বিকাশের কথাতে জোরে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন আইসি দেব, এগজ্যাক্টলি… আমিও ঠিক এই অ্যাঙ্গেলটাই ধরতে চেয়েছি। তুমি ওই কেসের পুরো ডিটেলসটা জোগাড় করো। তবে শান্তার কল রেকর্ডের ব্যাপারে আগেই কিছু বলতে যেও না। ওটা সিক্রেট ইস্যু। খুব প্রয়োজন ছাড়া ফাঁস করা যাবে না। খুনি অ্যালার্ট হয়ে যাবে।
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার।
এবার সাহাবাবুর দিকে তাকিয়ে আইসি দেব বললেন, দেবদূতের ব্যাপারে কিছু ইনফর্মেশন পাওয়া গেল সাহাবাবু?
উত্তম সাহা বললেন, তেমন ব্রেকিং নিউজ কিছু নেই স্যার। ছেলেটা নেহাতই সাদামাটা। শরীর চর্চা আর দোকানদারি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একটা নন বেঙ্গলি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। এই নিয়ে বাড়িতে মাঝেমধ্যেই অশান্তি হয়। তবে একটা ব্যাপারে একটু খটকা আছে…
কী ব্যাপারে?
দেবদূত মাঝে মাঝে হাওড়ার একটা নিষিদ্ধ পল্লিতে যায়। ওখানে মুকেশ কুমার নামে একজনের সাথে খুব দোস্তি। মুকেশ কুমার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তাতে ছেলেটা খতরনাক গুন্ডা। খুন, জখম, রাহাজানি, ধর্ষণ, সুপারি কিলিং… এসবই ওর পেশা। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে, ওই রকম একটা ছেলের সাথে দেবদূতের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? কিন্তু এবিষয়ে সঠিক কোনও তথ্য এখনও পাইনি।
লেগে থাকুন। আপাত দৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলেও কোনও বিষয়কেই নেগলেক্ট করা যাবে না। কোথায় যে এই রহস্যের টিকি বাঁধা আছে আমরা কেউ জানি না। সুমিত সেন সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন?
যেটুকু পেয়েছি বলছি। ওর আদি বাড়ি কৃষ্ণনগর। বনেদি পরিবার। বাবা কাকারা সব একসাথেই থাকেন, যৌথ পরিবার। অনেক রকমের ব্যাবসা আছে। সুমিত সেন পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর দুবছর বিদেশে চাকরি করেন। তারপর চলে আসেন কলকাতায়। পড়ার সময়ে শান্তার সাথে প্রেম। বিদেশ থেকে ফিরেই বিয়ে করেন দুজনে। আগে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। রিসেন্টলি ফ্ল্যাট নিয়েছেন বালিগঞ্জে। বন্ধু-বান্ধব মহলে ভালো ছেলে বলেই পরিচিত। পরকিয়ার গল্পটা সম্পূর্ণ বানানো, এমনই তার মত। শান্তা মার্ডারের সাথে সুমিতের কোনও প্রত্যক্ষ যোগ নেই বলেই মনে হচ্ছে স্যার।
হাসলেন আইসি দেব, মঞ্চে নাটক শো হয় সাহাবাবু। কিন্তু নাটক যিনি নির্মাণ করেন তিনি থাকেন পর্দার আড়ালে। কলাকুশলীরা তার হাতের পুতুল মাত্র। আপনি সুমিতের ফোন চেক করুন। আমরা জানি পারফেক্ট মার্ডার বলে কিছু হয় না। কিছু না কিছু খুঁত থাকেই। সেটাই খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। কাজটা অত সহজ নয়।
ঠিক আছে স্যার।
আইসি দেব এবার ঘুরলেন পলাশ মিত্রের দিকে, আশেপাশের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছিলে মিত্র? সেরকম কোনও খবর পাওয়া গেল?
না স্যার। একে বর্ষার রাত ছিল, তার ওপর সবাই ঘরবন্দি। কেউ কিছুই জানে না, কেউ কিছুই দেখেনি। শুনে ওরাই অবাক। আমাকেই প্রশ্ন করতে শুরু করল, কীভাবে হল স্যার? কে খুন করল স্যার? ইত্যাদি ইত্যাদি। ওই বাড়ির গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী সম্পর্কে লোকের ধারণা ভালোই। নির্বিবাদী, সাতে-পাঁচে থাকেন না। নির্ঝঞ্ঝাট অবসর জীবনযাপন করেন।
ওদের সাথে কথা বলেছ তুমি?
হ্যাঁ স্যার। ভীষণ ভয় পেয়েছেন দুজনেই। আপাতত দেবদূতদের বাড়িতেই আছেন। নিজেদের বাড়িতে যেতে ভয় পাচ্ছেন।
ওদের সন্তানরা বিদেশে থাকে দেবদূতের মুখেই শুনেছি। কী করে তারা?
দুজনেই সুপ্রতিষ্ঠিত। একজন ডাক্তার, অন্যজন ইঞ্জিনিয়ার। বড়ো ধৃতিমান থাকে জার্মানিতে, ছোটো ধীরাজ থাকে সুইডেনে। এই ধীরাজের সাথে খুব সামান্য হলেও একটা লিঙ্ক রয়েছে শান্তা কুলকার্নি ও সুমিত সেনের।
ভ্রু সামান্য বাঁকা হল আইসি দেবের, কী রকম?
দেবদূতের মেসোমশাই ধীমান তালুকদারই আমাকে একটা পুরানো গ্রুপ ফটো এনে দেখালেন। দেখিয়ে বললেন, যে-মেয়েটি খুন হয়েছে সে আমার ছেলে ধীরাজের সাথে পড়াশোনা করত। একই কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। ধীরাজের মুখে নামটা বহুবার শুনেছেন। তাই তাঁর সন্দেহ হয়, দুটো একই মেয়ে নয়তো? নিজের কৌতূহলেই শান্তার এখনকার ছবি আর পুরোনো ছবি মিলিয়ে দেখেন। দেখে অবাক হয়ে যান! আমাকেও দেখালেন। ওই ছবিতে সুমিত সেনও আছেন।
আশ্চর্য সংযোগ তো! যদিও এতে কিছুই প্রমাণিত হয় না। তবুও কেমন জানি একটা রহস্যের ধোঁয়া উঠছে যেন। আর ধোঁয়া দেখলে স্বাভাবিক ভাবে যেটা মনে আসে, ধোঁয়া যখন আছে তখন আগুনের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। তাই না?
দারুণ বললেন স্যার। আমার মনেও ঠিক তেমনই অনুভূতি হয়েছিল। ওনাকে নানা ভাবে প্রশ্ন করেছিলাম, যদি কোনও ক্লু পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুই পাইনি। নেহাতই একটা কাকতালীয় সংযোগ। পাশ করার পর ওরা যে-যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। তারপরে আর কোনও দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।
তুমি ওনাকে জিজ্ঞেস করোনি, শান্তার নামটা ধীরাজের মুখে কীভাবে শুনেছিলেন?
করেছিলাম স্যার। শান্তা ওদের ব্যাচে টপার ছিল। অসাধারণ মেধাবী। তাই ধীরাজের মুখেও উঠে আসত ওর মেধার কথা। তখনই জেনেছিলেন শান্তার কথা। সেই শান্তা এভাবে তাঁরই বাড়িতে খুন হয়েছে, বিশ্বাসই করতে পারছেন না ভদ্রলোক।
স্বাভাবিক। শান্তা সম্পর্কে আর কিছু জানেন উনি?
না স্যার।
তুমি ধীরাজের ফোন নম্বর কালেক্ট করে রেখো। দরকার হতে পারে।
করেছি স্যার। এটা আমারও মনে হয়েছিল। তাই তখনই নিয়ে সেভ করে রেখেছি আমার মোবাইলে।
গুড। আর কোনও খবর আছে তোমার কাছে?
ওই বাড়িতে পরের দিন সকালে তল্লাশি চালাতে গিয়ে আর একটা জিনিস পেয়েছিলাম স্যার, সেটা বলাই হয়নি। একটা রক্তমাখা গ্লাভস। বাড়ির সামনের লনে একটা গাছের মধ্যে আটকে ছিল। বৃষ্টির জলে বেশির ভাগ ধুয়ে গেলেও কিছুটা রক্ত তখনও লেগে ছিল।
তিন জনেই একসাথে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকালেন পলাশ মিত্রের দিকে। আইসি দেব বেশ উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, সেটা তুমি আজ বলছ? গ্লাভসটা এখন কোথায়?
বিকাশ বলল, ফরেনসিকের লোকেরা দেখেছেন? ওটা কিন্তু আমাদের একটা দারুণ কাজের সূত্র হতে পারত মিত্রদা।
পলাশ মিত্র দুজনকেই আস্বস্ত করে বললেন, গ্লাভসটা আমি ওদের হাতেই দিয়েছি। নানা ব্যস্ততায় বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আই অ্যাম সরি।
আইসি দেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তবুও বাঁচোয়া, ফেলে-টেলে দাওনি।
পলাশ মিত্র হেসে বললেন, কী যে বলেন স্যার। সাত বছর হয়ে গেল পুলিশে। কোনটা দরকারি আর কোনটা অকেজো এখন বুঝতে পারি।
আমি সেটা মিন করিনি মিত্র। তুমিও জানো একটা সামান্য এভিডেন্সও আমাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় কখনও কখনও। তাই ভয় পেয়েছিলাম! যাকগে, রক্তমাখা গ্লাভস ওখানে এল কী করে? খুন হয়েছে বিষ প্রয়োগে, রক্তারক্তি তো কিছু হয়নি।
উত্তম সাহা বললেন, এটা আবার কোন রহস্য! ভীষণ কনফিউজিং ম্যাটার। ও বাড়িতে ঠিক কী হয়েছিল সত্যি বলা মুশকিল।
বিকাশ মজা করে বলল, এমনও তো হতে পারে সাহাবাবু, কনফিউজ করার জন্যই এই কনফিউজিং ম্যাটার তৈরি করা হয়েছে। এর আগেও আমরা অনেক কেসে দেখেছি, খুব হোম ওয়ার্ক করে-টরে যারা ক্রাইম করে, তাদের একটা টার্গেট থাকে পুলিশকে মিসগাইড করা।
আইসি দেব বললেন, বিকাশ কথাটা খারাপ বলেনি সাহাবাবু। কোনও রক্তপাত হয়নি, অথচ রক্তমাখা গ্লাভস। একটা কাল্পনিক রহস্য তৈরি করে দেওয়ার পক্ষে কিন্তু ব্যাপারটা খারাপ নয়। আসলটাকে ছেড়ে নকলটাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে বাধ্য করানো। একটা ইলিউশন তৈরি করে দেওয়া। তাই যদি হয় তবে মানতেই হবে, হি অর শি ইজ আ স্মার্ট গাই।
শি? আপনি কি মনে করেন কোনও মহিলাও খুনি হতে পারে? উত্তম সাহা অবাক হয়ে বললেন।
হোয়াই নট। নাথিং ইজ ইম্পসিবল। খুনি যে পুরুষই আপনি জানেন?
চুপ করে গেলেন উত্তম সাহা।
আইসি দেব চিন্তিত মুখে বললেন, আরও একটা ব্যাপার হতে পারে। কোনও ভাবে তার নিজের শরীরের কোথাও কেটে যায়। তাড়াহুড়োতে মুছতে গিয়ে রক্ত লাগিয়ে ফেলে গ্লাভসে। অসতর্ক মুহূর্তে সেটা ছুড়ে ফেলে বাগানের মধ্যে।
বিকাশ বলল, সম্ভবনার দিক থেকে বিচার করলে হতেই পারে। কিন্তু একজন শার্প খুনি এরকম রিস্ক নেবে বলে আপনার মনে হয়?
হিসেব মতো নেওয়ার কথা নয়। কিন্তু সবকিছু তো সবসময় হিসেব মতো চলে না। পরিবেশ পরিস্থিতি যে সবসময় তাকে সাপোর্ট করবে, এমন তো কথা নেই। হয়তো সে করতে বাধ্য হয়েছিল। গ্লাভসটা ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও উপায় ছিল না। কারণ আমরা রাতে দুজন কনস্টেবলকে ওই বাড়িতে পাহারায় বসিয়ে রেখে এসেছিলাম।
আপনার কথাতেও যুক্তি আছে। কোনটা ঠিক, সময়ই বলবে। তবে একটা কথা পরিষ্কার যে, শান্তা মারা যাবার পর ওই বাড়িতে কেউ একজন অবশ্যই ঢুকেছিল, অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পূর্ণ করার জন্য। যেমন, লাইট নেভানো, প্রমাণ লোপাট ইত্যাদি ফাইনাল টাচ দেওয়ার জন্য।
উত্তম সাহা বললেন, সব মিলিয়ে সামারিটা দাঁড়াল এরকম, আপাতত আমরা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে চলেছি, কোনও আলোর কিরণের আশা নিয়ে৷ সেরকম জোরালো কিছু আমাদের হাতে নেই যেটা ধরে বলতে পারি কেস সলভ হবেই। তাই তো?
আইসি দেব বললেন, আমি চিরকালই চুড়ান্ত অপটিমিস্ট। চেষ্টা জারি রাখলে কোনও না কোনও সূত্র ঠিক পেয়ে যাব। তবে এই কেসের নেচারটা একটু অন্যরকম। অনেক বেশি ছড়ানো বলেই মনে হচ্ছে। আর কে না জানে, যে-জিনিস যত বেশি ছড়ানো, তাকে গোটানো তত বেশি কঠিন। তাই টিম ওয়ার্ক ভালো হতেই হবে। একা একা জাল গোটানো যাবে না।
মিত্র বললেন, আমরা সবাই আপনার সাথে আছি স্যার। আমরা আমাদের ডিউটি মনপ্রাণ দিয়ে পালন করব।
ঠিক আছে এখন আপনারা আসুন। যার যে দায়িত্ব আছে সেটা ফলো করুন। টাইম টু টাইম আমাকে রিপোর্ট করুন। আবারও বলছি, কোনও ছোটোখাটো বিষয়ও যেন এড়িয়ে না যায়। ইজ ইট ক্লিয়ার?
চার
এবার ঠিক দশ দিনের মাথায়। বেহালার একটা নির্জন বাড়িতে। তিনতলা বাড়ির নীচের তলার ফ্ল্যাটে, যে-ভদ্রলোক ফ্যামিলি নিয়ে ভাড়া থাকেন, তিনি ফ্যামিলি সমেত কয়েক দিনের জন্য কল্যাণীতে গিয়েছেন। মাঝের তলাতে আপাতত কেউ থাকেন না। তিনতলায় বাড়ির মালিক বয়স্ক বিধবা মহিলা বলতে গেলে একাই থাকেন। ছেলেমেযেরা বাইরে থাকে, মাঝে মাঝে এসে দেখে যায়। রাতে আলো দেখে উনি ভেবেছিলেন ওরা হয়তো ফিরে এসেছে। কিন্তু সকালে ডেকেও ওদের সাড়া না পেয়ে সন্দেহ হয়। ভেজানো দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখেন বেডরুমে পড়ে রয়েছে একটি মেয়ের লাশ। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দেন। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, বিষ প্রয়োগে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে।
খবরটা মন দিয়ে পড়ছিল রক্তিম। রক্তিম বিশ্বাস। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। ক্রাইম সংক্রান্ত যত ছোটো খবরই হোক, মন দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে রক্তিম। সেরকম মনে হলে পেপার কাটিং ফাইলবন্দি করে রেখে দেয়। আজকের খবরটা পড়েই নড়েচড়ে বসল রক্তিম। একই পদ্ধতিতে তিন তিনটে খুন! প্রায় চোখের সামনেই ঘটে যাচ্ছে খুনগুলো। ফাইল থেকে পুরোনো দুটো পেপার কাটিং বের করে আনল। প্রথমটা সল্টলেক, দ্বিতীয়টা পদ্মপুকুর, তৃতীয়টা বেহালা। তিনটে ক্ষেত্রেই ভিকটিম বাড়ি থেকে দূরে কোথাও গিয়ে খুন হয়েছে। তিনটেই ছিল দুর্যোগের রাত। একমাত্র পদ্মপুকুরের ঘটনাটিকে লোকাল থানার আইসি আত্মহত্যার ঘটনা বলেছেন। কিন্তু ওই যুক্তি খাটে না। প্রথম দুটো খবর ছোটো করে ছাপলেও আজকের খবর বেশ বড়ো করে ছেপেছে কয়েকটি সংবাদপত্র। অর্থাৎ মিডিয়াও সচকিত হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু পুলিশ এখনও সিরিয়াসলি নিচ্ছে না কেন ব্যাপারটা?
রক্তিমের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল। তবে কি কলকাতার বুকে কোনও সিরিয়াল কিলিং শুরু হয়ে গিয়েছে? বেছে বেছে অল্পবয়স্ক বিবাহিত মেয়েদেরকে নিশানা করছে এই কিলার ! কিন্তু কেন? নিঃসন্দেহে খবরটা ভয়ের। কে জানে, খুনি হয়তো এরমধ্যেই তার নেক্সট টার্গেট ঠিক করে ফেলেছে! সে কথা ভাবতেই রক্তিমের মাথার মধ্যে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হল। আপন মনেই বিড়বিড় করে বলে উঠল, আই হেট ক্রাইম। আই হেট ক্রিমিনালস। আই হ্যাভ টু স্টপ দিস ডেডলি গেম।
ডেডলি গেম! কথাটা উচ্চারণ করে নিজেই অবাক হল রক্তিম। পরক্ষণেই একটা বাঁকা হাসি খেলে গেল ঠোঁটের কোণে। কিছু লোকের কাছে মানুষ-হত্যাটাও একটা খেলা! যে-খেলা খেলে, তারা বিকৃত আনন্দ উপভোগ করে। এরকম একটা মানুষ এখনও খোলা আকাশের নীচে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্যমনস্ক ভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করল রক্তিম। ঠিক তক্ষুণি চেনা সুরে বেজে উঠল ওর মুঠো ফোন। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভীষণ অবাক হল। এর নামই কি টেলিপ্যাথি! মনে মনে এরকম একজনের ফোনই কি আশা করেছিল সে? গৌতম চ্যাটার্জীর ফোন, ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশ। ফোন ধরে সহাস্যে বলল, নমস্কার গৌতমদা। এতদিন পর এই অধমকে মনে পড়ল?
আরে না না ভাই… নানা কাজের চাপে হয়ে ওঠে না। কিছুটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারো। কত ধরনের প্রেশার নিয়ে কাজ করতে হয় আমাদের। সত্যি কথা বলতে আমরা তো আর যথার্থ শান্তির চাকরি করি না ৷ একটা না একটা ঝুট ঝামেলা লেগেই আছে। আজকের খবরের কাগজ পড়েছ?
রক্তিম হেসে বলল, হ্যাঁ পড়েছি। বুঝতে পারছি আপনি কেন ফোন করেছেন। বেহালার মার্ডার কেস নিয়ে কিছু বলতে চান তো?
ঠিকই ধরেছ। সল্টলেকের ঘটনার তদন্ত করছেন যিনি, তার নাম প্রিয় প্রসাদ দেব। আমার পরিচিত ও কাছের মানুষ। উনি এসেছিলেন একটু আগেই। ভদ্রলোক যা ব্যাখ্যা দিলেন তাতে যথেষ্ট চিন্তার বিষয় রয়েছে। খুন করার টেকনিক অভিনব। ওঁর আশঙ্কা এই খুনি সহজে থামার নয়। কিন্তু না থামাতে পারলে আমাদের বারোটা বেজে যাবে। মিডিয়া, পাবলিক সব যদি একযোগে আক্রমণ শানে, ল অ্যান্ড অর্ডার সামলানো দায় হয়ে যাবে।
ওঁর কথা খুব একটা অমূলক নয়। ইতিমধ্যেই আমার কাছে অনেকগুলো ফোন এসেছে। মিডিয়া, টিভি চ্যানেল ধীরে ধীরে রক্তের স্বাদ পেতে শুরু করেছে। হোম সেক্রেটারি ফোন করেছিলেন কমিশনারকে। এখন জাস্ট ঘটনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এরকম চলতে থাকলে সেটা আর জানতে চাওয়ার পর্যায় থাকবে না। সো ইমিডিয়েটলি আমাদের কিছু করতে হবে।
রক্তিম বলল, আপনাদের গোয়েন্দা বিভাগকে লাগিয়ে দিন। আমার ইন্টারফিয়ারেন্স কি ভালো দেখাবে?
আমাদের সমস্ত উইংসকে অ্যালার্ট করে দেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা বিভাগের একটা স্পেশাল টিমও তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আমি পার্সোনালি চাই তুমি আমাদের সহযোগিতা করো। কারণ তোমার প্রতি আমার আলাদা একটা বিশ্বাস আছে। সেই বিশ্বাসের মর্যাদাও তুমি রেখেছ। আসলে আমি কোনও রকম রিস্ক নিতে চাইছি না। আমি আইসি প্রিয় প্রসাদ বাবুর সাথে তোমার বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। ভদ্রলোক তোমার নাম ভালো করেই জানেন। উনিও বেশ আগ্রহ দেখালেন। তুমি আর না কোরো না।
না করার প্রশ্নই নেই। যেখানে মানুষের জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন জড়িত থাকে সেখানে আমি ইগো দেখি না। আরও কিছু মেয়ের জীবন বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। ওদের রক্ষা করতে পারলে আমার গোয়েন্দা-জীবন সার্থক হবে। আমি আজ থেকেই কাজ শুরু করতে চাই।
দ্যাটস বেটার। আমিও সেটাই চাই। কোথাও কোনও সমস্যা হলে তুমি আমার পার্সোনাল নম্বরে ফোন করবে।
আমি প্রথমেই আইসি দেবের সাথে দেখা করে কেস ডিটেলসটা একটু ভালো করে বুঝে নিতে চাই। আপনি ওঁকে একটু জানিয়ে দিন।
নো প্রবলেম, আমি এক্ষুণি ফোন করে দিচ্ছি। এখন তাহলে রাখছি, পরে আবার কথা হবে।
ফোন রেখে আপন খেয়ালেই বেশ কয়েকবার ঘরের মধ্যে পায়চারি করে ফেলল রক্তিম। এরমধ্যে মা কখন ঘরে ঢুকেছে টেরই পায়নি। চায়ের কাপ টি-টেবিলে রাখতে রাখতে মা বললেন, কী রে নতুন কোনও কেস হাতে এসেছে নিশ্চয়ই ? তোর এই পায়চারি দেখলেই আমি বুঝতে পারি। কেসটা কীসের?
রক্তিম ধরা পড়ার হাসি হাসল। মা তার বন্ধু কাম গাইড। একসময় আইপিএস অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি নানা কারণে। স্বামী অর্থাৎ রক্তিমের বাবা ইন্ডিয়ান আর্মির একজন কর্নেল। কার্গিল যুদ্ধে বীরের মতো প্রাণ দেন। মা একা ওদের দুই ভাই বোনকে মানুষ করেছেন। রক্তিম প্রাইভেট ডিটেকটিভ হতে চাইলে, বাধা দেননি। নতুন কেস এলে মায়ের সাথেই প্রথম ডিসকাশন করে নেয়। সে দেখেছে ভদ্রমহিলার দুর্ধর্ষ আই কিউ। কোন কেসের কোন অ্যাঙ্গেল, কতটা গুরুত্বপূর্ণ এক নিমেষে বুঝে যান। মনে মনে তাই মাকেই নিজের গোয়েন্দাগিরির গুরু মানে রক্তিম।
এ পর্যন্ত যতটা জেনেছে সবটাই খুলে বলল মাকে। সবশেষে যোগ করল, তোমার কী মনে হচ্ছে, কোথা থেকে শুরু করা উচিত আমার?
মা গম্ভীর মুখে বললেন, আমার মনে হয় তোর প্রথম কাজ হওয়া উচিত ভিকটিম তিনটে মেয়ে সম্পর্কে খোঁজ করা। আমার ধারণা ওরাই এই রহস্যের প্রবেশদ্বার। কোনও না কোনও লিঙ্ক ওদের মধ্যে অবশ্যই আছে। আরও একটা জিনিস মনে হচ্ছে জানিস, তবে কতটা সঠিক সময়ই বলবে।
কী?
খুনি কোনও অধিবিদ্যায় পারদর্শী। যা দেখানো হচ্ছে সেটা আসলে মরীচিকা। আসলটা অন্য কিছু।
রক্তিম হেসে বলল, আই মাস্ট বি অ্যালার্ট। আপাতত আমি সল্টলেকে চললাম। দেখি কেসের ডিটেলসটা জোগাড় করতে পারি কিনা। ক’টা দিন খুব চাপে থাকব মনে হচ্ছে। রাত করে খাবার টেবিলে তোমার সাথে বসব।
———-
আইসি দেব সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ডিসিপি স্যার আমাকে সব বলেছেন। ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম মিস্টার বিশ্বাস। আপনার কথা আমি পড়েছি। বলুন কীভাবে আমি সাহায্য করতে পারি।
রক্তিম বলল, পুরো কেস হিস্ট্রিটা আমাকে একবার প্রথম থেকে বলুন। কতটুকু এগোতে পেরেছেন সেটাও বলবেন। ওই দুটো থানা থেকেও আমি শুনব।
বেশ বলছি। তার আগে একটু চায়ের কথা বলে দিই।
ঘন্টাখানেক বাদে থানা থেকে বেরিয়ে এল রক্তিম। আকাশ থমথমে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। একটা ক্যাব বুক করে তাতে উঠে বসল সে। সুমিত সেনের ফ্ল্যাটে যখন পৌঁছোল তখন বৃষ্টির তোড় আর একটু বেড়েছে। কলিংবেল টিপতে দরজা খুললেন সুমিত সেন নিজেই। ছবি দেখেছে, তাই চিনতে অসুবিধা হল না রক্তিমের। পরনে বারমুডা আর আকাশি রঙের হাতকাটা গেঞ্জি। অবাক চোখে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। হু আর ইউ?
আমি রক্তিম বিশ্বাস। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনার ওয়াইফের মৃত্যুর ব্যাপারে দুচারটে কথা বলতে চাই। আইসি দেব নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে বলেছেন আপনাকে।
হ্যাঁ, একটু আগেই ফোন করে বললেন আমি যেন বাড়িতেই থাকি, কোথাও না যাই। আর আমি যেন আপনার সাথে কো-অপারেট করি।
দেখুন সুমিতবাবু আমি আনঅফিসিয়ালি এই কেসে পুলিশকে সহায়তা করছি। তাই বেশি জানাজানি হওয়াটা কাম্য নয়।
হুম… বুঝলাম। আমার কাছে কী জানতে চান?
আপনার ওয়াইফকে যেভাবে খুন করা হয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে কুল ব্রেনের কাজ। কোনও ধুরন্ধর অপরাধীই এতটা অ্যাডভান্স ভাবতে পারে। আপনি কি জানেন গত কয়েক দিনে আরও দুজন মহিলা একই ভাবে খুন হয়েছেন? একজন বেহালায়, অন্যজন পদ্মপুকুরে! কিছু শুনেছেন?
না তো। বলেন কী? এ তো মারাত্মক ব্যাপার !
ঠিকই বলেছেন। ইটস আ ভেরি ভেরি সিরিয়াস ম্যাটার। কোনও ভাবে সিরিয়াল কিলিং-এর ইঙ্গিতও দিচ্ছে। বাকি যে-দুজন মহিলা খুন হয়েছেন, তাদের একজনের নাম তিয়াসা সরকার, অন্যজনের নাম দেবলীনা পাত্র। তিয়াসা একটা বেঙ্গলি মিডিয়াম স্কুলের দিদিমণি। দেবলীনা মডেল। আপনি এই নাম দুটো কখনও শুনেছেন?
না। প্রথম শুনলাম।
আপনার মিসেসের সাথে কোনও কানেকশন?
যতদূর জানি, ছিল না। শান্তার বন্ধু-বান্ধবদের বেশির ভাগকেই আমি চিনি। শান্তা ভীষণ খোলামেলা টাইপের মেয়ে ছিল। আমাকে সব খুলে বলত।
আপনি ধীরাজ তালুকদারকে চেনেন?
জানি না আপনি কোন ধীরাজের কথা বলছেন। ধীরাজ নামে আমাদের এক সহপাঠী ছিল। বেঙ্গালুরুতে একসাথে পড়তাম।
হ্যাঁ, আমি সেই ধীরাজের কথাই বলছি। আপনি কি জানেন শান্তাকে যে-বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়েছে, সেটা ধীরাজদের বাড়ি?
হোয়াট! কিন্তু ধীরাজ তো বহুদিন আগেই বিদেশে চলে গিয়েছে বলেই জানি। আমরা যখন বিদেশে ছিলাম একবার ফেরার সময় দেখাও হয়েছিল। সম্ভবত হিথরো এয়ারপোর্টে। তারপর আর কোনও যোগাযোগ নেই। ও কি ফিরে এসেছে?
না। ওই বাড়িতে ওর বাবা মা থাকেন। কানেকশনটা একটু অদ্ভুত! তাই না?
কীসের কানেকশন? আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না।
আমিও বুঝতে পারিনি। বোঝার চেষ্টা করছি মাত্র। ওটা যদি ধীরাজদের বাড়ি না হয়ে অন্য কোনও বাড়ি হতো, তাহলে প্রশ্নটা উঠত না। এমনও হতে পারে খুনি ইচ্ছে করেই ওই বাড়ি চয়েস করেছিল। ইটস জাস্ট আ প্ল্যান ফর ক্রিয়েংটি আ মিস্ট্রি। একটা পার্সোনাল কোয়েশ্চেন করব কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
ভ্রূ তুলে তাকালেন সুমিত সেন, কী কোয়েশ্চেন?
কখনও কি শান্তার সাথে ধীরাজের কোনও রিলেশন গড়ে উঠেছিল?
খেঁকিয়ে উঠলেন সুমিত, কী যা তা বলছেন? আমার মৃত স্ত্রীকে নিয়ে আপনি এসব কথা বলতে পারেন না। আই থিঙ্ক ইউ ক্রসড ইওর লিমিট।
রক্তিম শান্ত গলায় বলল, সরি মিস্টার সেন। আপনাকে হার্ট করার উদ্দেশ্য আমার নেই। আসলে মার্ডার কেস বলে কথা, সবদিক খতিয়ে দেখতে হয়। আপনি স্বীকার করুন বা না করুন, ব্যাপারটা কি খুব অসম্ভব? যদি এটার কোনও সত্যতা পরবর্তীতে খুঁজে পাই, তাহলে এটুকু বলতে পারি, আপনি অবশ্যই বিপদে পড়বেন। গোয়েন্দা হিসাবে আমার কমিটমেন্ট হল, দরকার পড়লে মাটি খুঁড়ে সত্যটা বের করে আনা। কোনও কিছুই আমাকে আটকাতে পারবে না।
আপনি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন মিঃ ডিটেকটিভ? এসব কী? আপনি কি ধরেই নিয়েছেন আমার স্ত্রীর হত্যাকারী আমি?
রক্তিম হেসে বলল, হুমকি নয়, আমার কমিটমেন্ট। আপনি অতটা রিঅ্যাক্ট করছেন কেন? আমি জাস্ট একটা সম্ভবনার কথা বলেছিলাম। আপনি এমন করছেন যেন ওটাই সত্যি !
থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন সুমিত সেন।
রক্তিম বলল, আপনার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিতে পারব না সুমিতবাবু। তবে তার হত্যাকারীকে অবশ্যই প্রকাশ্যে আনব। আপনি সহযোগিতা করুন বা না-ই করুন।
রক্তিমের শক্ত চোয়ালের দিকে তাকিয়ে সুমিত সেন নরম গলায় বললেন, আই অ্যাম স্যরি। আসলে এই মুহূর্তে আমার মাথার ঠিক নেই। শান্তাকে হয়তো অনেকেই পছন্দ করত। কিন্তু ও কাউকে পাত্তা দিত না। ধীরাজের সাথে কোনও রিলেশন থাকলে আমি ঠিক জানতে পারতাম। এখন একতরফা ভাবে কিছু থাকলে সেটা আমার জানার কথা নয়।
এই কথাগুলো আগেই বলতে পারতেন। যাকগে, আপনার আসল বাড়ি তো কৃষ্ণনগর। ওখান থেকে কেউ আসেননি?
বাবা, মা, কাকা, ভাই, খুড়তুতো ভাই অনেকেই এসেছিল। অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন করে ওরা চলে গিয়েছেন। শুধু ভাই আছে। পুলিশের বারণ না থাকলে আমিও চলে যেতাম। একদম ভালো লাগছে না।
বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। আপনার ভাই কী করে?
ইকনমিক্সে মাস্টার্স কমপ্লিট করে পিএইচডি করছে।
আপনাদের বিয়েটা প্রেমের বিয়ে ছিল, আমি শুনেছি। অনেক অশান্তিও হয়েছিল।
ঠিকই শুনেছেন। শান্তার বাবা ভীষণ গোঁড়া। পরে অবশ্য মেনে নিয়েছিলেন। আমার বাড়িতে কোনও প্রবলেম হয়নি। আমার বাবা মা পুরো ফ্যামিলির সাপোর্ট পেয়েছি।
কাউকে সন্দেহ হয় আপনার?
না। শান্তাকে মেরে কার কী লাভ?
লাভ লোকসান সবসময় খালি চোখে দেখা যায় না সুমিতবাবু। শান্তাদেবীর বাড়ি থেকে কেউ আসেননি?
ওর দাদা এসেছিল। বাবা মা অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি।
নাকি পুরোনো অভিমান?
হতে পারে। কী করে বলি বলুন? শান্তাও ওদের এড়িয়ে চলত। তবে ওর মামা এখন বিদেশে, উনি থাকলে অবশ্যই আসতেন এবং আমার পাশে দাঁড়াতেন। শান্তার দাদা কোনও রকমে বুড়ি ছোঁয়া করেই পালিয়ে গেল।
ঠিক আছে… এখন উঠছি। দরকার পড়লে আবার আসব।
বাইরে বেরিয়ে ঘড়ি দেখল রক্তিম। একটা দশ। তিয়াসা সরকারের বাড়ি ঢাকুরিয়া। এখান থেকে খুব একটা দূরও নয়। একবার ঢুঁ মারলে কেমন হয়? আজ রবিবার। ওর স্বামী সরকারি চাকুরে। নিশ্চয়ই বাড়িতে পাওয়া যাবে। ইনভেস্টিগেশনের কাজে ডিলে করার কোনও মানে হয় না, মুহুর্তে ডিসিশন নিয়ে ফেলল রক্তিম। খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধা হল না। বিশাল তিনতলা বাড়ি, তিয়াসার স্বামী দিবাকর দাশগুপ্তের। বেশ বড়ো পোস্টে আছেন। কলিংবেল টিপতে একজন বয়স্ক মহিলা দরজা খুললেন। পিছনে একটি শিশুকন্যা দাঁড়িয়ে ভারি মিষ্টি দেখতে।
নমস্কার জানিয়ে রক্তিম বলল, দিবাকরবাবুর সাথে একটু কথা বলতে চাই। আপনি কি ওঁর মা?
হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না? কোথা থেকে আসছেন?
থানা থেকেই বলতে পারেন। আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আমার নাম রক্তিম বিশ্বাস। তিয়াসা সরকারের মৃত্যুর তদন্তের ব্যাপারে পুলিশকে সহায়তা করার চেষ্টা করছি।
ভেতরে আসুন। আমি বাবুকে ডেকে দিচ্ছি। পুলিশ হলে ভেতরে ডাকতাম না। বউমার হঠাৎ করে এরকম মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারিনি। পুলিশ আত্মহত্যা বললেও আমার কিন্তু তা মনে হয় না। বউমা এভাবে অন্য জায়গায় গিয়ে আত্মহত্যা করতে যাবে কেন? তাছাড়া ওসব বিষ বউমা পাবে কোথায়? আপনি আসল রহস্য খুঁজে বের করুন।
আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব এই রহস্যের কিনারা করতে।
বসার ঘরটা সুন্দর করে গোছানো। দামি আসবাবপত্র। দেয়ালে দামি পেইন্টিং-এর পাশাপাশি বেশ কিছু বাঁধানো স্টিল ফটোগ্রাফও রয়েছে। তার মধ্যে দু-তিনটে গ্রুপ ফটো। চিনামাটির ফুলদানিতে এখনও কিছু ফুল শুকোচ্ছে। শো কেসের নীচটা জুড়ে গল্পের বই। শো কেসের মাথায় বত্রিশ ইঞ্চি এলইডি টিভি দেওয়ালে ঝুলছে। ডানদিকে তিয়াসাদের হাসি মুখের ফ্যামিলি ছবি। খুব সুন্দর দেখতে ছিলেন তিয়াসা সরকার। সেই তুলনায় দিবাকর দাশগুপ্ত অনেকটাই বেমানান। মোটাসোটা, টেকো, ভুঁড়িওয়ালা বাবু।
নমস্কার, আসতে পারি?
রক্তিম হেসে বলল, অনুমতি নেবার কিছু নেই। এটা আপনারই বাড়ি। আসুন দিবাকরবাবু, বসুন। ঘরটা দেখছিলাম। খুব সুন্দর করে গোছানো, নিপুণ হাতের কাজ, এটাও কিন্তু এক ধরনের আর্ট। আমি রক্তিম বিশ্বাস, প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তিয়াসা সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারে দুচারটে কথা জানতে এসেছি।
দেখুন পুলিশকে আমি সবই বলেছি। আর কী জানতে চান বলুন? তিয়াসার মৃত্যুতে আমি বেসামাল হয়ে পড়েছি। বাড়িতে তিন বছরের ওইটুকু বাচ্চা মেয়ে ওকে সামলানো কি সহজ কথা! তবুও মা আছে বলে রক্ষে। জানি না এর পরে কী হবে। যাইহোক, আপনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলছেন। কে নিয়োগ করেছে আপনাকে?
অবশ্যই এটা জানার অধিকার আপনার আছে। যাচাই করারও। আপনি চাইলে সরাসরি ডিসিপি গৌতম চ্যাটার্জীর সাথে কথা বলে নিতে পারেন। লাগিয়ে দেব ফোন?
না না, তার দরকার নেই। আমি জাস্ট কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করছিলাম। নকল গোয়েন্দা সেজে বিশেষ কী লাভ হবে? দেখুন চেষ্টা করে, কোনও কিনারা করতে পারেন কিনা। আমি কিন্তু পুলিশের সাথে একমত। তিয়াসা আত্মহত্যাই করেছে। ওকে খুন করার মতো কোনও কারণ আমি দেখছি না। তবে স্পটটা নিয়ে একটু কনফিউশন আছে। বুঝতে পারছি না, ও ওই বাড়িতে কেন গেল মরার জন্য?
রক্তিম বলল, কনফিউশন আরও অনেক আছে দিবাকরবাবু। এটা একটা প্রিপ্ল্যানড মার্ডার, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আরও দুজন তিয়াসার মতো একই পদ্ধতিতে খুন হয়েছেন। একজন সল্টলেক, অন্যজন বেহালায়। শান্তা কুলকার্নি ও দেবলীনা পাত্র ওদের নাম। ওই দুটো নাম শুনেছেন কখনও?
না। এসব কী বলছেন আপনি? ওইসব মৃত্যুর সাথে তিয়াসার কী কানেকশন?
এখনও পাইনি কিছু। ওদের ছবি দেখাচ্ছি, দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা?
রক্তিম মোবাইলের গ্যালারি খুলে শান্তা আর দেবলীনার ছবি বের করল। আইসি দেব তিনটে কেসের যাবতীয় ডকুমেন্টস পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তার মোবাইলে। রক্তিমই চেয়ে নিয়েছিল। দেবলীনার ছবি দেখেই কেমন জানি চমকে উঠলেন দিবাকর দাশগুপ্ত। রক্তিমের গোয়েন্দা চোখ সেটা ঠিক ধরে ফেলল। তবে সেটা প্রকাশ করল না। মনে মনে আশান্বিত হল, খুব ক্ষীণ হলেও একটা সূত্রের ইঙ্গিত যেন দিয়ে দিলেন দিবাকর দাশগুপ্ত।
তাহলে আপনি এদের কোনও দিন দেখেননি, নামও শোনেননি… তাই তো?
হানড্রেড পার্সেন্ট। মিথ্যে বলে আমার কী লাভ?
তা ঠিক। না চেনাই স্বাভাবিক। এত বড়ো শহর আমাদের এই কলকাতা! ঠিক আছে আজ তবে উঠছি। মনে হয় খুব শিগগিরই আবার আসতে হবে।
কেন? কেন?
রক্তিম হেসে বলল, আপনি কী ভাবছেন, দুদিনেই এই তদন্তের কিনারা হয়ে যাবে? আমরা কেউ সুপারম্যান নই মিঃ দাশগুপ্ত।
মেইন রোডে এসে রক্তিম ফোন করল ডিসিপি গৌতম চ্যাটার্জীকে। ফোন করে বলল, একটা ফোন নম্বর ট্র্যাক করার ব্যবস্থা করতে হবে গৌতমদা। খুব আর্জেন্ট।
কার নম্বর?
তিয়াসা সরকারের হাজব্যান্ড দিবাকর দাশগুপ্তের। চিনতে পারছেন তো! পদ্মপুকুরের ভিকটিম তিয়াসা সরকার, তার স্বামী।
বুঝতে পেরেছি। তুমি নম্বরটা পাঠিয়ে দাও, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
পাঁচ
অভীক পাত্র ঠোঁটকাটা লোক। নিঃসংকোচে ক্ষোভ উগরে দিয়ে বললেন, দেখুন এটা তো একদিন হবারই ছিল। যেমন কর্ম তেমন ফল। অসৎ সঙ্গে পড়ে গিয়েছিল আমার ওয়াইফ। সংসারের দিকে কোনও মন ছিল না। মানি, ফেম, বিলাস এসবই ছিল ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এসবের জন্য ও সব করতে পারত… সবকিছু।
রক্তিম জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের বিয়ে কীভাবে হয়েছিল?
প্রেম করে। তখন দেবলীনার রূপে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। অন্ধও বটে, অন্য কিছু দেখতেই পাইনি! আমাদের ফ্যামিলি একটু সেকেলে। প্রথমে মেনে নিলেও কিছুদিন পর যখন দেবলীনার শরীর দেখানো ছবি বিভিন্ন জায়গায় বেরোতে লাগল, বাবা একদিন ডেকে বললেন, ওকে এসব বন্ধ করতে হবে, লোকে ছিঃ ছিঃ করছে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল অশান্তি। অশান্তি এমন একটা পর্যায় পৌঁছে গেল যে, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলাম। কালীঘাটের নবীনপল্লির এই ফ্ল্যাট কিনলাম লোন-টোন নিয়ে দেবলীনাই সব ব্যবস্থা করে ফেলল। এখানে আসার পর শুরু হল আমার সাথে অশান্তি। ব্যাপারটা একটা সময় রুটিনের মতো হয়ে দাঁড়াল।
তারপর?
ইদানীং একজন নন-বেঙ্গলি প্রোডিউসারের সঙ্গে খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। প্রায়ই বলত, এবার আমি হিরোইন হব। দাগাজি তার নতুন প্রোজেক্টে আমাকে সিলেক্ট করেছেন।
কে এই দাগাজি, আপনি চেনেন?
দূর, পুরো নামটাও জানি না। শোনারও চেষ্টা করিনি। আমি ভালো করেই জানি এই দাগারা কেমন লোক হয়! কেমন করে নায়িকা সিলেক্ট করে। আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছিলাম, যদি এসব করতে হয় তবে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। তারপর তোমার যা ইচ্ছা হয় তাই করো। নায়িকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর দেবলীনা তাতে রাজিও হয়েছিল। কিন্তু তারপরেই এই ঘটনা ঘটে গেল।
আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?
ও যাদের সাথে মিশত, তারা কেউ ভালো লোক নয়। ওদের সাথে না মিললেই খুন করে দেবে। সুতরাং ওরা সবাই সন্দেহের মধ্যে থাকবে। একই ছাদের তলায় থাকলেও আমরা কেউ কারও পার্সোনাল লাইফ নিয়ে ইন্টারফেয়ার করতাম না। সকালে দুজনে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়তাম, ফিরতাম রাতে। কোনও কোনও রাতে দেবলীনা ফিরতই না। এটাই অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তবে…
তবে কী?
মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে এক রাতে, দেবলীনাকে একটি ছেলের নামে কাউকে নালিশ করতে শুনেছিলাম। সম্ভবত ছেলেটা ওকে কোনও ভাবে খুব বিরক্ত করছিল। জানি না ব্যাপারটা কতটা সিরিয়াস ছিল। তবে দেবলীনা বেশ উত্তেজিত ছিল। কথা বলতে গিয়ে প্রচন্ড রাগ দেখাচ্ছিল।
একটু খুলে বলুন প্লিজ।
বলছি। সে রাতে বেশ দেরি করেই ফিরেছিল দেবলীনা। আমি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। সারা দিন অফিসে প্রচন্ড ধকল গিয়েছিল, তাই চোখে ঘুম এসে গিয়েছিল। দেবলীনা কখন ফিরেছে টেরই পাইনি। হঠাৎ ওর উত্তেজিত গলা পেয়ে ঘুম ভেঙে যায়। ও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কথা বললেও, ভেতর থেকে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল।
ছেলেটার নাম শুনেছিলেন?
হ্যাঁ। মুকেশ কুমার।
আপনি জানার চেষ্টা করেননি, ব্যাপারটা কী?
করেছি। কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, ওসব শুনে তুমি কী করবে? এসব লাইনে ওসব একটু আধটু হয়ে থাকে। তুমি অত চিন্তা কোরো না, আই উইল হ্যান্ডেল দেম। এই উত্তরের পর আর কি কিছু বলার থাকে?
মুকেশ কুমারকে আপনি কোনও দিন দেখেছেন?
না।
দেবলীনা যাদের সাথে ওঠাবসা করত, তাদের আপনি চেনেন? মানে প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল?
কী করে থাকবে? দেবলীনা মনে করত আমি ওর কেরিয়ারের পথে বাধা। তাই আমাকে কখনওই ওর লাইনের লোকদের সাথে মিট করাত না। তাছাড়া আরও একটা কারণ ছিল…
সেটা কী?
ম্যারেড মেয়েদের হিরোইন হিসাবে গ্রেড কমে যায়। তাই ও বাইরে প্রচার করত, সে আন ম্যারেড। কখনও কাউকে বাড়িতে ইনভাইট করত না। এই ফ্ল্যাটে আসার পর থেকেই শাখা-সিঁদুরের পাট চুকিয়ে দিয়েছিল। আমিও বলা ছেড়ে দিয়েছিলাম। জানতাম ওর এই বেলাগাম উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য একদিন মারা পড়বে! সেটাই হল শেষপর্যন্ত।
ক্রমশ…