একটা সময় ছিল যখন সমস্ত কাজ হতো খাতায়-কলমে। আর এখন খাওয়া-পরার মতোই মানুষের জীবনে সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে প্রযুক্তির ব্যবহার। এখন এমন কাজ খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহার একেবারে নেই। এমনকি সারা পৃথিবীর মানুষের ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য থেকে শুরু করে, পেশাগত জীবন, সবকিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে গিয়েছে প্রযুক্তির বিষয়টি।
তবে প্রযুক্তির নানারকম দিক থাকলেও, মানুষের কাছে সব থেকে বেশি পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত প্রযুক্তির মধ্যে অন্যতম হল ইনফরমেশন টেকনোলজি (IT) বা তথ্য-প্রযুক্তি।
আসলে, যখন থেকে মানবসভ্যতা যন্ত্র-নির্ভর হয়েছে, তখন থেকেই মানুষ জীবনের প্রতিটি কাজের সঙ্গে যন্ত্রের ব্যবহারকে সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে ফেলেছে উন্নতিসাধনের জন্যে। ইন্টারনেট পরিষেবার আমূল পরিবর্তন এবং কম্পিউটার প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির ফলে মানুষ জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে সম্পূর্ণরূপে মেশিনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে ক্রমশ। আর, এই মেশিনের সঙ্গেই আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। আগে একটি কাজ সম্পন্ন করতে অনেক সময় লেগে যেত এবং তা যে সবসময় নির্ভুল হতো, এমনটাও নয়। এর ফলে, অতিরিক্ত সময়, পরিশ্রম এবং অর্থ ব্যয় করতে হতো আমাদের। শুধু তাই নয়, খাতা-কলমের কাজের রেকর্ড রাখাও অনেক সময় মুশকিল হয়ে যেত। আর কর্মক্ষেত্রের এইসব সমস্যার মুশকিল আসান করাটাই ছিল প্রযুক্তির সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ। তাই, লাগাতার চেষ্টার ফলে তথ্য-প্রযুক্তির দ্রুত সাফল্য আনা সম্ভব হয়েছে। এরফলে কর্মক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেতে থাকে কাজের সুযোগ। এক সময় বিশ্বজুড়ে যে ইন্টারনেট বিপ্লব ঘটে, তার থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, কার্যলয়ে না গিয়েও, বাড়ি থেকেই বা পৃথিবীর যে-কোনও জায়গায় বসেই সমস্ত প্রয়োজনীয় কাজ করে নেওয়া যায় অনায়াসে। কোভিড পরিস্থিতি এই বিষয়টিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। এখন যেমন ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর চাহিদা বেড়েছে, ঠিক তেমনই তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কাজের সুযোগও বাড়ছে।
প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ সারা পৃথিবীর সমস্ত পেশার মানুষের সুবিধেও বাড়িয়েছে। এই ক্ষেত্রে তাই কাজের সুযোগও বাড়ছে ক্রমশ। বড়ো ট্যালেন্ট হাবগুলোর মধ্যে কলকাতাও হয়ে উঠছে অন্যতম। কারণ, অগ্রগণ্য মার্কিন টেক কোম্পানি ‘মান্টিক’ এবার পা রাখল পূর্ব ভারতে। এর অঙ্গ হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় এক নতুন অত্যাধুনিক অফশোর ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ODC) খোলা হয়েছে। পুনের পর এটা ভারতে মান্টিকের দ্বিতীয় অফশোর অফিস। এই সংস্থা তার গ্লোবাল ক্লায়েন্টদের পরিষেবা দেওয়ার জন্য কলকাতাকে সবচেয়ে বড়ো ট্যালেন্ট হাব করে তোলার পরিকল্পনা করেছে। এই তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিটি ইতিমধ্যেই কলকাতায় ব্যাপক হারে প্রতিভা খুঁজে নিয়োগ করছে এবং ২০২৩ সাল শেষ হওয়ার আগেই কলকাতা থেকে ৩০০ জনকে নিয়োগ করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছে। এছাড়া প্রতিভার ক্রমবর্ধমান ভাণ্ডার আরও বড়ো করার জন্য এই শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাম্পাস থেকে নতুন প্রতিভা তুলে আনার দিকেও জোর দিচ্ছে। একইসঙ্গে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কর্মচারী আকর্ষণ করার জন্য এই অগ্রগণ্য টেক কোম্পানি কোভিডের ফলে কাজ সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিতে যে পার্থক্য এসেছে তার সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। যেমন এখন মানুষ বাড়িতে বসে বা নিজের শহর থেকেই কাজ করতে পছন্দ করছেন। এই প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে মান্টিকের লক্ষ্য এমন অভিজ্ঞ কর্মচারীদের আকর্ষণ করা, যারা নিজের এলাকা থেকেই কাজ করতে চায়।
কলকাতার নতুন অফশোর অফিস সম্পর্কে মান্টিক-এর ফাউন্ডার অ্যান্ড সিইও , হ্যারি আয়ার বললেন, ‘পুনের পর কলকাতায় আমাদের দ্বিতীয় অফশোর সেন্টার খুলতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। সিটি অফ জয়ে প্রচুর টেক প্রতিভা রয়েছে, দারুণ কর্মসংস্কৃতি আছে এবং গ্লোবাল অ্যাফোর্ডেবিলিটি ইনডেক্সেও এই শহরের স্থান উপর দিকে। এইসব কারণে আমাদের ধারণা কলকাতা শিগগির গ্লোবাল ক্লায়েন্টদের পরিষেবা দেওয়ার জন্য আমাদের সবচেয়ে বড়ো ট্যালেন্ট হাব হয়ে উঠবে। উত্তর আমেরিকা, কানাডা ও ভারতের মত বিশ্বের প্রধান বাজারগুলোর ফরচুন ১০ ও ফরচুন ৫০০ কোম্পানির সঙ্গে যেসব টেক কোম্পানি কাজ করছে মান্টিক তার মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত বেড়ে চলা কোম্পানিগুলোর অন্যতম। আমরা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মত অন্য ভৌগোলিক এলাকাতেও পা রাখার কথা ভাবছি এবং আরও বেশি নিয়োগের পরিকল্পনা আছে।’
এই সংস্থার কলকাতা সেন্টার হেড এবং গ্লোবাল হেড – ডিজিটাল প্রোসেস অটোমেশন , শীর্ষেন্দু সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, ‘ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বেশ ভালো পরিমাণে পূর্বাঞ্চলের লোকজন কাজ করে। কলকাতায় এই নতুন অফিস চালু করার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল এই অঞ্চলে যে প্রতিভা পাওয়া যায় তা কাজে লাগানো। প্রথম দিকে কলকাতা কেন্দ্র থেকে ডিজিটাল প্রোসেস অটোমেশন (BPM, RPA) অ্যান্ড ক্লাউড সার্ভিসেস, CRM-কে পরিষেবা দেওয়া হবে। পরের কয়েক মাসে অন্য কাজগুলো ধাপে ধাপে চালু করার পরিকল্পনা আছে।’ NDITA-র চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন প্রসঙ্গত জানিয়েছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে আমরা মান্টিককে কলকাতায় স্বাগত জানাই। এখানে আরও ছড়িয়ে পড়তে মান্টিকের আমাদের কাছ থেকে যা যা সাহায্য দরকার হতে পারে, সবই আমরা করব। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সম্প্রসারণ ইতিমধ্যেই সেক্টর ৫-এর যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়েছে এবং আমরা অনবরত এই এলাকার পরিকাঠামোর উন্নতি করে চলেছি। ইতিমধ্যেই আমাদের বেঙ্গল আইটি সিলিকন ভ্যালি হাবে টিসিএস, রিলায়েন্স এবং আদানির মত কোম্পানি আসছে এবং দু’বছর অতিমারীতে কেটে যাওয়ার পর এখন ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।’
‘মান্টিক’ একটি গ্লোবাল সিস্টেমস ইন্টিগ্রেশন কোম্পানি ও কনসাল্টিং ফার্ম। এই ফার্ম ডিজিটাল প্রোসেস অটোমেশন (DPA) বিশেষজ্ঞ, যার মধ্যে পড়ে বিজনেস প্রোসেস ম্যানেজমেন্ট (BPM) এবং রোবোটিক প্রোসেস অটোমেশন (RPA), কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট (CRM) এবং কোম্পানিগুলোকে ডিজিটাল রূপান্তর ও অ্যাপ্লিকেশন আধুনিকীকরণে সাহায্য করা। সল্টলেক সিটি, সেক্টর ৫এ অবস্থিত নতুন কেন্দ্রের উদ্বোধনও হয়ে গেছে । উদ্বোধন করেছেন হ্যারি আয়ার, ফাউন্ডার অ্যান্ড সিইও, মান্টিক, শীর্ষেন্দু সেনগুপ্ত, কলকাতা সেন্টার হেড অ্যান্ড গ্লোবাল হেড – ডিজিটাল প্রোসেস অটোমেশন, আনন্দ ঝা, ডিরেক্টর, স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্সেজ, পেগাসিস্টেমস, দেবাশিস সেন, নবদিগন্ত ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনশিপ অথরিটি (NDITA)-র চেয়ারম্যান এবং কল্লোল ঘোষ, ফাউন্ডার, অফার ইন্ডিয়া। ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক এই গ্লোবাল তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি আমেরিকার সবচেয়ে দ্রুত বেড়ে চলা কোম্পানিগুলোর অন্যতম এবং সারা পৃথিবী মিলিয়ে এর কর্মীসংখ্যা এখন ৫০০+। ২০২১-২২ আর্থিক বর্ষে মান্টিকের বাৎসরিক বৃদ্ধির হার ১২%। ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং দ্রুত ডিজিটাল অ্যাডপশনের ফলে এই ফার্ম ২০২৩ আর্থিক বর্ষে বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ হয়ে ২০%-২২% -এ পৌঁছবে বলে আশা করছে। তাছাড়া মান্টিক ইনকর্পোরেটেড ২০২৩ সাল শেষ হওয়ার আগেই সারা বিশ্বে কর্মীসংখ্যা বাড়িয়ে ১০০০ করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে।