ইদানীং আমার কোনও নিমন্ত্রণ বাড়ি যেতে ভালো লাগে না। সব বিষয় ভালোলাগার বোধহয় একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। সেই সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেই বিষয়গুলো অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। চল্লিশ বছরের দোরগোড়ায় এসে আর আড্ডা হই-হুল্লোড় সবই কেমন যেন ফ্যাকাশে লাগে। আমার সঙ্গে বড়োই বেমানান যেন এগুলো। এই কারণে গত দশ বছরে আমার বিরুদ্ধে দুটো দল তৈরি হয়েছে। এক দল হল আমার গুটিকয়েক আত্মীয়স্বজন। অপর দল হল আমার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব।

প্রথম দলের মুখে আমার বিরুদ্ধে শুনেই থাকবেন যে, আমি নাকি বড়োই অসামাজিক বা আনসোশ্যাল। এই অভিযোগের বিরুদ্ধে আমার অবশ্য কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। এর কারণ আমার তর্ক-বিতর্ক করতে ভালো লাগে না। তাই আমি নির্বিকার।

দ্বিতীয় দলের আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ এই যে, আমার প্রেমিকা আমার জীবন থেকে চলে যাবার পর এই দুরবস্থা। দেবদাসের মতো হাল আমার। আমার শূন্য জীবন আর কোনওদিন পূর্ণ হবে না এই বিশ্বাস তাদের। দ্বিতীয় দল অর্থাৎ ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের এই কথার উত্তর দেওয়াই যায়।

গত দশ বছরের আমি, আর এখনকার আমি-র মধ্যে অনেক তফাত। আমার ছন্নছাড়া জীবন থেকে, বেহিসেবি আদর অগ্রাহ্য করে প্রেমিকা যেদিন বারো বছরের সযত্নে লালিত ভালোবাসার সম্পর্ক থেকে মুক্ত হয়ে, আমায় মুক্ত করে চলে যায়- সেদিনের পর থেকে ভাগ্যদেবী আমার উপর সুপ্রসন্ন হন।

আমার জীবনে সাফল্যের গাড়িটা বেশ স্পিডেই চলতে থাকে। ব্যাংক ম্যানেজারের চাকরি, কলকাতায় ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট, বত্রিশ বছর বয়সেই লেখক হিসাবে বিপুল জনপ্রিয়তা, চারচাকা গাড়ি– এই সবই আমার সাফল্যের ইঙ্গিতবাহী। শূন্য জীবন বলতে আমার বন্ধুবান্ধব যদি একাকিত্বকে খোঁটা দেয়, তাহলে বলতেই হয় ব্যস্ত জীবনে সে পূর্ণতার এই মুহূর্তে আমার বিশেষ প্রয়োজন নেই। শৃঙ্খলহীন জীবনের স্বাদ আমি পেয়েছি। দশ বছর ধরে নতুন স্বাদে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি।

যাইহোক আজ নিমন্ত্রণ রক্ষাটা আমার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নিমন্ত্রণ নিয়ে পূর্বে আমার ভালো-মন্দ যাই অনুভতি থাকুক না কেন, সেটা এখানে ঠিক প্রযোজ্য নয়। আমার বন্ধুর তালিকায় চার বছর হল একটি নতুন বন্ধু নাম লিখিয়েছে। আমার উপস্থিতি বন্ধুটির কাছে যত না বন্ধু হিসাবে, তার চেয়ে ঢের বেশি জীবনদাতা হিসাবে। আমার কৃপায় জীবন লাভকারী বন্ধুটির নাম বিপুল মিত্র।

 

আমি আর আমার এক বন্ধু চার বছর আগে উত্তরাখণ্ড বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমাদের দেরাদুন যাওয়ারও কথা ছিল। চার দিনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গা ঘোরা আমাদের শেষ হয়েছিল। যেদিন আমাদের উত্তরাখণ্ড থেকে ফিরে যাবার কথা, সেদিন তুমুল বৃষ্টিতে ভযংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হই আমরা।

আমি এবং আমার বন্ধু যমুনোত্রী থেকে সতেরো-আঠারো কিলোমিটার দূরে হনুমানচট্টিতে ছিলাম। পাঁচদিনের লাগাতার বৃষ্টিতে প্রবল ধ্বস, ভযংকর প্লাবন হয় উত্তরাখণ্ডে। এই বিপর্যয়ে প্রায় সব রাস্তাই বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমরাও অন্য সকলের মতো আটকে পড়ি হনুমানচট্টিতে। ছয়দিনের দিন বৃষ্টি কমলে আমার বন্ধু খাবারের সন্ধানে ঘরের বাইরে বেরিয়ে খবর পায় যে, হনুমানচট্টি থেকে ত্রিশ-বত্রিশ কিলোমিটার দূরে বারকোট থেকে কিছু গাড়ি যাবার অনুমতি মিলেছে। ত্রিশ-বত্রিশ কিলোমিটার হেঁটে যদি আমরা সেখানে পৌঁছোতে পারি তাহলে একটা সুরাহা হবে।

আমি ভাবলাম যে এই একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এখান থেকে বেরোতে হবে। মেঘের অবস্থা ভালো নয়। বৃষ্টি থেমেছে ঠিকই। কিন্তু যে-কোনও মুহূর্তে আবার নামতে পারে। আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে বারকোট যাবার উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম। প্রাণের দায়ে নিরলস যাত্রা শুরু করলাম আমরা। সংকীর্ণ চড়াই-উতরাই পথ। ধ্বস নামার ফলে রাস্তার বিপজ্জনক অবস্থা। যে-কোনও মুহূর্তে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। রাস্তা থেকে পা হড়কে পড়লে সোজা ভয়ানক সুন্দরী যমুনার জলে সলিল-সমাধি হয়ে যেতেই পারে। কারণ রাস্তা থেকে দেড়শ ফুট নীচে উদ্দাম খরস্রোতে বইছে যমুনা। উন্মত্তপ্রায় রূপ তার বৃষ্টির জলে ফুলে ফেঁপে।

আমার বন্ধুর সঙ্গে আমি সন্তর্পণে প্রায় পনেরো কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে এলাম। আমরা সেখানে এসে যা দেখলাম, তাতে টাগরা শুকিয়ে এল। মূল রাস্তা (যে রাস্তায় আমরা হাঁটছিলাম) ধসের ফলে কমপক্ষে এক কিলোমিটার ভেঙে যমুনার জলে মিশেছে। নীচে মুখ বাড়িয়ে দেখলাম দেড়শো ফুট তলায় রাস্তা ভাঙার নুড়ি-পাথর-বালি ইত্যাদি পড়ে যমুনার উপর নরম একটা পথ তৈরি হয়েছে। ওই পথ ধরে এক কিলোমিটার হেঁটে আবার দেড়শ ফুট খাড়াই পথ উঠে মূল রাস্তায় পৌঁছোতে হবে আমাদের।

অন্য সকলের দেখাদেখি আমি নীচে নামতে শুরু করলাম। আমার রোগা শরীরকে নিয়ে আমি নুড়ি-পাথরের গায়ে হালকা চাপ দিয়ে নীচে নেমে এলাম। যমুনার জলের গর্জন আমার কানে এল। দু-একটা জলের স্রোত এসে লাগল আমার পায়ে আমার বন্ধু উপর থেকে লাগেজগুলো নীচে ফেলে দিল। আমি কোনওরকমে লাগেজগুলো পা দিয়ে আটকালাম। ভারী লাগেজ নিয়ে তার পক্ষে নামা কোনও ভাবেই সম্ভব ছিল না। বন্ধুও ধীরে ধীরে নেমে এল।

বন্ধুর ঠিক পেছনেই একটি গোলগাল, মোটাসোটা লোক নামছিল। অনেকটা ঢালু রাস্তা সে পেরিয়ে এসেছিল। তিন ফুটের মতো তার নামতে বাকি ছিল। এমন সময় নীচে প্রবহমান যমুনাকে দেখতে গিয়ে পা হড়কে তার শরীরের অর্ধেকাংশ পড়ল যমুনার জলে। যমুনার স্রোতে লোকটি তলিয়ে যাচ্ছিল। সে হেল্প হেল্প বলে
চিৎকার করায়, আমি আমার প্রাণপণ শক্তি দিয়ে তাকে উদ্ধার করি। উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হই না, বাকি রাস্তাও তার খেয়াল রাখি। লোকটি আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। আমার সেই নতুন বন্ধু বিপুল মিত্র।

আজ বিপুল মিত্রের বাড়িতে তার বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আমার নিমন্ত্রণ। সল্টলেকে বিপুল মিত্রের বাড়ি। আমার ফ্ল্যাট আবার সাউথ সিটিতে। বিপুল পেশায় উকিল। নামজাদা উকিল এবং ডাক্তারদের নাকি কোনও সময় থাকে না। আমি একথা বহুকাল আগে শুনেছিলাম। কিন্তু বিপুলের তো নাম ও সময় দুই-ই আছে দেখছি! তাই এই বয়সেও আমোদ-আহ্লাদ সে করতে পারে। আমার থেকে বিপুল বয়সে কমপক্ষে সাত-আট বছরের বড়ো হবেই।

আমার তো বিপুলের মতো সৌভাগ্য নেই। সারা দিন-রাত কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত থাকি। কাজের চাপে অবসর যেটুকু পাই সেটুকু সময় আমোদ-আহ্লাদ আর পোষায় না। বিপুলের বাড়ি যাবার তাড়ায় বিকাল থেকে সমস্ত কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত করেছি।

বিবাহবার্ষিকীর পার্টিতে যাবার জন্য জমকালো সাজে আমি নিজেকে সুসজ্জিত করলাম। সাদা শার্ট, নীল ব্লেজারে আমি আমার নরম শরীরকে বন্দি করলাম। টাকাপয়সা হওয়ায় আমার চেহারায় পূর্বের দৈন্যদশা নেই। বরং স্লিম শরীরে বেশ একটা জৌলুস আছে। গায়ের রং ফরসা। উচ্চতা ভালো। এই সব মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে নায়কদের থেকে আমি কোনও অংশে কম নই অভিনয়-গুণ ছাড়া! আমি নিজে ভালো ড্রাইভিং জানা সত্ত্বেও স্টেটাস মেইনটেন করতে ড্রাইভার সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে করে সন্ধ্যায় হাজির হলাম বিপুলের ডাকে।

আমি যখন পৌঁছোলাম পার্টিতে বিপুলের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব আসতে শুরু করেছে। আমি ভিতরে ঢুকতেই একটা উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম। বিপুল ওর বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। ব্যাংক ম্যানেজার হিসাবে কেউ এখানে না চিনলেও, লেখক হিসাবে আমাকে অনেকেই চেনে দেখলাম। ফলে কিছু সই খরচ করতেই হল। আমার বুকের ছাতিটা গর্বে একটু চওড়াই মনে হল! বিপুলের কিছু আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও আলাপ হল।

এর পর বিপুল আমাকে নিয়ে গেল বিবাহবার্ষিকী অনুষ্ঠানের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে যে রয়েছে, তার সঙ্গে আলাপ করাতে। সে হল বিপুলের স্ত্রী। বিপুল তার স্ত্রীর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আমাকে বলল আমার বন্ধু সুনন্দ সেন। হি ইজ অ্যা পপুলার রাইটার। বিপুল আমাদের দুজনকে কথা বলতে বলে অন্যদিকে চলে গেল।

দীপান্বিতাকে সৌজন্যবশত আমি মুখ নীচু করেই বললাম নমস্কার।

দীপান্বিতা নরম গলায় বলল, বিপুলকে উত্তরাখণ্ডে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ। আমি শুনেছি সব।

আমি বললাম এটা তো আমার কর্তব্য। যদি মানুষ হয়ে মানুষের উপকার না করি তাহলে কীসের মানুষ! বিপুলের জায়গায় যে-কেউ থাকলে আমি একই কাজ করতাম।

বিপুল আমার আর দীপান্বিতার কথার মাঝে এসে বলল সত্যিই তুমি আমার জীবনদাতা। দীপান্বিতাকে বিপুল বলল দেখো, স্পেশাল খাতির কোরো।

কথাটা শেষ করে এই প্রথম আমি দীপান্বিতার দিকে তাকালাম। বহু পরিচিত এক মুখ। তবু কেমন যেন অচেনা। দীপান্বিতা অপূর্ব সুন্দরী, শিক্ষিতা। দুধের মতো গায়ে রং। মাঝারি উচ্চতা। দামি লাল গাউনে পরির মতো লাগছিল দীপান্বিতাকে। যত সুন্দরী মেয়েই হোক না কেন, মেক-আপ ছাড়া সাজ বোধহয় মেয়েদের ধাতে নেই। দীপান্বিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। কমপ্যাক্ট, ব্লাশার, আই লাইনার, মাসকারা এসব কৃত্রিম উপাদানের সাহায্যে সে নিজেকে আরও মোহময়ী করে তুলেছে। নিশ্চয়ই শহরের কোনও নামি বিউটিশিয়ান তাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে এই বিশেষ দিনটিতে। বাদামি রঙের ঘন স্ট্রেট চুল পিঠ ছুঁয়ে শেষ হয়েছে। এই কৃতিত্বও বোধ হয় বিউটিশিয়ানের।

দীপান্বিতা বিপুলকে বলল তুমি কোনও চিন্তা কোরো না। উনি কেন, এখানে আমন্ত্রিত কোনও ব্যক্তির যত্নের কোনও ত্রুটি হবে না। আমি ভাবলাম যে আমি এবং অন্য আমন্ত্রিত অতিথি দীপান্বিতার কাছে আজ এক! হয়তো এই মুহূর্তে তাই। পূর্বের কথা বাদ রেখে ওর তো এটা মনে করা উচিত ছিল যে আমি তার স্বামীর জীবনদাতা। দীপান্বিতার মনুষ্যত্বের উপরেও কি মেক-আপ পড়েছে! সময় তার সত্তায় হয়তো স্তরে স্তরে মেক-আপের দ্বারা সরল মানসিকতাকে চাপা দিয়েছে। রং মেখে ভালোই অভিনয়ে মেতেছে দীপান্বিতা।

আমিও কিছু কম যাই না। দীপান্বিতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় না করতে পারি, ওর কথার উত্তরে কথা চালিয়ে যেতেই পারি। নায়কোচিত চেহারা আমার, আগেই বলেছি। আমি সহাস্যে বিপুলকে বললাম এত বড়ো আয়োজন করেছ তুমি। ত্রুটির কথা ভাবছ কেন! আর তাছাড়া আমি তো নিজের লোকের মতো।

দীপান্বিতা চুপ করে বসেছিল এতক্ষণ। আমার কথা ঘুরিয়ে দিয়ে সে বলল কেমন আছেন আপনি?

দীপান্বিতার এই কথাটা যেন তিরের ফলার মতো বিঁধল আমার বুকে। আপনি সম্বোধনটাও বড়ো ভারী লাগে বইতে। দীপান্বিতা আমায় এতদিন পর আপনি সম্বোধনে জর্জরিত করবে ভাবিনি। আমি পাতলা হেসে উত্তর দিলাম ভালো। বেশ ভালো।

দীপান্বিতা ঠোঁট উলটে বলল তা শুনলাম আজকাল আপনি সাউথ সিটিতে থাকছেন।

আমি বললাম হ্যাঁ, ওখানে একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি।

দীপান্বিতা কেমন যেন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল ওয়াইফ জোটেনি বুঝি? আপনার ঘর, সংসার আর কি!

এই কথাটা আমাকে আঘাত দিল। সত্যিই তো আমি একা। ছেলেদের বোধ হয় মেক-আপ ঠিক সহ্য হয় না। দীপান্বিতার মতো আমি যদি মেক-আপ দিয়ে আমার অতীতকে ঢেকে দিতে পারতাম, তাহলে এই বর্তমানটা কত ভালো হতো। তা আর পারলাম কোথায়! আঘাতের পর আঘাত হয়তো আমার জন্য পড়ে আছে এই দিনে। আমি নীচু গলায় বললাম আমি একা। একা থাকতেই পছন্দ করি।

আমার কথায় বিপুল হেসে বলল একা থাকা ভালো। স্বাধীনতাটাকে বড়ো বেশি এনজয় করা যায়। আমি সংক্ষেপে বললাম একদম তাই।

দীপান্বিতা হঠাৎই শশব্যস্ত হয়ে বিপুলকে বলল চলো ওদিকে। এক জায়গায় বসে থাকার সময় আছে আজ! তোমার অন্য সব বন্ধুদের অ্যাটেন্ড করতে হবে তো! কী ভাববে বলো তো তোমার বন্ধুরা! এতটা সময় কেটে গেল। ওরা ভাববে নিমন্ত্রণ করে বিপুল পাত্তাই দিচ্ছে না।

বিপুল আমাকে বলল সুনন্দ, এটা নিজের বাড়ি মনে করে দেখেশুনে নিও। খাবার খেতে শুরু করেছে অনেকেই। তুমিও খেয়ে নিতে পারো। আমরা ওদিকে যাচ্ছি। কিছু প্রয়োজন হলে জানিও। দীপান্বিতা বিপুলের ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে আমার সামনে দিয়ে চলে গেল।

আমার কাছ থেকে দীপান্বিতা বিদায় নেবার পর আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। বিপুল আমায় প্রয়োজনের কথা জানাতে বলল। দীপান্বিতার দেওয়া এই আঘাতটা আমার খুব প্রয়োজন ছিল। বারো বছরের সম্পর্ক ভাঙার আঘাত আমি সহ্য করে নিয়েছিলাম। কিন্তু দীপান্বিতার এই আঘাতটা অসহনীয় লাগল আমার।

আগে আমি ছিলাম। দীপান্বিতাও ছিল। এখন আমিও আছি। দীপান্বিতাও আছে। শুধু আমার হাতে সুসময় নেই। দীপান্বিতার উপর আমার আজ কোনও অধিকার নেই। দীপান্বিতাকে চাইলেও আজ আমি ছুঁতে পারব না। দূরের নক্ষত্রের মতো সে বিপুলের ঘরে জ্বলছে। দীপান্বিতা আপনি সম্বোধনে আমাকে আমার জায়গাটা আজ বুঝিয়ে দিয়েছে।

দীপান্বিতাকে ঘিরে নানা ভাবনায় আমি নিমজ্জিত ছিলাম। এমন সময় একটি ছেলে ট্রেতে বিদেশি মদ নিয়ে এসে আমায় বলল স্যার, কিছু লাগবে? আমি স্মিত হেসে বললাম লাগবে। অনেকগুলো গ্লাস লাগবে।

ছেলেটি বলল নিন স্যার। ছেলেটিকে দাঁড় করিয়ে আমি এক চুমুকে ছটা গ্লাস এক এক করে শেষ করলাম। ছেলেটি সঙ্কুচিত মুখে বলল স্যার, এটা হার্ড ড্রিংক। এত খেয়ে ফেললেন। অভ্যাস না থাকলে বাড়ি ফিরতে অসুবিধা হবে।

ছেলেটির কথা শুনে ভাবলাম, আমার জীবনে একসময় অনেক কিছুই অভ্যাস ছিল না। আমি নিজে চিরকাল মদকে ঘেন্না করেছি। জীবনে কখনও ছুঁইনি। আজ ছুঁলাম। আমার অতীতকে ধুয়েমুছে সাফ করে দিতে এটার প্রয়োজন ছিল। দীপান্বিতার সঙ্গে কোনও পুরুষকে দেখা আমার অভ্যাস ছিল না। আজ অভ্যেস হল সেটা। মদকে অভ্যাসে পরিণত করতে বোধহয় এত বেশি যন্ত্রণা হবে না। ছেলেটি আমার কাছ থেকে বিদায় নিল।

আমি নতুন অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে খিদে তেষ্টাই ভুলে গেলাম। চলতে গিয়ে পা টলমল করায় আমি বুঝলাম নেশাটা ভালোই হয়েছে। বিপুলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে টলমল পায়ে আমি গাড়ির কাছে পৌঁছোলাম। ড্রাইভার বেচারা আমারই অপেক্ষায় বসে আছে। গাড়িতে ওঠার আগে আমি বিপুলের বাড়ির ঝলমলে আলোর দিকে ঢুলুঢুলু চোখে একবার তাকিয়ে শূন্যের বুকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। আমার ড্রাইভার আমাকে বলল স্যার, উঠুন গাড়িতে। রাত হয়েছে। পৌনে এগারোটা বাজে।

আমার ঘোলাটে দুচোখের কোণে একটু জল এসেছিল। আমি তা নিয়ন্ত্রণ করে গাড়িতে উঠতে যাব এমন সময় কেউ একটা সাদা হাত এগিয়ে দিয়ে বলল এক্সকিউজ মি। ওয়ান অটোগ্রাফ প্লিজ। আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম দীপান্বিতা মিত্র, বিপুল মিত্রের সুন্দরী স্ত্রী। আমি বুক পকেট থেকে আমার কম দামি পেন বার করে দীপান্বিতার দামি নরম হাতের তালুতে কোনওরকমে নিজের নামটা লিখলাম সুনন্দ সেন। আমার পেন সার্থক হল দীপান্বিতার স্পর্শ পেয়ে।

আমাকে দীপান্বিতা বলল মদ খাওয়া তোমার অভ্যাস ছিল না। ইদানীং নামযশ করে স্ট্যাটাস বজায় রাখতে খাচ্ছ বুঝি! এটাকে অভ্যাস করে ফেলো না যেন। ভালো জিনিস তো নয়। আমি মুখ নীচু করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।

দীপান্বিতার মুখ থেকে বহুদিন পর তুমি সম্বোধনে, ওর কাছে আসায় আমার নেশা কিছুটা কেটে গিয়েছিল। আমি অভিমানী গলায় বললাম সময় বদলালে মানুষও বদলায়। কাকে অভ্যাসে রাখব কাকে অবকাশে, তা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

দীপান্বিতা আমার কথা শেষ হতেই ঝড়ের বেগে অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার গালে চুমু খেল। হালকা আলো-আঁধারি পরিবেশে ওর মুখে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠে মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। তারপর ও ছুটতে ছুটতে আলোর ভিড়ে কোথায় হারিয়ে গেল। আমার গালে এত বছর পর দীপান্বিতার দেওয়া লাল লিপস্টিকের ছাপটা চিরস্থায়ী ক্ষতর মতো রয়ে গেল। সেই অলিখিত মুহূর্তের সাক্ষী একমাত্র আমার বিশ্বস্ত ড্রাইভার। আঘাতের পর আঘাত, ক্ষতর উপর ক্ষত নিয়ে আমি গাড়িতে উঠলাম!

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...