আপনার কষ্ট হচ্ছে না?

তা হচ্ছে বৈকি। মুখে ওর নামে এসব বলছি বটে কিন্তু একদিন ওকে তো ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু যেদিন আবিষ্কার করলাম, আমার ভালোবাসাটা একতরফা– সেদিন সত্যি সত্যি মনটা ভেঙে গিয়েছিল। দেবলীনার মতো মেযেরা নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসে না। খুব স্বার্থপর।

আপনি বলছেন দেবলীনা ভাবত আপনি ওর কেরিয়ারের পথে বাধা ছিলেন, ঠিক তেমনি দেবলীনাও আপনার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াননি তো অভীকবাবু?

অভীক পাত্রের গলার স্বর হঠাৎ রুক্ষ হয়ে উঠল, ঠিক বুঝলাম না একটু পরিষ্কার করে বলুন। বানিয়ে বুনিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করবেন না।

রক্তিম হেসে বলল, বিরুদ্ধ কথা বললেই রাগ দেখানোটা ঠিক নয় অভীকবাবু। আমি কিন্তু ক্যালকুলেশন করেই কথাটা বলেছি। শুনেই দেখুন, মনে হয় তারপরে অতটা ফ্যালনা মনে হবে না। চোখ দুটো সরু করে তাকালেন অভীক পাত্র।

রক্তিম বলল, আপনি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ভালো পোস্টে চাকরি করেন। ভালো মাইনে পান। আপনার পিএ নীলম মাথুর সুন্দরী ও স্মার্ট। তার সাথে আপনার একটা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমি জানি। আপনি তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। তাই যদি হয় তাহলে দেবলীনাকে আপনার পথের কাঁটা বলাটা কি খুব অন্যায় হবে?

তেড়েফুঁড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন অভীক। রক্তিম হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, দাঁড়ান দাঁড়ান আরও আছে। আগে আমারটা শেষ হোক তারপর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ আপনাকেও দেব বৈকি। একটু আগে আপনি একটা ডাহা মিথ্যে কথা বলেছেন বুঝতে পারছেন তো?

কী মিথ্যে কথা বলেছি? আমি কোনও মিথ্যে কথা বলিনি।

বলেননি? বেশ আমি তবে মনে করিয়ে দিচ্ছি। আপনি বলেছেন আপনি মুকেশ কুমারকে চেনেন না। আমি যদি বলি আপনি তাকে খুব ভালো করেই চেনেন, অস্বীকার করতে পারবেন? হ্যাঁ বা না সরাসরি জবাব দিন।

ঢোক গিললেন অভীক পাত্র, না… মানে হ্যাঁ।

তোতলাচ্ছেন কেন? ভাষা হারিয়ে গেল? দেখুন মিঃ পাত্র গোয়েন্দাগিরি অত সোজা কাজ নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে আমরা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হই। মুকেশ কুমারের সঙ্গে আপনার কিছু ছবি পুলিশ পেয়েছে যাতে প্রমাণিত হয়…

রক্তিমকে থামিয়ে অভীক বললেন, এখন ছবি তোলাটা কোনও ব্যাপার হল? প্রত্যেকের হাতেই স্মার্ট ফোন রয়েছে।

মানলাম ছবি তোলাটা কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু পরিচয় না থাকলে কেউ কারও সাথে হাসিমুখে ছবি তোলে? আপনি সেরকম কোনও সেলিব্রিটিও নন যে প্রতিদিন হাসিমুখে বহু মানুষের সাথে পোজ দিতে হয়। পুলিশ সেসব ছবি কোথা থেকে পেয়েছে জানেন?

কোথা থেকে?

মুকেশ কুমারের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে। তাতে এমন এমন সব ক্যাপশন দেওয়া আছে, সম্পর্কটা অস্বীকার করার কোনও রাস্তা নেই। এরপরেও যদি স্বীকার না করেন তাহলে স্বীকার করানোর দায়িত্বটা আমি পুলিশকেই দিয়ে দেব। আমাকে কোনও দোষ দিতে পারবেন না।

কলে আটকা পড়া ইঁদুরের মতো ছটফট করতে লাগলেন অভীক পাত্র।

মিথ্যে বলে আর কোনও লাভ নেই। তাতে আপনার বিপদ বাড়বে।

কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন অভীক পাত্র। তারপর মিন মিনে গলায় বললেন, হ্যাঁ, আমি মুকেশকে চিনি। কিন্তু দেবলীনার সাথে ওর কী কারণে ক্ল্যাশ তা আমি জানি না। মুকেশকে আমরা অফিসিয়াল মাসলম্যান হিসেবে ব্যবহার করি। অফিসের হায়ার অথরিটি সব জানে, সাপোর্ট দেয়। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। ছোটোখাটো ঝুট ঝামেলা হলে ওরাই সামলে দেয়।

হ্যাঁ, আমি জানি। অনেক বেসরকারি সংস্থা, ব্যাংক, ফিনান্সিয়াল এজেন্সি এই ধরনের ম্যাসলম্যান পোষে। কিন্তু দেবলীনা অর্থাৎ আপনার ওয়াইফকে ও ডিসটার্ব করছে অথচ আপনি কারণটা জানেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা হল? জানা না থাকলে আপনি তো ওকে ফোন করেই জেনে নিতে পারতেন? কিন্তু আপনি সেসব কিছুই করেননি। এ থেকে যে-কেউ অনুমান করে নিতে পারবে, এসব আপনিই করিয়েছেন।

সেটাই আমার ভুল হয়েছে। করিনি দুটো কারণে। এক, প্রথমে ভেবেছিলাম এ মুকেশ অন্য কোনও মুকেশ। সুতরাং আমি ওদের মাঝে যাব না। পরে যখন জানলাম এ মুকেশ আমার চেনা মুকেশ তখন মনে হল, মুকেশ নিশ্চয়ই আমার স্ত্রীকে চেনে না। কারণ আমিও কাউকে দেবলীনার পরিচয় দিতাম না। বুঝলাম দেবলীনারই কোনও শত্রু টাকা দিয়ে মুকেশকে সেট করেছে। মুকেশদের কোনও নীতিফিতি থাকে না, টাকার জন্য ওরা সব কিছু করতে পারে। আমার মাথায় একটা বদ বুদ্ধি খেলে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম এই একটা সুযোগ, মুকেশ যদি দেবলীনাকে একটু টাইট দেয় তাতে ক্ষতি কী? কিন্তু মুকেশ যে এভাবে দেবলীনাকে খুন করে ফেলবে সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।

মুকেশ দেবলীনাকে খুন করেনি বলেই আমার ধারণা। মুকেশের মতো ক্রিমিনালরা ছুরি, চাকু, পিস্তল এসব ব্যবহার করতে জানে। এটা মোটা দাগের খুন নয়। এর পিছনে শার্প মাইন্ড আছে। আপনার গল্প কতটা সত্যি সেটাও খুব শিগগিরই যাচাই হয়ে যাবে আশা করছি।বলতে বলতেই ফোন বেজে উঠল রক্তিমের। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল আইসি দেবের নম্বর। রিসিভ করে বলল, বলুন স্যার ফোন করেছেন কেন?

ও প্রান্ত থেকে আইসি দেব বললেন, একটু আগে আমার স্টাফ পলাশ মিত্র ফোন করেছিল। ও মুকেশকে পাকড়াও করতে পেরেছে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসছে। মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যেই হয়তো পৌঁছে যাবে। আপনি কি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান?

অফ কোর্স। ওকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আমার। আমি আসছি, না পৌঁছানো পর্যন্ত ওকে ছাড়বেন না, ইটস ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট।

————–

থানায় ঢুকে রক্তিম দেখল আইসি দেব ফিল্মি কায়দায় টেবিলের উপর বসে একটা পা ঝুলিয়ে আর একটা পা সামনের চেয়ারের নীচের প্রান্তে রেখে দেহটাকে ঝুঁকিয়ে চেয়ারে বসা ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। রক্তিমকে দেখে সামনে এগিয়ে এলেন।

রক্তিম চাপা গলায় বলল, কিছু বের করতে পারলেন?

আইসি দেব বিরক্ত গলায় বললেন, দাগী মাল, সহজে ছাড়বে না। কিছু রোগ আছে উইদাউট ট্রিটমেন্টে কিছুতেই সারতে চায় না। দেব নাকি হালকা ওষুধ?

রক্তিম হেসে বলল, আমি একটু চেষ্টা করে দেখি, তারপরে না হয় দেখা যাবে।

বেশ। আমি পাশের ঘরেই আছি। অন্য একটা কেসের ব্যাপারে ওদের একটু ইনস্ট্রাকশন দিয়ে আসি।

রক্তিম মুকেশের সামনের চেয়ারে গিয়ে বসল। লম্বা চওড়া পেশীবহুল শক্তিশালী শরীর। চোয়াড়ে মুখ। গোঁফটা বিশেষ কায়দায় ছাঁটা। ঝাঁকড়া চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমেছে। গলায় ইউপি স্টাইলে উত্তরীয় জড়ানো। কপালে মেটে সিঁদুরের তিলক।

মুকেশই অবাঙালি টানে বলল, দেখেন সাব আপনি কোন অফিসার আছেন হামি জানি না, ওই সাব কিন্তু বহুত জুলুম কোরলেন। আরে হামি যেটা জানি না সেটার উত্তর কেমন করে দিব? আপনাকে দেখে সমঝদার লাগছে, আপনি একটু বুঝিয়ে বোলেন ওনাকে। কেন হামাকে ডেকে আনা হয়েছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না হামি।

রক্তিম বলল, আমি বুঝিয়ে বলছি। গত কয়েক দিনে কলকাতায় তিনজন মহিলা মার্ডার হয়েছেন। দুটো কেসে আপনার নাম পাওয়া গিয়েছে। তাই আপনাকে তুলে এনেছে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।

এটুকু বুঝেছি। কিন্তু এই সব মার্ডারের সাথে হামার কী সম্পর্ক?

এই সময় ঢুকলেন আইসি দেব। মুকেশের কথা ধরেই বললেন তুমি দেবদূতকে চেনো না?

তা তো হামি অস্বীকার করিনি। কিন্তু যে-মহিলা খুন হয়েছেন তাকে হামি চিনি না। শান্তা কুলকার্নি এই নামও শুনিনি কোনও দিন।

রক্তিম বলল, দেবদূতকে আপনি কীভাবে চিনলেন?

দেবদূতের সাথে হামার বিজনেস টার্মস আছে।

কী ব্যাবসা করেন আপনি?

এক্সপোর্ট ইমপোর্ট আরও অনেক কিছু।

রক্তিম হেসে বলল, যেমন সুপারি কিলিং, রাহাজানি, গুন্ডাগর্দি, দাদাগিরি তাই তো?

এসব কী বলছেন সাব? হামি পুজাপাঠওয়ালা আদমি আছি, ওসব কেন করতে যাব?

রক্তিম আইসি দেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। আইসি দেবও হাসলেন। মুকেশ নির্বিকার ভাবে বলল, হামার মোনে হয় আপনাদের কোনও গলদ ফ্যামি হোচ্ছে সাব। এরকম ঝুটা ইলজাম আপনারা হামাকে দিতে পারেন না। হামি কিন্তু চুপচাপ বসে থাকব না হায়ার অথরিটিকে জানাব। তখন কিন্তু ব্যাপারটা ভালো হোবে না সাব, আপনি জানেন না…

আচমকা চেয়ার ছেড়ে গর্জে উঠল রক্তিম, শাট আপ আর একটা আজে বাজে কথা বললে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব।

চমকে উঠল মুকেশ। রক্তিমের রক্তচক্ষু দেখে থতমত খেয়ে গেল।

আইসি দেব বললেন, মালটা ঠ্যাটা তখনই বলেছিলাম আপনাকে। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না রক্তিমবাবু।

মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে কন্ট্রোল করে নিল রক্তিম। মুচকি হেসে বলল, মুকেশ কুমার সব জায়গায় তো তোমার দাদাগিরি চলবে না। এবার তুমি বড়ো জায়গায় ফেঁসেছ বস। দ্যাখো তো এই ছবিটা চিনতে পারো কিনা?

রক্তিম মোবাইল থেকে দেবলীনার ছবি বের করে দেখাল মুকেশকে। নিমেষে মুকেশের ফর্সা গাল লাল হয়ে উঠল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আপন মনেই বিড় বিড় করে বলে উঠল, শিবানীর ছবি আপনার কাছে এল কী করে?

শিবানী ! রক্তিম বলল, আমি অবশ্য এমন কিছুই সন্দেহ করেছিলাম। তার মানে দেবলীনা বাইরের দুনিয়ায় শিবানী নামে পরিচিত ছিল। যাই হোক তুমি একে চেনো এটা অন্তত স্বীকার করলে। না করে উপায়ও ছিল না অবশ্য।

শিবানীকে হামি চিনি। শুনেছি শিবানীও…

ঠিকই শুনেছ। শিবানীও খুন হয়েছে। আর শিবানী খুনে তোমাকে সরাসরি অ্যারেস্ট করা যায়। কারণ তুমি তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলে তার প্রমাণ আছে আমার কাছে।

মুকেশ কুমারের মুখ চুপসে আমচুর। দাদাগিরি মার্কা তেজ উধাও। আইসি দেব অবাক হয়ে বললেন, এসব ইনফরমেশন আপনি কোথায় পেলেন?

রক্তিম সে কথার জবাব না দিয়ে মুকেশকে বলল, শিবানীর আসল নাম তুমি জানো?

না সাব। শিবানীর আবার কটা নাম?

ওর আসল নাম দেবলীনা পাত্র। ওর স্বামীর নাম জানো?

মুকেশের চোখ দুটো আরও বড়ো হল, স্বামী! হামি তো জানি ও আন ম্যারেড।

অবাক লাগছে? ওর স্বামীর নামটা শুনলে আরও অবাক হবে। ওর স্বামীর নাম অভীক পাত্র। নিকলসন ইন্ডিয়া গ্রুপের এজিএম।

কথাটা বলেই রক্তিম তীক্ষ্ণ নজর ফেলে রাখল ওর মুখের উপর। মুকেশ কুমারের মুখের অভিব্যক্তির সামান্য ওঠা পড়াও যেন এড়িয়ে যেতে না পারে। মুকেশ কুমার উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল, অভীকবাবুর ওয়াইফ আছে শিবানী ! আপনি ঠিক বলছেন তো ? কোনও গড়বড় হচ্ছে না তো ?

হাসি খেলে গেল রক্তিমের ঠোঁটে, বিলকুল নেহি মুকেশ ভাই। এবার কষ্ট করে আর একটা সচ তোমাকে বলতে হবে, তাহলেই আপাতত তোমার ছুটি। ঝুট বলার চেষ্টা করবে না একদম। আমি কী জিনিস আছি নিশ্চয়ই কিছুটা বুঝে গিয়েছ এতক্ষণে।

মাথা নীচু করে মুকেশ বলল, বোলেন কী জানতে চান? তবে বিশ্বাস কোরেন সাব, কোনও খুন হামি করি নাই, মা কসম।

সেটা তদন্ত শেষ হলেই বোঝা যাবে। শিবানীকে তুমি হুমকি দিয়েছিলে৷ কিন্তু কেন?

হামাকে যেমন বলা হয়েছিল হামি তাই করেছি মাত্র। তার জন্য টাকা পেয়েছিলাম।

কে দিয়েছিল টাকা? সেই কী এসব করতে বলেছিল?

হামি তাকে সামনাসামনি দেখিনি। ফোনে কথা বলেছিল। টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল অ্যাকাউন্ট ট্রান্সফার করে। হামি প্রথমে বলেছিলাম ক্যাশ চাই। তখন সে বলেছিল তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে কাজ করাবে। হামি আর ঘাঁটাইনি। কারণ কাজটা ছিল সামান্য কিন্তু সেই হিসাবে টাকাটা ছিল অনেক। লোভ সামলাতে পারিনি সাব।

কত টাকা দিয়েছিল তোমাকে?

এক লাখ।

কী করতে বলেছিল?

সেরকম কিছুই না। শিবানী কোথায় যায়, কী করে, কার সাথে দেখা করে এইসব। আর মাঝে মাঝে ফোন করে হুমকি দিয়ে ভয় দেখানো। ব্ল্যাকমেল টাইপের ব্যাপার।

কিন্তু ব্ল্যাকমেল তো এমনি এমনি হয় না। ভয় দেখানোর জন্য কিছু একটা সিক্রেট ইস্যু থাকতে হয়। সেটা কী ছিল ?

শিবানী নাকি ব্লু ফিল্মে অ্যাক্টিং করত। যদিও সেটা সত্যি কিনা আমি জানি না। যিনি টাকা দিয়েছিলেন তিনি বলে দিয়েছিলেন এসব বন্ধ করার ভয় দেখাতে হবে, হামি সেটাই বলতাম।

এসব ফাঁস করে দেওয়ার সাথে সাথে টাকার দাবি করতে বলেনি?

না সাব। জানে মেরে ফেলার কথা বললেও টাকার কথা কিন্তু বলতে বলেনি কোনও দিন।

আশ্চর্য‌্য!

আমারও তাজ্জুব লেগেছিল। একবার পুছেও ছিলাম। কিন্তু সাব গুসসা হয়ে যেত।

তোমার সাথে কতদিনের কন্ট্রাক্ট ছিল?

সেরকম কোনও কথা হয়নি। হামিও পুছিনি। তবে হামার কথায় সেরকম কাজ হচ্ছে না বুঝতে পারতাম। কারণ শিবানী সেই সব কাজ করেই যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন শুনলাম শিবানী খতম। মনে মনে খুশিই হয়েছিলাম, হামার পেমেন্ট পেয়ে গেছি, আর কোনও ঝামেলা থাকল না। কিন্তু এখন তো দেখছি শিবানী মরে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছে। আপনারা আমাকে জোর করে টেনে আনছেন। এর বেশি আর কিছু জানি না সাব।

এবার তোমাকে ছেড়ে দেব। আর একটা লাস্ট কোশ্চেন আছে। যিনি তোমাকে এসব করতে বলেছিলেন, টাকা দিয়েছিলেন, তিনি তার নামটা বলেছিলেন?

হাঁ সাব। অবিনাশ রুদ্রা। বললেও হামার মনে হয়েছে নামটা ভুয়ো আছে। এই সব লাইনে অনেক দিন হয়ে গেল। খারাপ কাজ করাচ্ছে, আসল নাম বলবে, হামার বিশ্বাস হয়নি। নিজের সেফটি সবাই বোঝে। হামিও নিজের সেফটির কথা ভেবে একটা কাজ করেছিলাম। ওর সাথে যখনই কথা বলতাম সমস্ত কল রেকর্ড করে রাখতাম সাব। হামি যা কিছু করেছি ওই লোকটার কথাতেই করেছি তার সুবুদ আপনারা ওখান থেকে পেয়ে যাবেন আশা করি।

রক্তিম তাকাল আইসি দেবের দিকে। আইসি দেব হেসে বললেন, আবার সেই অবিনাশ রুদ্র? একজন মৃত ব্যক্তি কীভাবে এসব করে বেড়াচ্ছে? স্ট্রেনজ !

রক্তিমও হাসল। মনে হয় ওর ভূত করাচ্ছে স্যার। যাই বলুন খেলাটা কিন্তু বেশ জমে উঠেছে। এর আগে কোনও দিন কোনও ভূতের সাথে লড়াই করিনি। মনে হয় এবার সেটাও করতে হবে। আপনি ওর রেকর্ড করা কলগুলো ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করে ওকে ছেড়ে দিন। তারপর শান্তা ও মুকেশ দুজনেরই রেকর্ড করা কলগুলো আমার মোবাইলে পাঠিয়ে দিন। আমি ঠান্ডা মাথায় বাড়িতে বসে ওগুলো শুনতে চাই।

ছয়

মণিশঙ্কর দত্ত লেনের সরু একটা গলি। দুপাশে পর পর বাড়ি। এ দিকটায় কোনও দিন আসেনি রক্তিম। একটা গলি শেষ হতেই আর একটা গলির শুরু। তস্য গলি। একজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল এটাই বিধু দত্ত লেন। একটু এগিয়ে যেতেই নজরে পড়ল চোদ্দো নম্বর বাড়িটা। বাড়ির নাম প্রধান ফটকে লেখা, কেতকি ম্যানসন। নীচে তৈরির সাল লেখা রয়েছে। হলুদ রঙের পুরোনো সাবেকি মডেলের দোতলা বাড়ি। সামনে ঢোকার মুখে একটা মাধবীলতা গাছ সদর গেটটাকে জড়িয়ে ঝাঁকিয়ে উঠেছে। সর্বাঙ্গে লাল সাদা ফুলের বুনোট। থোকা থোকা ফুল আর সবুজ পাতা, যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি।

কিছুটা দূরের বাঁকে একটা চায়ের দোকান। সামনে বেঞ্চ পাতা। একটা লোক ছিল, সেও উঠে গেল। কী মনে হল, রক্তিম চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে সিগারেট ধরাল। আকাশ মেঘলা, যে-কোনও সময় নেমে যেতে পারে, তাই লোক চলাচল কম। আশেপাশের বাড়ি থেকে টিভির শব্দ ভেসে আসছে। চায়ের দোকানে বসে চা খেলেও রক্তিমের নজর চোদ্দো নম্বর বাড়িটার দিকে। কিছুটা আন্দাজেই চলে এসেছে। খবরটা যদি সত্যি হয় তাহলে ভেতরে ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করে। যদি মিথ্যে হয় তাহলেও কিছু বলার নেই। একজন গোয়েন্দার প্রাথমিক কর্তব্য হল, যত ক্ষীণ সূত্রই হোক সেটা যাচাই করা। সেটাই করতে এসেছে রক্তিম।

একটু আগেই সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। গলির মোড়ে হ্যালোজেন বাতি জ্বলে উঠতেই জায়গাটা ঝলমল করে উঠল। রাস্তার একধারে জমে থাকা জলে আলো পড়তেই ঝলসে উঠল যেন। বাতাসে হালকা হিমেল ভাব। ফলে প্যাচপেচে গরমটা আর নেই। রক্তিম মনে মনে ভাবল, আগ বাড়িয়ে ওই বাড়ির কড়া নাড়াটা কি ঠিক হবে? একটা কিছু বানিয়ে বলে ঢোকা যাবে ঠিকই কিন্তু তাতে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া কিছুটা নিশ্চিন্ত না হয়ে মুখ দেখানোটাও বোধহয় ঠিক হবে না। যদি সত্যি সত্যি ইনফরমেশন ভুল থাকে। মনের মধ্যে পক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তি বুদবুদের মতো উঠে আসতে লাগল।

এদিকে রাত বাড়ছে, দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। এতদূরে এসে খালি হাতে ফিরে যেতেও মন চাইছে না। এই রকম দোলাচলে চায়ের বিল মেটাতে উঠল। ঠিক তক্ষুনি একটা টানা রিকশা এসে দাঁড়াল চোদ্দো নম্বরের সামনে। রিকশা থেকে যিনি নামলেন তাকে দেখে প্রথমে নিজের চোখকেই ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না রক্তিম। সুমিত সেন এখানে! রক্তিমের কাছে যা ইনফরমেশন আছে, তাতে এই বাড়িটি দেবলীনার বাপের বাড়ি। দেবলীনার বাপের বাড়িতে সুমিত সেন এসেছেন কেন? তবে কি সুমিতের সাথে দেবলীনার কোনও সম্পর্ক ছিল? কেমন জানি মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল রক্তিমের।

সুমিত সেন রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে গেলেন। দেখেই বোঝা গেল এ বাড়িতে তার যাতায়াত আছে। রক্তিম আবার বেঞ্চে বসে পড়ল। আপাতত অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। তবে আশান্বিত হল, এই বাড়িতে যে রহস্যের একটা জট পেকে আছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে মনে আশ্বস্ত হল, ভুল জায়গায় এসে পড়েনি।

প্রায় কুড়ি মিনিটের মতো সময় নিলেন সুমিত সেন। তারপর বেরিয়ে হন হন করে হাঁটা দিলেন মেইন রোডের দিকে। ইচ্ছে করলেই সুমিত সেনকে ধরতে পারে রক্তিম। কিন্তু সে চেষ্টা করল না। এই বাড়িতে ঢোকাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করল।

কলিংবেল টিপে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। খুললেন মাঝ বয়সি একজন প্রৌঢ়া। অবিকল দেবলীনার মুখ। আলাদা করে চেনানোর কোনও প্রয়োজনই পড়ে না।

রক্তিম বলল, আপনি তো দেবলীনা পাত্রের মা, আমি রক্তিম বিশ্বাস পুলিশের তরফ থেকে আসছি, কিছু জরুরি কথা বলার ছিল।

পুলিশের নাম শুনেই কিনা ঠিক বোঝার উপায় নেই, তবে বেশ নার্ভাস লাগল ভদ্রমহিলাকে।

কিছুটা কাঁপা গলায় বললেন, কিন্তু পুলিশকে তো যা বলার সবই বলেছি আমি। আবার কেন এসেছেন? আমি একা থাকি সময় নেই অসময় নেই, এভাবে বিরক্ত করার কোনও মানে হয়?

সরি অসময়ে আসার জন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনার মেয়ে মার্ডার হয়েছেন ম্যাডাম, আপনি চান না তার হত্যাকারী ধরা পড়ুক?

অবশ্যই চাই।

তবে তদন্তে একটু সহযোগিতা তো করতেই হবে। পুলিশ প্রাণপণ চেষ্টা করছে।

ভেতরে আসুন। আমাকে একটু তাড়াতাড়ি ছাড়লে সুবিধা হয় কিছু জরুরি ফোন করার আছে।

অফ কোর্স। আমি বেশি সময় নেব না।

ভেতরে ঢুকেই রক্তিম বুঝতে পারল প্রাচুর্যের কোনও অভাব নেই এ বাড়িতে। আসবাব থেকে ঘরের পর্দা সবই দামি। বেশ কিছু অ্যান্টিক শো পিস রয়েছে। নরম সোফায় বসে রক্তিম বলল, আপনার কয় ছেলেমেয়ে?

এক ছেলে এক মেয়ে, দেবলীনা বড়ো। ছোটো দেবোপম বেঙ্গালুরুতে ডাক্তারি পড়ছে। একটা বেসরকারি কলেজে।

কিছু মনে করবেন না। সে তো অনেক টাকার ব্যাপার, এত টাকা কোথায় পেলেন?

রেগে উঠলেন ভদ্রমহিলা, সে কৈফিয়ত আপনাদের দিতে হবে? আশ্চর্য তো ! আমার স্বামী রেলের বড়ো পোস্টে চাকরি করতেন। ওদের বনেদি পরিবার। স্থাবর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ নেহাত কম নেই। তাছাড়া আমার মেয়েজামাই দুজনেই যথেষ্ট উপার্জনশীল, ওরাও ওর পড়ার ব্যাপারে অনেক হেল্প করে।

আপনার স্বামী কতদিন হল মারা গিয়েছেন?

চার বছর হল। হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক। তিনদিন ভেন্টিলেশনে থাকার পর।

সরি, দেবলীনা মডেল ছিল ওর কাজকর্ম সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণা আছে?

ও বেশ নামকরা মডেল ছিল। একটা ফিল্মে হিরোইন হবারও কথা চলছিল। দিনরাত খাটত নিজের পজিশন তৈরির জন্য। টাকাও রোজগার করত ভালোই।

দেবলীনার সঙ্গে ওর স্বামীর সম্পর্ক কেমন ছিল?

দুজনেই মহা ব্যস্ত মানুষ। কেউ কাউকে ঠিক মতো সময় দিতে পারত না। যার ফলে একটু ঠোকাঠুকি লেগে থাকত। ওটা কোনও বড়ো ব্যাপার নয়। তবে দেবলীনার হিরোইন হবার ব্যাপারটা আমার জামাই মেনে নিতে পারেনি। ডিভোর্স দেবার কথাও তুলেছিল একবার। আসলে ওদের ফ্যামিলি ভীষণ ব্যাকডেটেড, এসব দ্যাখেনি কোনও দিন।

রক্তিম হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, একটু আগে আপনার বাড়ি থেকে যিনি বেরিয়ে গেলেন তিনি কে?

একটু থমকালেন দেবলীনার মা। কী যেন ভাবলেন। তারপর তির্যক হেসে বললেন, আপনারা এভাবে গোয়েন্দাগিরি করছেন?

রক্তিম হেসে বলল, আপনি যা ভাবছেন সেরকম কিছু না। সামনাসামনি হয়ে গিয়েছিল তাই জিজ্ঞেস করছি। ইচ্ছে না হলে এ প্রশ্নের জবাব না-ও দিতে পারেন।

জিজ্ঞেস যখন করলেন তবে শুনেই রাখুন। ওর নাম ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ি, একজন প্রোডিউসার। ওর কাছে দেবলীনার কিছু পেমেন্ট বাকি ছিল সেটাই দিতে এসেছিলেন। খুব সজ্জন মানুষ। নইলে এই বাজারে মরা মানুষের টাকা কেউ দেয়?

রক্তিম ভীষণ অবাক হয়ে গেল। সুমিত সেনের এই নতুন নাম নেওয়ার মানেটা কী? তবে কি সুমিত বেনামে মেয়েদের দিয়ে ব্যাবসা চালায়? ওই কি তবে দেবলীনার খুনি ? হয়তো ব্যাবসা সংক্রান্ত কোনও গোলমাল হয়েছিল ওদের মধ্যে। তবে শান্তা ও তিয়াসার খুনি কে? ওটাও কি সুমিতের কাজ? যেভাবে কানেকশনগুলো বেরিয়ে পড়ছে অসম্ভব কিছু নয়। সুমিত যে এতটা জড়িয়ে আছে, এখানে না এলে জানতে পারত রক্তিম? যাকে দেখছে সে-ই কিছু না কিছু রহস্য ক্রিয়েট করে রেখেছে! চারদিকে ছড়িয়ে পড়া এই জাল গুটিয়ে তোলা অত সহজ কাজ হবে না।

কী অত ভাবছেন? এবার আমাকে ছাড়ুন।

সরি আর দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করেই ছেড়ে দেব। একটা বিষয় বোধহয় জানেন না, আপনি হয়তো শুনে কষ্ট পাবেন তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি, একদিন তো আপনি জানবেনই। দেবলীনা মডলিং-এর পাশাপাশি পর্ন ফিল্মে কাজ করতেন। সেখান থেকেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আসত। আপনি কি জানতেন সেটা?

কী যা তা বলছেন আপনি?

আপনার পক্ষে মেনে নেওয়া হয়তো কষ্টকর কিন্তু এটাই সত্যি। মডেলিং ছিল লোক দেখানো ব্যাপার। তবে দেবলীনা স্বেচ্ছায় নাকি অন্য কারও চাপে পড়ে এই প্রফেশন বেছে নিয়েছিল, সেটা আমি বলতে পারব না।

কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন ভদ্রমহিলা। ধীরে ধীরে মুখ তুলে বললেন, এসব আমি জানতাম না। জামাই কিছুটা হিন্টস দিলেও ওর কথায় গুরুত্ব দিইনি। ভাবতাম ওর কথাই ঠিক, জামাই জেলাসিতে ভোগে। ছিঃ ছিঃ ওর বাপঠাকুরদার কত বড়ো বনেদি বংশ। এখনও মানুষ সমীহ করে। সেই বংশের মেয়ে হয়ে এসব করতে পারল? আর সেই টাকা আমি এতদিন হাত পেতে নিয়েছি? ঘেন্নায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। দুহাতে মুখ ঢাকলেন দেবলীনার মা।

রক্তিম বলল, এবার আমি উঠছি মাসিমা। আমার সাথে আপনার এই সাক্ষাতের কথা কাউকে না বলাই ভালো। তাতে আপনার বিপদের ঝুঁকি বাড়তে পারে। আপনি এতটা জেনে গেলেন এটা অনেকের সহ্য না-ও হতে পারে।

 

 

বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গেল। চটজলদি ফ্রেশ হয়ে সোজা খাবার টেবিলে চলে এল। জবর খিদে পেয়েছে। মা খাবার পরিবেশন করতে করতে বললেন, খিদে তো পাবেই। সেই কোন সকালে খেয়ে গিয়েছিলি। সারাদিন নিশ্চয়ই অনেক ধকল গিয়েছে। কিছু প্রোগ্রেস হল?

ঠিক বুঝতে পারছি না। বনের মধ্যে পথ হারানোর মতো ব্যাপার হচ্ছে। অনেক ঘোরাঘুরি করে শেষে মনে হচ্ছে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই আবার এসে পৌঁছেছি।

আগে ঠান্ডা মাথায় খেয়ে নে। তারপর আমাকে সব খুলে বল। দেখি তোকে কোনও ভাবে হেল্প করতে পারি কিনা।

খাওয়া শেষ করে দুজনে ঝুল বারান্দার ব্যালকনিতে এসে বসল। রক্তিম সংক্ষেপে ব্রিফিং করল মাকে। মা সব শুনে বললেন, এক্সেলেন্ট, দারুণ প্রোগ্রেস। এর চেয়ে আর বেশি কী চাস? কেসটা অনেক বেশি ছড়ানো, একটু সময় লাগবে। আমি তোকে সেদিনই বলেছিলাম, ভিকটিম তিনটে মেয়ে তোর ট্রাম্প কার্ড। ওরাই রহস্যের সূত্র। এক দেবলীনাই এত কিছু জানিয়ে দিল, শান্তা ও তিয়াসা এখনও বাকি। আমার ধারণা ওরাও অনেক রহস্য নিয়ে বসে আছে। একটা জোরে ঝাঁকি দিতে হবে। গাছে ফুল থাকলে যেমন জোরে ঝাঁকি দিলে ঝরে পড়ে, এখানে রহস্য ঝরে পড়বে। তোকে যথার্থ ফুল সংগ্রাহক হতে হবে। ওই ফোন কল দুটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও যে-ফোন করেছে, সে সব রকম সতর্কতা অবলম্বন করেই করেছে বলে মনে হয়। তবুও একবার ভালো করে চেক করা দরকার। খুব বড়ো ক্রিমিনালও অনেক সময় খুব সাধারণ ভুল করে বসে। কিন্তু ভুল তো নিজে থেকে ধরা দেবে না, তোকে খুঁজে বের করতে হবে। সত্যি কথা বলতে একজন ডিটেকটিভের সাফল্যের পিছনে কোনও শর্টকাট ওয়ে থাকে না। প্রত্যেকটা ইভেন্ট, প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করতে পারলে তবেই সাফল্য আসবে।

রক্তিম হেসে বলল, তোমার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারছি। আমাকে আরও খাটতে হবে। থ্যাংক ইউ ফর ইওর প্রেশাস অ্যাডভাইস। এবার আমি শুতে চললাম।

মা হেসে বললেন, তুই যে এখন কেমন শুবি সে তো বুঝতেই পারছি। ওই কল রেকর্ড শোনার চক্করে অযথা বেশি রাত করিস না, শরীর খারাপ করবে।

 

————

সকালবেলা রক্তিমের ঘুম ভাঙল মোবাইলের গোঙানিতে। ঘুম চোখে তুলে দেখল আইসি দেবের ফোন। সাত সকালে আবার নতুন কিছু ঘটল নাকি?

আইসি দেব বললেন, ঘুমোচ্ছিলেন নাকি? আপনি মুকেশের ব্যাংক ডিটেলসটা চেয়েছিলেন তাই করলাম। কাল রাতেই পেয়েছি কিন্তু অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় আর ফোন করিনি।

ঘুম ছুটে গিয়েছে, উঠে বসল রক্তিম, গুড। আমি থানায় গিয়ে দেখে নেব। তাছাড়া ইন্সপেক্টর পলাশ মিত্রের সাথেও একটু কথা বলার দরকার আছে। আচ্ছা, দেবদূতের ভাই সুজয় ঘোষ সম্পর্কে আপনারা কোনও খোঁজ খবর করেছিলেন?

সেরকম কিছু না। সামান্য কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল মিত্র। কেন বলুন তো?

না সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যাপার নেই। থানাতে গেলে কথা হবে এখন রাখছি।

দাঁত ব্রাশ করে ড্রযিং রুমে এসে বসল রক্তিম। একটু বাদে মা চায়ের ট্রে হাতে ঘরে প্রবেশ করে বললেন, কী রে রাতে ঠিকমতো ঘুমিয়েছিলি তো?

রক্তিম হেসে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভালো ঘুমিয়েছি।

মা হাসলেন, বুঝতে পারছি। তোকে বেশ ফ্রেশ লাগছে। কে ফোন করেছিল একটু আগে?

আইসি প্রিয় প্রসাদ দেব। মুকেশ কুমারের ব্যাংক ডিটেলসটা পেয়েছেন সেটাই জানালেন।

কল রেকর্ড দুটো শুনলি? কিছু পেলি?

সেরকম কিছু নেই। ওদের মুখে যা শুনেছি সে সবই রয়েছে তবে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলে অদ্ভুত একটা জিনিস শোনা যায়। আমার ভুলও হতে পারে, তুমি একটু শুনবে? আমি সব সেট করে দিচ্ছি মন দিয়ে শুনবে কিন্তু। যদি তুমিও ধরতে পারো তাহলে বুঝব আমার অনুমান ঠিকই আছে।

মাকে সব অ্যারেঞ্জ করে দিয়ে রক্তিম চা খেতে বসল। মা চোখ বন্ধ করে শুনতে লাগলেন। একবার নয়, দু-তিনবার শুনলেন। একসময় তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হেড ফোন খুলে বললেন, আই থিংক ইউ আর রাইট। দারুণ আবিষ্কার করেছিস। কালকেই বলেছিলাম, বড়ো বড়ো ক্রিমিনালও ভুল করে অ্যান্ড দিস ইজ মোস্ট ভাইটাল ওয়ান। এখন এটাকে কতটা কাজে লাগাতে পারবি তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। কি ঠিক ধরতে পেরেছি তো ?

রক্তিম মায়ের ব্যাখ্যা শুনে বলল, ইউ আর অ্যাবসুলিউটলি রাইট। কিন্তু এত লোকের মাঝে খুঁজে বের করা অত সহজ কাজ হবে না, সেটাও বুঝতে পারছি। আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। তোমার অ্যাপ্রুভাল পেলে এগজিকিউট করার কাজে হাত দেব।

শোনা, দেখি তোর প্ল্যানিং।

রক্তিম মাকে ব্যাখ্যা করে শোনাল ওর নেক্সট প্ল্যানিং।

মা শুনে উচ্ছসিত হলেন দারুণ। তোর চিন্তা ভাবনার মধ্যে অনেক পরিপক্কতা এসেছে। যদি সফল ভাবে কেসটা সলভ করতে পারিস আমি দারুণ খুশি হব।

 

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...