অক্টোবর-এর শেষ। পুজোর ঠিক পরে– তখনও উত্তরে হাওয়ার গতি পায়নি কিন্তু গরমের তেজও নেই, রয়েছে শীতের মৃদুমন্দ আমেজ। এই আবহাওয়াকে সঙ্গী করে আমরা সাতকোশিয়া জঙ্গলের যাত্রী। সাতকোশিয়া দর্শনের আগে ভিতরকণিকার জলে-জঙ্গলে তিনটে দিন কাটিয়েছি, তারপরই পরিকল্পনা এই সাতকোশিয়া ভ্রমণের। চাঁদবালি থেকে চলে এসেছি সম্বলপুরগামী ৪২ নং জাতীয় সড়কের মোড়ে। এখানেই হবে গাড়ি বদল– সাতকোশিয়াতেও তিন দিনের প্যাকেজ Travelogue – Satkoshia।

মহানদীর উৎস মধ্যপ্রদেশ বর্তমানে ছত্তিশগড়ের রায়পুর জেলার ফরসিয়া অঞ্চল। সেই নদী ৯০০ কিমি পথ অতিক্রম করে পৌঁছেছে ওড়িষার টিকরপাড়ায়। মহানদীর দুপাশে পাহাড়, জঙ্গল, বালুচর– এই নিয়েই সাতকোশিয়া। দুপাশে পাহাড়ের বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে বলে সৃষ্টি হয়েছে গর্জ। আর এই গর্জ তথা গিরিখাতের সীমানা ৭ ক্রোশ তথা ১৪ মাইল (২২ কিমি)। তাই নাম সাতকোশিয়া গর্জ।

ভারতের বৃহত্তম এই গর্জকে ঘিরে বনাঞ্চল সাতকোশিয়া গর্জ, অভয়ারণ্য হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০০৭ সালে এই অভয়ারণ্য ওড়িশার দ্বিতীয় টাইগার রিজার্ভ হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। কটক, অঙ্গুল, নয়াগড়, বৌধ এই চার জেলা নিয়ে সাতকোশিয়া গর্জ অভয়ারণ্যের বিস্তার। তবে এই অঞ্চলে মহানদীর গতিপথ সৃষ্টি করেছে দুটি আলাদা অরণ্য ডিভিশন। নদীর এক পাশে নয়াগড় ও বৌধ জেলা নিয়ে মহানদী ওয়াইল্ড লাইফ ডিভিশন, আর অঙ্গুল ও কটক জেলা নিয়ে সাতকোশিয়া ওয়াইল্ড লাইফ ডিভিশন।

ইতিমধ্যে গাড়ি বদল হয়ে গেছে। ৪২ নং জাতীয় সড়ক ধরে আমরা এগিয়ে চলেছি।

দু-দুটো গাড়িতে যাত্রীর সংখ্যা মোট বারো। আস্তে আস্তে লোকালয় ফিকে হতে লাগল, দৃশ্যপটের অনেকটা জায়গা দখল করে নিল প্রকৃতি। পৌঁছে গেলাম ঢেঙ্কানল। প্রকৃতির মধ্যেই মাঝারি গোছের শহর। ফাঁকা পতিত জমি, সবুজ মাঠ, গাছের সারি, দূরে ছোটো ছোটো টিলা– তারই মাঝ দিয়ে মসৃণ পিচের রাস্তা। যেন সবুজ শাড়ির মধ্যে দিয়ে একটা কালো পাড় চলে গেছে। ধীরে ধীরে অঙ্গুল শহরের দিকে এগিয়ে চলেছি। রাস্তায় ট্রাফিকের চাপ একটু একটু করে বাড়ছে। তার প্রধান কারণ বোধহয় অঙ্গুল শহরে ঢোকার আগে রাষ্টায়ত্ত্ব সংস্থা ন্যালকোর কর্মযজ্ঞ। ন্যালকো একটি বিরাট ফ্যাক্টরি– তার গেটে জ্যামে আটকে রইল গাড়ি প্রায় মিনিট দশেক। অঙ্গুলেই রয়েছে ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিস। টিকরপাড়া, পুরাণকোট, লবঙ্গী জঙ্গলের বনবাংলো থাকার ব্যবস্থা হয় এই অঙ্গুল থেকেই। টিকরপাড়া নেচার ক্যাম্প চালু হয়নি, টিকরপাড়া বনবাংলো কোনও কারণে বন্ধ আছে তাই ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনায় (রাজু চৌহান কৃত) আমরা জঙ্গলের বাইরে থেকেই এবার অরণ্য পরিভ্রমণ করব।

অঙ্গুল পেরিয়ে গাড়ি আবার এগিয়ে চলে। এরপর আরও ১০ কিমি মতো পথ অতিক্রম করে গাড়ি বড়ো রাস্তা অর্থাৎ জাতীয় সড়ক ছেড়ে সরু রাস্তার পথ ধরল। জঙ্গল বোধহয় শুরু হয়ে গেল। ড্রাইভার জানাল একটু পরেই পড়বে সাতকোশিয়া গর্জ স্যাংচুয়ারির চেকপোস্ট। জায়গাটার নাম পম্পাসর। তবে আজকে আমাদের চেকপোস্ট পেরোতে হবে না। আমাদের বাসস্থান স্থির হয়েছে স্যাংচুয়ারির বাইরে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। চারপাশে প্রচুর গাছপালা, তারই মধ্যে হঠাৎই যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল একটা দোতলা বাড়ি, বাইরে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। গাড়ি এসে থামল সেই বাড়িটার উঠোনে। চারদিকের প্রকৃতি, অন্ধকারে ঠিক বোঝার উপায় নেই তবে একটা নিঝুম রহস্যময় আরণ্যক পরিবেশ যেন ঘিরে রয়েছে জায়গাটিকে। ঝিঁঝির ডাক যেন পরিবেশের আরও রহস্যময়তা বাড়ায়। আজ রাতে কিছু করার নেই। একতলা-দোতলা মিলিয়ে মোট চারখানা ঘর– তাই ভাগাভাগি করে আমরা দখল নিলাম। ভাত, ডাল, আলুভাজা, ডিমের কারি খেয়ে ঘুম।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চারপাশের পরিবেশ উপলব্ধি করার সুযোগ ঘটল। বাড়িটির সামনেই সুন্দর বাগান। বাগানে বসার বেঞ্চি, ছোটো-বড়ো গাছ ঘিরে রয়েছে, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা কম্পাউন্ড। পাশ দিয়ে চলে গেছে পিচের রাস্তা– পম্পাসর চেকপোস্ট এখান থেকে ২ কিলোমিটারের বেশি হবে না। জঙ্গল ভ্রমণের জন্য গাড়ি আসতে বেলা নটা বাজবে তাই পায়ে পায়ে বাগান দেখা। বাড়ির ছাদ থেকে আরও পরিষ্কার ভাবে দেখা যায় জঙ্গলের সূচনা, ছোটো ছোটো সবুজ টিলার সারির মধ্যে দিয়ে সূর্যদেব হঠাৎই আত্মপ্রকাশ করল। সূর্যোদয় অবশ্য অনেকটা আগেই হয়েছে তবে ভোরে আকাশ মেঘলা ছিল, এখন ধীরে ধীরে মেঘ সরে যাচ্ছে। পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যাচ্ছে।

ব্রেকফাস্টে লুচি, তরকারি, ডিমসেদ্ধ খেয়ে অপেক্ষা করছি গাড়ির জন্য। গাড়ি এল প্রায় সাড়ে নটা নাগাদ। দুটো গাড়ি একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। সকালের অরণ্যের রূপটাই আলাদা, মনটা বেশ চনমনে করে দেয়। আমরা পৌঁছে গেছি পম্পাসরের চেকপোস্টে। অঙ্গুল থেকে পম্পাসরের চেকপোস্টের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। গেটের গায়েই অনেকগুলি মৌমাছির চাক চোখে পড়ল। চেকপোস্টে প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র সংগ্রহ করে আমরা এগিয়ে চলি। পথের দুপাশে সবুজ গাছপালার সারি, কখনও ঘন আর কখনও বা হালকা। জঙ্গলে চেনা-অচেনা গাছের সমাহার। বাঁশের ঝাড়, শাল, পিয়াশাল, শিমুল, শিরীষ, অর্জুন, কেন্দু, গামারঞ্জঃ আরও কত নাম না জানা গাছ। বাঁদিকের পথ গেছে লবঙ্গী। সেদিকে এখন আমরা যাব না, এগিয়ে চলি সোজা জগন্নাথপুর হয়ে পুরানাকোটের দিকে।

দূরে দেখা যাচ্ছে সবুজ গাছে ঢাকা টিলা, কখনও বা পেরোতে হচ্ছে ছোটো ছোটো নালা। তারই মাঝে বনদফতরের বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে ‘হাতিদের পারাপারের রাস্তা’– অনেকটা শহরের বড়ো রাস্তায় জেব্রা-ক্রশিং-এর মতো। আকাশে মেঘ-সূর্যের লুকোচুরি খেলা চলছে। এই সকাল বেলাতেও তাই জঙ্গলের মধ্যে যেন আলো-আঁধার অবস্থা। পৌঁছে গেলাম পুরানাকোট। অপেক্ষাকৃত বড়ো গ্রাম, দোকানপাট কিছু আছে, রয়েছে কিছু পাকাবাড়ি, বনদফতরের অফিস, ব্রিটিশ আমলে তৈরি বনবাংলো। এইসব নিয়ে সংসার পেতেছে পুরানাকোট। এখান থেকে আরও ১০ কিমি দূরে টিকরপাড়া আমাদের আজকের ভ্রমণের প্রথম লক্ষ্য। পুরানাকোটের পর একই রকম জঙ্গল চলল আরও কিছুক্ষণ। কোনও জীবজন্তুর দেখা না পেলেও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ চলা সব সময়ই আনে এক আলাদা অনুভূতি, এক অন্যতর আমেজ। জঙ্গলটা হঠাৎই যেন হালকা হয়ে শেষ হয়ে যায়। সামনে এক বিশাল প্রান্তর। জায়গাটার নাম কররাপাড়া। পাহাড়গুলো যেন আগের থেকে অনেক কাছে চলে এসেছে। পথের দুধারে সবুজ গাছপালায় ঢাকা সবুজ পাহাড়। সামনেও যেন পথ আগলে রয়েছে একসারি পাহাড়।

টিকরপাড়া কিন্তু পুরানাকোটের থেকে অনেক ছোটো জনপদ। দু-চার ঘর বসতি, বনদফতরের অফিস, বনবাংলো এই নিয়ে টিকরপাড়া। হ্যাঁ, তার সঙ্গে সব সময়েই রয়েছে জঙ্গলের হাতছানি। এবার দেখা হয়ে গেল নায়িকার সঙ্গে। না ছায়াছবির নয়, সাতকোশিয়ার নায়িকা মহানদী। নদীর একবারে সামনেই টিকরপাড়া বনবাংলো। পরপর তিনটে বাংলো, সামনে পাকা রাস্তা– রাস্তার ওপার ঢালু হয়ে নেমে গেছে নদীর খাতে। ফিরে আসি মহানদীর কথায়। ওড়িশার প্রধান নদী এই মহানদী। আশ্চর্য ও রহস্যময় এই নদী যেন নারীর মনের মতো। কোথাও তার ব্যাপ্তি কয়েক হাজার মিটার আবার কখনও কয়েকশো মিটার মাত্র। এই নদীর গভীরতারও কোনও ধারাবাহিকতা নেই। কোথাও বা তল পাওয়া যায় না আবার কখনও পায়ের পাতাও ডোবে না। স্রোতের ধারাও কখনও বা ক্ষুরধার তীব্র কোথাও আবার কুলুধীর গতিতে বহমান। এই রহস্যময়ী মহানদীর বুকেই সাতকোশিয়া। সাতকোশিয়া অরণ্যও তাই বোধহয় রহস্যময়তার আর-এক রূপ।

পাহাড়ি গর্জের মধ্য দিয়ে মহানদী ৭ ক্রোশ পথ অতিক্রম করে এসেছে বলেই এখানে মহানদীকে ঘিরে ঘন অরণ্যকে সাতকোশিয়া গর্জ স্যাংচুয়ারি নামে অভিহিত করা হয়েছে। গভীর অরণ্যে বিচরণ করে বাঘ, হাতি, হরিণ, বাইসন, ভালুক, চিতাবাঘ প্রভৃতি বন্যপ্রাণী। নদীর জলে কুমিরের স্বর্গরাজ্য আবার গাছে গাছে, আকাশে পাখপাখালির মেলা। ঘন বুনোট জঙ্গলে রয়েছে শাল, পিয়াশাল, আমলকী, শিরীষ, অর্জুন, গামার, কেন্দু, বাঁশ প্রভৃতি গাছের ভিড়়। বুনো ফুলের গন্ধেও মাতোয়ারা হয় এই বনাঞ্চল, অপূর্ব এই জঙ্গলের শোভা। একেবারে আদিম আরণ্যক পরিবেশে জঙ্গলের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কয়েকটি বনবাংলো। জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করতে হলে বনবাংলোতে থাকতে হবে। টিকরপাড়া ছাড়াও বনবাংলো রয়েছে পুরানাকোট, লবঙ্গী, বাঘমুণ্ডা, পম্পাসর প্রভৃতি অঞ্চলে। এছাড়া রয়েছে রামগাঁওনালা ইকো ক্যাম্প।

টিকরপাড়া বনবাংলোর কাছেই গড়ে তোলা হয়েছে কুমির প্রজনন প্রকল্প। এখানে মাছখেকো কুমির– ঘড়িয়ালের চাষ করা হয়। ডিম ফোটানো থেকে কিছুটা বড়ো করে নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। ব্রিডিং ট্যাংক একদিকে আর অন্য ট্যাংক-এ নানা মাপের ঘড়িয়াল। লোহার জালের ফাঁক দিয়ে তাদের সঙ্গে দেখাও হয়ে গেল। রাস্তার ওপারে সিঁড়ি নেমে গেছে ঘাট পর্যন্ত। সেখানে রয়েছে বনদফতর অনুমোদিত মোটর চালিত নৌকা। এই নৌকা পর্যটককে ঘুরিয়ে আনবে মহানদীর বুকে। সিঁড়ির মুখেই গাছের ডালে দেখা হয়ে গেল এক বিরাট বাদামি রঙের কাঠবেড়ালির সঙ্গে। ডালে ডালে তার ছুটোছুটির ফাঁকে বহু কষ্টে তার একটি ছবি তোলা হল।

ঘাটে পৌঁছে দেখি বোট মোটে একটাই চলছে। একটা ট্রিপ এইমাত্র রওনা হয়েছে। ফিরে এলে তবেই আমাদের পালা। বোটে মাত্র ৬ জনের জায়গা তার মানে আমাদেরই দুটো ট্রিপ লাগবে। অগত্যা মহানদীর ধারে একটু ঘোরাঘুরি। জঙ্গলে ভরা পাহাড়ের ঢাল নেমে এসেছে একেবারে নদীর তীর পর্যন্ত, ঢাল থেকে গাছ হেলে পড়েছে মহানদীর সবুজ জলে। কয়েকটা জেলে নৌকা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষার পর বোট ফিরে এল ঘাটে। এবার আমাদের পালা বোট সফরের। সবুজ জল কেটে নৌকা এগিয়ে চলে। পাহাড় জঙ্গল আর নদীর এক অপূর্ব ফ্রেম চোখের সামনে ভেসে এল। প্রায় ৫১ মিটার গভীর মহানদীর এই গর্জ অঞ্চল। পাহাড়ি গর্জের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে এই বিশাল মহানদী, নদী থেকে দেখতে থাকি পাহাড়, জঙ্গল, নদী, আকাশের অপার প্রকৃতিকে।

জঙ্গলের সবুজ ঠাস বুনন গাছপালা, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, তীরে গাছের ডালে বানরের লাফালাফি দেখতে দেখতে হঠাৎই বোটের চালকের কথায় চমক ভাঙে– ‘ওই দেখুন কুমির’! প্রথমে মনে হয়েছিল নদীতে একটা কাঠের গুঁড়ি ভেসে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে প্রকাশ পেল তার বিশাল শরীর– তারপরই টুপ করে ডুব দিল জলে। নৌকা কখনও চলছে মাঝনদী বরাবর কখনও বা তীরের কাছাকাছি। তীরের কাছে এলে অরণ্যের রূপ আরও বিষদভাবে পাওয়া যাচ্ছে। একটা বাঁকের মুখে ধু-ধু বালুচর। বোটচালক জানাল এই বালুচরেই বসে রামগাঁওনালা ইকো ক্যাম্প। ঘাট থেকে দূরত্ব প্রায় ৩ কিমি। বোট চালক বলতে থাকে ক্যাম্পের গল্প– ‘এই বিস্তীর্ণ বালুচরে পড়ে সার সার তাঁবু। সেখানে রয়েছে আরামপ্রদ থাকার ব্যবস্থা। টয়লেট, খাওয়াদাওয়া, অরণ্য ভ্রমণের ব্যবস্থাও থাকে প্যাকেজের মধ্যে। বাঁশের মাচায় থাকে জলের ট্যাংক– জলের অভাব থাকে না, জাল দিয়ে ঘেরা বিশাল চত্বরের একপাশে রান্নাঘর, খাওয়ার জায়গা। এখনও শীত আসেনি তাই তাঁবু পড়েনি। দিন পনেরোর মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে এই কর্মযজ্ঞ। কাঁটাতারের ওপার থেকে দেখবেন দশ হাত দূরে বালির চড়ায় রোদ পোয়াচ্ছে বিশাল এক কুমির!’

কথা বলতে বলতে বোট আরও এগিয়ে চলে। দুপাশে পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে প্রবহমান মহানদীর গর্জের দৈর্ঘ্য ২২ কিমি। সবুজ জঙ্গলরেখার নীচে পান্না সবুজ জলের কিনারে সাদা বালুচর নিয়ে যে ছবি একটু আগে দেখলাম তা বহুদিন স্মৃতির মণিকোঠায় ধরে রাখা যাবে। ইতিমধ্যে আরও কয়েকটি কুমিরের দর্শন পাওয়া গেল। অবশ্য সবই জলে অর্ধনিমগ্ন অবস্থায়। শীতকাল নয় বলে বোধহয় নদীর ধারে বালির চড়ায় শুয়ে রোদ পোয়াতে দেখা গেল না। ইতিউতি উড়ে বেড়াচ্ছে পাখি। নদীর পাড়ে তো আছেই আবার নদীতে ভাসমান কাঠ-কুটোর ওপরে বসেও ক্ষণেক বিশ্রাম নেয়। ব্রাহ্মণী হাঁসের দলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। স্যান্ডপাইপার, রাডি শেলডাকের দলও অভ্যর্থনা জানায় তাদের আপন দেশে। তীরের অনেক গাছই যেন হেলে পড়ে মহানদীর সঙ্গে কিছু গোপন কথা বলে নিচ্ছে। দাঁড় টানা নৌকোয় জেলেরা মাছ ধরছে। শুনেছি মহানদীর মাছের স্বাদ নাকি খুব ভালো। বোট এবার ফেরার পথ ধরল। একদল এখনও অপেক্ষা করে বসে আছে ঘাটে।

ফিরে আসি আমাদের আস্তানায়। আকাশে খুব মেঘ জমেছে হয়তো বৃষ্টি হবে। খেতে খেতেই নামল অঝোর ধারায় বৃষ্টি। বেলা চারটের সময় আবার জঙ্গল ভ্রমণের প্রোগ্রাম ছিল, তা হবে কিনা সন্দেহ হচ্ছে। গাড়ি এসে গেলেও বৃষ্টির জন্য অনেকটাই দেরি হয়ে গেল। সাড়ে চারটেরও পরে বৃষ্টি থামতে গাড়ি স্টার্ট করল। যাব লবঙ্গীর জঙ্গলে। পম্পাসর চেকপোস্ট থেকে বাঁদিকে পথ ঢুকে গেছে লবঙ্গীর দিকে।  এই পথের দূরত্ব বেশি নয় মাত্র ১১ কিমি। পথ অবশ্য বড়োই বন্ধুর– পাথর মাটির সরু রাস্তা জঙ্গলের উপচে পড়া গাছপালাকে ভেদ করে যেন চলে গেছে। এই এবড়োখেবড়ো পথে গাড়ি চালাতে অসামান্য মনঃসংযোগ ও সাবধানতা দরকার। মাঝে মাঝে আবার বাম্পার। সাতকোশিয়া অভায়ারণ্যের ব্যাঘ্র প্রকল্পের কোর এরিয়ার অনেকটা জুড়ে এই লবঙ্গীর জঙ্গল। আমাদের দুটি গাড়ির একটির ড্রাইভারের এপথে নিয়মিত যাতায়াতের অভিজ্ঞতা আছে– সে পথ দেখাচ্ছে আর অন্য গাড়িটি অনুসরণ করছে। প্রতি বাঁকে জঙ্গলের গভীরতা বাড়ছে, একটা দমবন্ধ করা উত্তেজনা যেন ঘিরে ফেলছে আমাদের। কখনও বা গাছের ডাল নুয়ে পড়েছে রাস্তার ওপর– ঘটাং ঘটাং শব্দ করে গাড়ি তার পথ করে নিচ্ছে। জঙ্গল কিন্তু নিঃশব্দ। এ জঙ্গলে বাঘ, হরিণ গউর, সম্বর, ভালুক, শজারু, বুনোকুকুর সবেরই দেখা মিলতে পারে। সন্ধ্যা ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসছে। সামান্য পথরেখাকে সম্বল করে গাড়ি এগোচ্ছে। পথের ওপরে প্রায় নেমে এসেছে বাঁশের ঝাড়, তার সঙ্গে শাল, আমলকী, শিশু, অর্জুন, কেন্দু, কুসুম, হিজলের ঠাসাঠাসি সমন্বয়। কখনও ঝোরা বয়ে যাচ্ছে পথের ওপর দিয়ে তবে জলধারা অত্যন্ত ক্ষীণ। কখনও ঝোরা পুরো শুকিয়েই গেছে। কিছু ভাঙ্গা গাছপালা দেখিয়ে ড্রাইভার জানাল কিছুক্ষণের মধ্যেই এ পথে চলে গেছে হাতির পাল। তাই সাবধানতা নেওয়া দরকার।

সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। পাখিদেরও ঘরে ফেরার পালা, তাই তাদের কিচিরমিচিরে এখন আকাশ-বাতাস মুখরিত। এই আলো-আন্ধারির মাঝে দেখলাম এক অপূর্ব দৃশ্য– সবুজ বনে এক হলুদ আগুন। না দাবানল নয়– অসংখ্য হলুদ রঙের প্রজাপতি ভেজা বালির ওপর বসছে আবার উড়ছে আবার বসছে– বোধহয় তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। রোমাঞ্চে ভরা এই পথটুকু অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম লবঙ্গীর বনবাংলোতে। বাংলোতে আলো জ্বলছে কিন্তু বাসিন্দা কেউ নেই। আমাদের কোনও বুকিং নেই, হঠাৎই চলে এসেছি, রাত্রিবাসেরও কোনও পরিকল্পনা নেই। বাংলোর ঘরের সামনে চওড়া বারান্দা, দুদিকে দুটি ঘর, মাঝে ডাইনিং স্পেস। পিছনে কিছুটা দূরে রান্নাঘর আর চৌকিদারের ঘর। সামনে কিছুটা খোলা চত্বর সেখানে পাথরের বেঞ্চি, গাছের গুঁড়ির আকারে বসার জায়গা, পাথরের টেবিল। চত্বর ঘিরে রেলিং দেওয়া– তারপর ঢালু উপত্যকা নেমে গেছে নীচে। এই বনবাংলো বছর খানেক হল পুনর্নির্মিত হয়েছে। ইচ্ছে ছিল কাছেই ওয়াচ-টাওয়ারে যাওয়ার, কিন্তু বনবাংলোর কেয়ারটেকার ও ফরেস্ট গার্ড অনুমতি দিল না। অন্ধকার হয়ে গেলে সন্ধ্যা ছটার পর এ পথে যাওয়া টুরিস্টদের নিষিদ্ধ। বিশেষত অনেকটা পথ যখন গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যেতে হবে। অতএব ফেরার পথ ধরতে হল। জায়গাটা এতটাই ভালো লেগে গেল যে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কালকে সকালেও আমরা এখানে আসব।

ফেরার পথ অন্ধকার– জঙ্গলে রাতের সফর একেবারে আলাদা অনুভূতি। আকাশ অনেকটা পরিষ্কার, চাঁদের অস্পষ্ট একটা আলো জঙ্গলকে যেন আরও রহস্যময় করে তুলেছে। এই রাতের জঙ্গলের বর্ণনা আমরা পেয়েছি প্রখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব গুহর ‘লবঙ্গীর জঙ্গলে’ উপন্যাসে। তার কয়েকটি লাইন এখানে তুলে দিচ্ছি– ‘এখন গভীর রাত। চাঁদের আলোয় পত্রহীন কোমল সাদা গেন্ডুলি গাছগুলোকে সাদা মোমের মতো দেখাচ্ছে। সাদা সাদা মইফুলগুলোকে সাদা সিল্কের রিবনের ফুল বলে মনে হচ্ছে। রাতে কুসুম, শিমুল, পলাশকে কালো কালো মনে হয়। ওদের শোভা দিনে। খাদের ওপাশে একটা খুব উঁচু পাহাড়। উটের পিঠের কুঁজের মতো তার কুঁজ চাঁদটাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে। তারার মালা আকাশময়। চাঁদের রাতে ওদের প্রভা মলিন। তবুও আছে।’

পরের দিন সকালে আবার একই পথে যাত্রা শুরু করে সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম লবঙ্গী বনবাংলোতে। বাংলোর বর্ণনা তো আগেই দিয়েছি কিন্তু রাতে চারপাশের দৃশ্য তো কিছু বোঝা যায়নি। বনবাংলোর চত্বর থেকে চোখে পড়ল সবুজ পাহাড়ের সারি আর পাহাড় আর বাংলোর মাঝে সবুজ ঘাসের ঢেউখেলানো উপত্যকা। চারদিকে এখনও যদিও কুয়াশা রয়েছে তবু বেলা বাড়ার সঙ্গে ধীরে ধীরে তা কেটে যাচ্ছে। ভীমধারা ফলস এখন কোর এরিয়ায় পড়ছে তাই পর্যটকদের এখন যাওয়া নিষেধ। তবে ওয়াচ-টাওয়ার পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি মিলেছে। দু’জন ফরেস্ট গার্ড আমাদের গাড়িতে উঠে পড়ল, এগিয়ে চলি ওয়াচ-টাওয়ারের দিকে।

ঘাসের উপত্যকার মধ্য দিয়ে রাস্তা– ঢাল নেমে গেছে জঙ্গলের দিকে। গোটা দুয়েক বাঁক কেটে গাড়ি কোর এরিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়ল (বোর্ডে কোর এরিয়া লেখা)। আর একটু এগিয়ে একটা নালার সামনে গাড়ি থামল। বনকর্মী জানাল এখান থেকে ওয়াচ-টাওয়ার হেঁটে যেতে হবে। দুপাশেই গভীর জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে মিনিট পাঁচেক পায়ে চলা পথ পেরিয়ে ওয়াচ-টাওয়ার। সবাই ধীর পায়ে ওয়াচ-টাওয়ারের শীর্ষে। চারপাশের জঙ্গলের আরও পরিষ্কার ছবি চোখে পড়ে। ওয়াচ-টাওয়ারের লাগোয়া জলাশয় ও সল্টলিক। এখানে জঙ্গলের জন্তুজানোয়ার এমনকী বাঘও জল খেতে আসে। একটা হরিণ জল খাচ্ছিল তারপর হঠাৎই একছুটে অদৃশ্য। গাইড জানাল বাঘ আসার সম্ভাবনা আছে। প্রচুর পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে, জলাশয়ের আশেপাশে অসংখ্য গাছে তাদের আশ্রয়। এরপরই অনন্ত প্রতীক্ষা। আর কোনও জন্তু জল খেতে এল না। জঙ্গলে পাখি-পাখালির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দও শোনা গেল না। ঘণ্টাখানেক কেটে গেল লবঙ্গীর ওয়াচ-টাওয়ারে। এবারে ফেরার পালা।

বনবাংলোতে বনকর্মীদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চলল এবার আবার টিকরপাড়ার দিকে। সেখানে যাব হাতিগির্জা ওয়াচ-টাওয়ারে। এবার যদি দু-একটা বন্যপ্রাণীর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। রাস্তার ওপর গাড়ি রেখে মিনিট দশেক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা। এবার সঙ্গে বনকর্মী নেই। ড্রাইভারই আমাদের গাইড। কেউ বলে হাতিগির্জা কেউ বলে হাতিগুম্ফা– তবে গির্জা বা গুম্ফা কোথাও চোখে পড়েনি। তবে এ অঞ্চলে প্রচুর হাতি ঘোরাফেরা করে এটা অনস্বীকার্য। এখানেও একই ব্যবস্থা ওয়াচ-টাওয়ারের পাশেই জলাশয় ও সল্টলিক। ওয়াচ-টাওয়ারে উঠতে উঠতে হাতির বৃংহণ কানে এল– তার মানে হাতির দল ধারে কাছেই আছে। তবে কপাল মন্দ আধঘণ্টা অপেক্ষা করেও তাদের দেখা পাওয়া গেল না। আবার আকাশে মেঘ করছে। বৃষ্টি নামার আগেই ফেরার পথ ধরতে হবে।

আজকেই জঙ্গল সফরের শেষ দিন। অবশ্যই ফিরে আসতে হবে সাতকোশিয়ায় আর থাকতে হবে জঙ্গলের গভীরে বনবাংলোগুলিতে– তবেই অনুভব করা যাবে অরণ্যের যথার্থ শিহরণ।

প্রয়োজনীয় তথ্য

ট্রেনে হাওড়া থেকে কটক তারপর গাড়িতে অঙ্গুল বা একেবারে টিকরপাড়া। অঙ্গুলে সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ আছে সম্বলপুর এক্সপ্রেসের মাধ্যমে। অঙ্গুলে বাদামবাড়ি বাস স্ট্যান্ড থেকে অঙ্গুলের বাস পাওয়া যাবে। অঙ্গুল থেকে টিকরপাড়া ৬০ কিমি। জঙ্গল ভ্রমণে সঙ্গে গাড়ি রাখা একান্তই প্রয়োজন।

সাতকোশিয়া অরণ্য অঞ্চলে লবঙ্গী, পুরানাকোট ও টিকরপাড়ার বনবাংলোর ঘর বুকিং-এর জন্য যোগাযোগ করতে হবে– ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার, সাতকোশিয়া ওয়াইল্ড লাইফ ডিভিশন, অঙ্গুল, পোস্ট হাকিমপাড়া অঙ্গুল, ওড়িশা – ৭৫৯১৪৩, ফোন – ০৬৭৬৪ ২৩৬২১৮, নেচার ক্যাম্পের বুকিং করা যাবে একই ঠিকানায় – ফোন নং – ০৬৭৬৪ ২৩৬২১৮

অনলাইনেও বুক করা যায় www.satkosia.org

নেচার ক্যাম্পের ভাড়া দিনপ্রতি ১৫০০ টাকা। থাকা-খাওয়া বোট ভ্রমণ, জঙ্গল ভ্রমণ দুজনের খরচ সমেত।

সেরা সময় অক্টোবর-মার্চ তবে, নেচার ক্যাম্প চালু হয় নভেম্বর মাস থেকে।

এ অঞ্চলে মোবাইলের টাওয়ার পাওয়া দুষ্কর। সঙ্গে যথেষ্ট পানীয় জল রাখা প্রয়োজন। জলে কুমির আছে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...