ওরা তখন কলেজে। ফার্স্ট ইয়ার। সবেমাত্র শুরু হয়েছে নতুন সেশন। আষাঢ় মাস,কালো মেঘের বুক চিরে বর্ষা নেমেছে। সেদিনের মতো অনার্স-পাস ক্লাস শেষ। আকাশে ঘন মেঘ জমেছে গাঢ় ছাই রঙের। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বৃষ্টি আসছে ঝেঁপে। ছেলেটা মেয়েটাকে ঠিক তখনই রাস্তায় বের হতে বারণ করল। আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টি নামল। ওরা ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেল তিনতলায় একটা ফাঁকা বড়ো ক্লাসরুমে। সেখানে প্রকাণ্ড জানালা এবং অবশ্যই জানালা গ্রিলবিহীন। এমন জানালা দিয়ে আষাঢ়ের বরিষনমুখরিত আকাশ দেখার আনন্দই আলাদা।
বৃষ্টি দেখার অবকাশে ছেলেটা একবার ভালো করে দেখে নেয় মেয়েটাকে। আকাশে যখন বিদ্যুৎ চমকায় মেয়েটা কেমন শিশুর মতো চমকে ওঠে। ছেলেটার দেখতে ভালোলাগে। মেয়েটাও দেখব না দেখব না করে একবার ভালো করে দেখে নেয় ছেলেটাকে। দুজনেই ভাবে কলেজ শেষে এমন বরিষনের দরকার ছিল বইকি! দুজনে দুজনকে একটু কাছে থেকে পাওয়ার জন্যই যেন এই বৃষ্টি। ছেলেটা বুঝল কলেজ কেন তার প্রথম প্রথম ভালো লাগছিল না। মনে মনে ধন্যবাদ জানাল বৃষ্টিকে।
মেয়েটাও টের পেল, দারুণ গ্রীষ্মে হাঁসফাঁস করা গরমে যদি ওদের দেখা হতো তাহলে হয়তো মন কেমন করা ভালোবাসা তৈরি হতো না ওদের দুজনের মধ্যে। কিন্তু এই বৃষ্টি, এই Love in the monsoons যেন অনেক কিছু জাগতিক বিষয়কে চাপা দিয়ে, দুটো মনকে কাছাকাছি এনে দিল। মন বলে, ‘এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘোর বরিষায়’। কী বলা যায়, কীই বা বলবে! জীবনটা তো আর তেমন ফিল্মি নয়!
ফিল্মি নয়? কে বলল? সেলুলয়েডে যেভাবে এক সদ্যযৌবনা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে-এর সেই মেয়ে ‘সিমরন– বৃষ্টিধারায় ভিজতে ভিজতে যে গেয়েছিল– ‘মেরে খাবো মে যো আয়ে, আকে মুঝে ছেড় যায়ে, উসসে কহো কভি সামনে তো আয়ে,’ বাস্তব কি তার থেকে খুব দূরের? কিছুই বোধহয় অসম্ভব নয়, এই প্রেমে পড়ার মুহূর্তটাতে। তাই যে-মেয়ে বসেছিল আনমনা একা একা, বারিধারায় তারই মনে জন্ম নেয় রোমান্টিকতা।
মেয়েটি ছেলেটির চোখে চোখ রেখে জানতে চায়, বৃষ্টিতে ভিজতে কেমন লাগে? কোথায় যেন ইচ্ছেটার আদানপ্রদান হয় দুজনের মধ্যে। ভিজতে হবে আজই, হ্যাঁ। মেয়েটার হাত থেকে ছাতাটা কেড়ে নিল ছেলেটা। তারপর ওরা দুজনে হাত ধরাধরি করে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটল। বৃষ্টি যেন মেয়েটার শৈশব-কৈশোর সব একাকার করে দিল। বর্ষাস্নাত মেয়েটা পেল আশ্চর্য সুন্দর একটা যৌবনের বিকেল। বাড়ি ফিরল মেয়েটা। মনে মনে বারবার আকুতি জানাল। এই বৃষ্টিদিন যেন শেষ না হয়।
আশ্বাসের বৃষ্টি
মনে পড়ে সেই ছবিটার কথা? ‘থোড়া সা রুমানি হো যায়ে’? সে এক আশ্চর্য লোক, বৃষ্টিহীন দিনে বৃষ্টির আশ্বাস নিয়ে এসেছিল এক রুক্ষ কঠিন বাস্তব জমিতে আশার ফুল ফোটাতে। এক বিয়ে না-হওয়া যৌবন ঢলে যাওয়া দিদি, বিপত্নিক বাবা আর হতাশাগ্রস্ত ভাইয়ের সংসারে, এক ফোঁটা বৃষ্টি এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে- এমন আশ্বাস দিয়ে বারিশওয়ালা নানা পাটেকর যখন তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, এমন সময়ই এল বৃষ্টি। এল প্লাবন দিদি আর ভাইয়ের মনে।
এই তো সেদিনের সিনেমা ওয়েক আপ সিড। নায়ক-নায়িকা দুজনেই কর্মসংস্থানের জন্য সংগ্রাম করছে। কেউ একটা ব্রেক পাচ্ছে না। অনেকটা লড়াই-এর পর দুজনেই যখন কাজের সুযোগ পেল, এমন সময় এল বৃষ্টি। বাঁধভাঙ্গা বৃষ্টিতে ওদের গ্লানি মুছে গেল৷ ভাঙা সম্পর্কের দেয়ালটাও।
প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বরষন আনে পরিবর্তন। ঘর্মাক্ত, ক্লিষ্ট-দেহ-মনে বারিধারা আনে শান্তি। চিরজাগরুক করে মানব-মন, উজ্জীবিত করে প্রেম।
কলকাতা শহর ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টিতে। যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল, সেই ছেলে-মেয়ে দুটি নিল একটা ট্যাক্সি। বৃষ্টির জল ট্যাক্সির জানালার কাচে নানা বিভঙ্গ রচনা করছে। বিভঙ্গ তৈরি হয় ট্যাক্সির ভিতরেও। ‘আমি তোমাকে চাই’ একথা বলারও প্রয়োজন নেই। বৃষ্টিবিন্দুগুলো জানালার কাচে লিখে যাচ্ছে প্রেমের উপপাদ্য৷ দুজনের মধ্যেকার আড়ালের বাঁধ ভেঙ্গেছে। আবেগে ভেসে যাচ্ছে ওরা। টাক্সি চলেছে দিকশূণ্যপুর।