণ্টা জল সফরের টিকিট। দাম ১৫০ টাকা। সন্ধেবেলায় পাঞ্জিম থেকে জাহাজে উঠতে হয়। কিন্তু টিকিট ৫টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। আমাদের জাহাজের নাম ডায়োসেমা। ডেকের উপর চেয়ার পাতা। আনন্দ দেওয়ার জন্য একজন ঘোষক, ডিস্কো জার্নি আর ডান্স ট্রুপ। ৩টে ট্র্যাডিশনল আর বাকিটা ডিজে-র বাজানো গানের তালে বাচ্চা, বুড়ো সকলের উদ্দাম নাচ। সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ এবং ক্যামেরাবন্দি করার উৎসাহ দেখার এবং উপভোগ করার মতো দৃশ্য। তারই ফাঁকে আমরা ডেকের একপাশে বসে দেখলাম চাঁদের আলোয় মাণ্ডবীর মায়াবী রূপ। কাছে-দূরে জলের সরল আলোর খেলা। গান শেষ, পয়সা উশুল। ক্লান্ত সলমন, প্রিয়ংকা, শাম্মি কপূরের দল। আমরাও সারাদিনের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে ক্যালানগুটে-র পথে।
এবার পালোলেম। চোখ জুড়োনো সৌন্দর্য, দূরে সবুজে ঘেরা পাহাড়, সমুদ্রের ধার ঘেঁষে নারকেল গাছের সারি, কয়েকটা স্যাক আর রিসর্ট। শান্ত সমুদ্র, শান্ত সমুদ্রতট। এখানে সারাদিন শুধু বিশ্রাম নিতে হয়। পালোলেম রিসর্ট-এর লাগোয়া রেস্টুরেন্টে যেখানে বসলাম, সেখান থেকে সমুদ্র ১০ হাত দূরে। ছুটে ছুটে একবার একটু সমুদ্রের সঙ্গে খেলা আর ফিরে এসে কখনও জুস, কখনও সুপ, কখনও ডাবের জল। এই চলল সারাটা দিন।
দুপুরে ইটালিয়ান লাঞ্চ বেকড স্প্যাগেটি খেতে খেতে মনে পড়ল, আরে আজ তো বুধবার। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে গাড়ি ছোটানোর নির্দেশ নারায়ণকে। সূর্যাস্তের আগে পৌঁছোতেই হবে আঞ্জুনা। ফ্লি মার্কেট আসলে বিশাল একটা মেলা। গোয়ার সবরকম হস্তশিল্পের ছোটো-বড়ো দোকানিরা, সেদিন ওখানে পসরা সাজিয়ে বসেন। দক্ষিণ থেকে উত্তরের দেড় ঘণ্টার পথ নারায়ণ পার করল এক ঘণ্টায়। পৌঁছে দেখি দোকানপাট গোছাতে ব্যস্ত দোকানিরা। এতে অবশ্য সুবিধাও হল। বেশি দামদর না করে অনেক কিছু কিনে ফেলতে পারলাম। ঝড়ের গতিতে কেনাকাটা করলাম। প্রতিযোগিতা সূর্যের সঙ্গে। দিনের আলো ফুরোলেই টাইম আপ। মা-কে দেওয়া কথা ভুলে গিয়ে প্রচুর জাংক আর ঝোলা ব্যাগ কিনে ক্লান্ত, বিধবস্ত তিনজনের মুখে জয়ের হাসি ফুটল।
চতুর্থ দিনে সকাল থেকে বৃষ্টি, হাতে আর একটা দিন। কত প্ল্যান ছিল, সব বোধহয় মাটি। তবু বিষণ্ণ মুখে চলে গেলাম ক্যালানগুটে বিচে। সমুদ্রতটে সতর্কতা জারি হয়েছে। সমুদ্র যে বেশ রেগে আছে বোঝাই যায়। বিশাল সব ঢেউ, কালো আকাশ আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি মন খারাপ করিয়ে দিল। সমুদ্রের ধারের রেস্তোরাঁয় ব্রেকফাস্ট করতে করতে হঠাৎই মনে হল গোয়ার বর্ষাও তাহলে ভাগ্যে ছিল! ভিজতে ভিজতে কটেজে ফিরতে এবার কিন্তু মন্দ লাগল না।
রাস্তা আজ যেন বেশিই ফাঁকা। তৈরি হয়ে বেরিয়ে প্রথমেই আঞ্জুনা। ‘দম মারো দম’ সিনেমা খ্যাত এই বিচ কাল অন্ধকারে ভালো করে দেখা হয়নি। পাথুরে বিচ, সমুদ্রে না নেমে বসে উপভোগ করাই ভালো। তার উপরে এখনও বৃষ্টি পড়ছে। এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ কিছু মহিলাচালিত দোকানপাট রয়েছে। কেরলের এই মহিলাদের ইংরেজি উচ্চারণ আর শব্দচয়ন অবাক করে দেয়। কেনাকাটার পর প্রাণটা একটু কফি-কফি করছিল। কফির সঙ্গে কুকিজ আর আপেল পাই। আহা, যেন অমৃত। গোয়ায় স্থানীয় বেকারির কোনও জবাব নেই। বিশেষত আঞ্জুনায় আর বাগাতোর-এ।
বাগাতোর আঞ্জুনার পাশের বিচ। এসব অঞ্চলে বিদেশিদের ভিড়-ই বেশি। হাতে সময় আছে, তাই এখন চললাম চাপোড়া বিচ। অনেক পুরোনো ফোর্ট, পোর্তুগিজরা তৈরি করেছিল, এখন ধবংসস্তূপ। লাল ল্যাটেরাইটের পাহাড়ের মাথায় চাপোড়া, বেশ খাড়াই, উঠব কি উঠব না ভাবছি, দেখলাম এক ফটোগ্রাফার তার ভারী ক্যামেরা নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে নীচে নামছেন। প্রশ্ন করার আগেই উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘কষ্ট হবে, কিন্তু যদি পারেন দেখে আসুন’।
শর্টস, টি শার্ট আর স্লিপার এই পরে ট্রেকিং? কে জানত সমুদ্রের ধারে পাহাড়ে চড়তে হবে? সাবধানে, দম নিতে নিতে উঠলাম চাপোড়ায়। সত্যিই ধবংসস্তূপ। একটু নিরাশ হলাম। এত কষ্ট করে এসে…। একটু এগোতেই বুঝলাম চাপোড়া দাঁড়িয়ে আছে বাগাতোর আর আঞ্জুনার মাঝে। সূর্য দিনের মতো ছুটি নেবার আগে, চাপোড়া থেকে দুই সমুদ্রতটের টপ ভিউ, মন ভালো করে দিল। সূর্যাস্তের আগে নীচে নামতে হবে। একা দুর্গে তখনও কোল্ড ড্রিংক্সের বাক্স নিয়ে বসে আছে বছর কুড়ি-র এক যুবক। কিন্তু আমাদের মানি ব্যাগ গাড়িতে ফেলে এসেছি।
ফেরার পথে বাগাতোর। বিচ-এ বসে আছি। যেন ফেরার কোনও তাড়া নেই। সামনে চাপোড়া ফোর্ট আর বিস্তৃত সমুদ্র। তিনজনেই স্তব্ধ। পাশের আরও দুই বিচ-এ আরও কয়েকজন পর্যটক। তারাও অপলকে তাকিয়ে সমুদ্রের দিকে। দিনের ক্লান্তি, মুগ্ধতা নাকি নিজের সঙ্গে কিছুক্ষণ?
পঞ্চম দিনে ঘুম ভাঙল বৃষ্টির শব্দে। ঘড়িতে দেখি ৭টা বাজে। কাল আমরা অনেক রাত পর্যন্ত ভালো এক রেস্তোরাঁতে ছিলাম। ডিনার-এর পর প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত আমার দুই বান্ধবী ক্যারাওকের সঙ্গে গান গেয়েছে। আর আমি ছবি তুলেছি। আজ ৩টের ফ্লাইট, বেরোতে হবে ১২টায়। দেরি না করে অগত্যা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। লিস্ট-এর অনেক কিছুই কেনা হয়নি। কাজু, ওয়াইন, ফেনি, গোয়া লেখা টি শার্ট, এইসব কিনে লাঞ্চ করতে ঢুকলাম এক নতুন রেস্তোরাঁয়। চিকেন ভিন্ডালু (গোয়ার বিখ্যাত ডিশ) আর গোয়ান ফিশ কারি দিয়ে ভাত। লাঞ্চ সেরে ফিরতে না ফিরতেই নারায়ণ হাজির তার ট্যাক্সি নিয়ে। বারবারাদের বিদায় জানিয়ে চললাম এয়ারপোর্ট-এর পথে Travel Diary।
ফেরার পথে চোখে পড়ল টিটাস লেখা বড়ো বড়ো হোর্ডিং। টিটাস গোয়ার সবথেকে জনপ্রিয় নাইট ক্লাব যার বিজ্ঞাপনে ছেয়ে আছে উত্তর থেকে দক্ষিণ গোয়া। সেই টিটাস-এ আর পা রাখার সময় হল না। হল না অনেক কিছুই। দেখা হল না দুধসাগর, বেশ কয়েকটা নামকরা বিচ, গোয়ার স্পাইস গার্ডেন। কিন্তু যা দেখেছি তা না দেখার থেকে অনেক বেশি। রঙিন এই রাজ্যেই রঙিন আর সরল মানুষদের ছেড়ে যেতে মন চাইছে না। ছুটি শেষ হয়ে যাওয়া আর কাজে ফেরার মন খারাপ নয়, এই ক’দিনে তৈরি হওয়া আত্মীয়তা আর ভালোলাগাকে পিছনে ফেলে আসার মন খারাপ। মন যেন খারাপ গোয়ার-ও। সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার, কখনও টিপটাপ, কখনও অঝোরে বৃষ্টি। কিন্তু ঠিক এই যাওয়ার মুহূর্তে হঠাৎই সূর্যদেবের উঁকিঝুঁকি। ঝলমলে রোদ মাখা হাসি মুখে যেন বলতে চাইছে ‘আবার এসো, বন্ধু।’