অগ্নিদেব চট্টোপাধ্যায়ের ঘরণী সুদীপা। দু’জনেই সেলিব্রিটি, তাই দিনের বেশিরভাগটাই কেটে যায় ব্যস্ততার মধ্যে। সারাদিন শুটিং, পরিচালনা ছাড়াও ছবি প্রযোজনার কাজও থাকে। সুদীপা স্ক্রিপ্ট লেখার ব্যস্ততার মাঝেই টিভির পর্দার জন্যে শুটিং-এর কাজও সেরে ফেলেন। দু’জনেরই সারাদিনে প্রচুর পরিশ্রম তাই বিশ্রামেরও দরকার পড়ে, যেটা শহরে থাকলে কিছুতেই সম্ভব হয় না। সেইজন্যে কাজের একঘেয়েমি কাটাতে আর অসম্ভব বেড়াতে ভালোবাসেন বলেই কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়ান দেশে-বিদেশে। এমনই এক ক্রিসমাসের সময়, হাতে ক’দিন ছুটি পেতেই সুদীপা ও অগ্নিদেব ঘুরে নিয়েছিলেন ইউরোপ এবং সেই অভিজ্ঞতার Europe Tour কথা শেয়ার করে নিলেন আমাদের সঙ্গে।
দুবাই
ইউরোপ যাওয়ার ইচ্ছে বহুদিন ধরেই ছিল। সুযোগটা এসে গিয়েছিল ডিসেম্বর মাসে ক্রিসমাসের ওই সময়টায়। ঠিক করাই ছিল ২৫ ডিসেম্বর-টা রোমে কাটাব এবং সেইমতো বেড়াবার প্ল্যান সেট হয়েছিল। কলকাতা থেকে বিমানে প্রথম হল্ট দুবাই। সেখান থেকে বিমান পরিবর্তন করে আমরা পৌছব ইতালি। দুবাই-তে পৌঁছে প্লেন থেকে নামতেই আমাদের স্বাগত জানাল দুবাইয়ের ঝাঁ-চকচকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। পলিউশন ফ্রি শহর, ঝকঝকে চওড়া চওড়া রাস্তা। সামান্য বিশ্রাম সেরে শহরের কিছু দর্শনীয় জায়গা ঘুরে নিলাম। মরুভূমির মধ্যে একটা শহরকে যে এতটা সুন্দর সাজিয়ে তোলা যায়, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা অসম্ভব। আকাশছোঁয়া বিল্ডিং, অত্যাধুনিক স্থাপত্যশিল্প, লাক্সারি শপিংমল, আর্টিফিশিয়াল বাগান, ফোয়ারা সবকিছুই প্রতিমুহূর্তে ব্যস্ততম বাণিজ্যিক শহর হিসেবে দুবাইকে স্বীকৃতি জানাচ্ছে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ ইমারত ৮৩০ মিটার উচ্চতার বুর্জ খালিফা হোটেলটি এবং বুর্জ আল আরবের স্থাপত্যবিস্ময় আমাদের মুগ্ধ করল। এছাড়াও দেখে নিলাম মিউজিয়াম, জুমেরা মস্ক, গ্র্যান্ড মস্ক, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। একটি মন্দিরে শিব এবং কৃষ্ণের মূর্তি পূজিত হচ্ছে এমন ছবিও চোখে পড়ল। দেশে ফেরার পথে কেনাকাটা করা হবে তাই শপিং প্লাজাগুলি বাদই থেকে গেল।
রোম
দুবাই থেকে আমাদের গন্তব্য ছিল ইতালির ভ্যাটিকান সিটি। পোপের সঙ্গে মিডনাইট মাস-এ যোগ দেওয়া ছিল মূল উদ্দেশ্য, সময়টা যেহেতু ক্রিসমাসের সময়। ইটস আ লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট। এখানে আসতে হলে ছয়-সাত মাস আগে থেকে টিকি বুকিং করতে হয়। সেসব না করেই ভগবানের আশীর্বাদে আমাদের যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়ে গিয়েছিল। মিডনাইট মাসে, ভ্যাটিকান সিটিতে, পোপের সামনে দাঁড়িয়ে প্রেয়ার করা তার যা অনুভূতি সেটা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। মনে হচ্ছিল স্বয়ং ঈশ্বর ওখানে সামনে বসে আছেন। চোখ যে কখন জলে ভরে এসেছিল বুঝতেই পারিনি। বাইরে লক্ষ্য লক্ষ্য বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের ভিড়। প্রার্থনার ভাষাও ল্যাটিন। আমাদের সকলের হাতে ধরা ইংরেজি লেটারিং করা বইটি, মানেটাও তাতেই দেওয়া। আমার একপাশে দাঁড়িয়ে এক চিনা দম্পতি অন্যপাশে দু’জন রাশিয়ান, সামনে একজন জার্মান। সমবেত স্বরে সকলে প্রার্থনা করছে। পোপ সকলকে ‘মেরি ক্রিসমাস’ উইশ করলেন এবং সকলে একসঙ্গে গলা মিলিয়ে ওনাকেও উইশ করা হল। আমাদের এই পাওয়াটা যে কতখানি তা বুঝিয়ে বলা যাবে না।
রোমের চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে মূর্ত ইতিহাস। পৃথিবীর একসময়ের সর্বোত্তম শক্তিশালী সাম্রাজ্য রোমের ইতিহাস এবং এখানকার সম্রাটদের কীর্তিকাহিনি আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। সর্বাপেক্ষা স্মৃতিসৌধের সংখ্যাও রোমেতেই বেশি। মূল আকর্ষণ ছিল ব্যাসিলিকা চার্চের সৌন্দর্য। এ ছাড়াও, মিউজিয়াম, সিসটিন চ্যাপেল যেখানে পোপ থাকেন, এরই ঠিক উলটো দিকে সেন্ট পিটারস স্কোয়্যার সবই ঘুরে ঘুরে দেখে নিলাম। ভ্যাটিকান সিটি তৈরির সময় প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনার্দো ভিঞ্চির যে-বাসস্থানটি ছিল, সেটাও বাইরে থেকে দেখা হল কারণ ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। তাঁর সৃষ্ট অগণিত ফ্রেসকো রোমের শোভা যেন আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
কিন্তু শুধু ঘুরে বেড়ালেও চলে না, উদর পূর্তির ব্যবস্থা থাকাও জরুরি। এখানকার খাবার, আইসক্রিম অসম্ভব ভালো। বিশেষ করে একটি রেস্তোরাঁর কথা বলতেই হচ্ছে যেখানে বলিউড তারকারা তো বটেই, হলিউডেরও টম ক্রুজের মতো বাঘা বাঘা অভিনেতা, অভিনেত্রীরা একবার না খেয়ে আসেন না। এখানেই প্রথম অক্টোপাস খাওয়ার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি। পারমিশন নিয়ে ‘রান্নাঘর’-এর জন্য কিছুটা স্টক শট অগ্নি-র ক্যামেরায় ক্যামেরাবন্দি করা হয়।
মিলান
রোম থেকে চলে আসি মিলানে যেখানে পাগলু সিনেমার শুটিং করা হয়েছিল। এখানে বহু চার্চ, দুর্গ রয়েছে যেগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ করে। বাঙালি ফুটবল প্রেমী। এখানে দুটি বিখ্যাত ফুটবল টিম, ইন্টার মিলান এবং এসি মিলান টিমের খেলার জন্যে যে ফুটবল গ্রাউন্ড-টি রয়েছে, ‘স্যান সিরো স্টেডিয়াম’, সেটি বাঙালি হিসেবে প্রথমেই দেখে নেওয়ার কথা মনে হল। স্টেডিয়াম দেখে পৌঁছলাম মিলানো ক্যাথিড্রাল। জিশুর সামনে বসে প্রার্থনা সেরে নিয়ে, লিওনার্দোর আঁকা বিখ্যাত ফ্রেসকো ‘দ্য লাস্ট সাপার’ দেখতে পৌঁছলাম সান্টা মেরিয়া কনভেন্টে। অপূর্ব সেই পেন্টিং এবং সেটি দেখার অনুভূতি।
ভেনিস
মিলান দেখে পাড়ি দিলাম আমরা ভেনিস। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, অসাধারণ অনুভূতি। সমুদ্রের নোনা জল ঢুকে তৈরি হয়েছে লেগুন। তারই উপরে ছোটো ছোটো একশোটি দ্বীপের সমন্বয়ে ভেনিস শহর গড়ে উঠেছে। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া নেই। সারা শহরটাকে যুক্ত করেছে গ্র্যান্ড ক্যানাল তার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে। জলের উপর থেকে মাথা উঁচিয়ে রয়েছে পাথরের তৈরি প্রাসাদোপম অট্টালিকাগুলি। শহরের সবথেকে পুরোনো ব্রিজটার নাম রিয়ালটো ব্রিজ। কয়েক হাত অন্তর একটা করে গির্জা। বেলটাওয়ারটিও পুরোনো শহরের ঐতিহ্য বহন করছে। টুরিস্টদের যাতায়াতের জন্যে ওয়াটারবাস-ট্যাক্সির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে বাস, ট্যাক্সি ছেড়ে গণ্ডোলা করে ঘোরাটাই আমরা বেছে নিলাম। ততদিনে ইতালীয় খাবার খেতে খেতে দেশের খাবারের স্বাদ নিতে মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে আমাদের। পেয়েও গেলাম ‘গণেশ’ নামে ভারতীয় একটি রেস্তোরাঁ। এখানে থাকাকালীন পৃথিবী বিখ্যাত মুর্যানো গ্লাস ফ্যাক্টরিও দেখার সৌভাগ্য হয়ে গেল আমাদের। কালেকশন দেখে মুগ্ধ হতে হয়। জিনিসও কিনলাম।
ফ্লোরেন্স
এর পরের ঠিকানা ফ্লোরেন্স। শিল্প, সংস্কৃতির জন্মস্থান। এখানকার মূল আকর্ষণ ক্যাথিড্রাল। ক্যাথিড্রালের বিশাল ডোমটি টেরাকোটা টাইলস দিয়ে তৈরি। এছাড়াও দেখলাম বিখ্যাত পেন্টারদের শতাব্দী প্রাচীন ফ্রেসকো। সেগুলোর মধ্যে নাম করতে হয় মাইকেল্যাঞ্জেলোর ‘ডেভিড’, বোত্তিচেল্লির ‘দ্য বার্থ অফ ভেনাস’ এবং লিওনার্দের ‘অ্যানানসিয়েশন’-এর।
সুইটজারল্যান্ড
অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মুখোমুখি হলাম সুইটজারল্যান্ডে পৌঁছে। আগের স্পটগুলো থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। প্রকৃতি তার সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছে সুইটজারল্যান্ড-কে সাজাতে গিয়ে। আল্পস্-এর কোলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন একটা ছবির মতো দেশ। রাস্তাঘাট ঝাঁ-চকচকে। বাড়িতে বাড়িতে ঘড়ির ছোটো ছোটো ইন্ডাস্ট্রি। চকোলেট, চিজের জন্যে বিখ্যাত সুইটজারল্যান্ড। ব্ল্যাক ফরেস্টে গিয়ে ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক খাওয়া হল। সুইটজারল্যান্ডের দিকে রাইন নদীর ধার ঘেঁসে জার্মানির কিছুটা অংশ আমরা দেখে নিতে পেরেছিলাম কিন্তু আর এগোনো সম্ভব হয়নি প্রচন্ড ঠান্ডা ও বরফের কারণে। সুইটজারল্যান্ডে পাহাড় থাকলেও, ওখানকার থেকেও অনেক বেশি ঠান্ডা জার্মানিতে। সুতরাং জার্মানি বেড়াবার আশা ত্যাগ করে সুইটজারল্যান্ডেই ফিরে আসতে হল। জার্মানি, সুইটজারল্যান্ড থেকে কেনা হল ঘড়ি, কুক্বু ক্লক্ তৈরিতে ওখানকার কারিগররা দক্ষ।
ইউরোপে আমাদের যে অভিজ্ঞতা-টা হয়েছিল সেটা ভোলার নয় কারণ রোম থেকে জার্মানি পুরোটাই আমরা ঘুরেছিলাম গাড়িতে। বাঙালি বলেই হয়তো লাগেজ এতটাই বেশি হয়েছিল, ইউরো রেল ভ্রমণের সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হই কারণ ওখানে ট্রেনে অত লাগেজ নিয়ে ওঠার নিয়ম নেই। আমাদের লাগেজ দেখেই ওরা বুঝে গিয়েছিল আমরা ভারতীয়। ইউরো রেলে ভ্রমণের আশা ত্যাগ করি। পুরো টুর-টার জন্যে গাড়ি ভাড়া করা হয়। আর গাড়িতে ঘুরেছি বলেই যেখানে ভালো লেগেছে গাড়ি থামিয়ে মন ভরে প্রকৃতিকে উপভোগ করেছি। ক্যাসিনো-তে গিয়ে টাকা জিতেছি, আবার ওই টাকা দিয়ে প্রচুর শপিং-ও করেছি।
ফেরার পথে আবার দুবাই হয়ে দেশে ফেরা। তবে ভেবেছিলাম ফেরার পথে দুবাই-তে কেনাকাটা সেরে নেব। কিন্তু আমাদের শপিং ইউরোপেই সারা হয়ে গিয়েছিল। ইউরোপের অভিজ্ঞতার কথা মনে হলেই ওখানকার মানুষজনের কথাও সবথেকে আগে মনে আসে। তারা নিজেদের দেশ, সংস্কৃতি নিয়ে যতটা গর্বিত ততটাই তারা সেই সংস্কৃতিকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর। সারা ইতালি-তে কাউকে ইংরেজি বলতে শুনিনি। ইংরেজি-তে প্রশ্ন করলেও হোটেল থেকে শুরু করে ট্যাক্সিচালক, সকলেই ইতালীয় ভাষায় উত্তর দিয়েছে। তাতে কিন্তু ওদের ব্যাবসার ক্ষতি হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ওরা নিজেদের শহর, শহরের ইতিহাস, নিজেদের সংস্কৃতি সম্পর্কে এতটাই ডেডিকেটেড, এতটাই আত্মমর্যাদাজ্ঞান সম্পন্ন যে পর্যটকদের বেড়াতে নিয়ে যেতে তাদের অন্য কারও সাহায্যের দরকার হয় না। হাতের চেটোর মতো করে তারা নিজেদের শহরকে চেনে। ইচ্ছে রইল ইউরোপে বার বার ফিরে আসার।