নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন ভায়োলেন্স আর ভয় এই দুইয়ে সম্মুখে পড়লে বাচ্চাদের সবচেয়ে বেশি মানসিক ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি হয়। এই পরিস্থিতিতে, অভিভাবক হিসাবে আমাদের উচিত বাচ্চাদের এমন একটি পরিবেশ দেওয়া, যাতে শিশুরা কোনওরকম হিংসা এবং ত্রাসের শিকার না হয়। কিন্তু এটা মুখে বলা যতটা সহজ, কার্যক্ষেত্রে ঠিক ততটাই কঠিন। এর মূল কারণ হল সামাজিক অবক্ষয়। প্রতিদিন খবরের কাগজে তাই উঠে আসে একাধিক শিশু নির্যাতনের কথা, যৌনহেনস্থা এমনকী ধর্ষণের মতো পাশবিক ঘটনাও। শিশুদের অপহরণ, শিশু পাচার, শিশুদের উপর যৌন অত্যাচার এই বিষাক্ত পরিবেশ থেকে সন্তানকে আগলে রাখাই এখন অভিভাবকদের সামনে একটা বড়োসড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছোটোদের Safety tips শেখানোটা তাই অভিভাবকদের কর্তব্য৷
টিভি বা খবরের কাগজে এমন ঘটনার কথা জানতে পেরে, কোন মা আতঙ্কিত হবেন না? বিশেষ করে তার যদি একটি ৯-১০ বছরের শিশুকন্যা বা পুত্র থাকে, যে নিজের self defence করতে অক্ষম! আজ্ঞে হ্যাঁ শুধু কন্যাসন্তানই নয়, এখন পুত্রসন্তানও সমান ভাবে অসুরক্ষিত। মানুষের মানসিক বিকারের কদর্যতার শিকার হচ্ছে এইসব নিষ্পাপ শিশুরা।
তাই আজকাল অভিভাবকরা তাদের সন্তান-সন্ততিকে শুধু গুড টাচ-ব্যাড টাচ-এর শিক্ষা দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। সুরক্ষাবলয় আরও মজবুত করতে পাসওয়ার্ড-এর প্রয়োগ করতে হচ্ছে বুদ্ধি খাটিয়ে সেই পাসওয়ার্ড অত্যন্ত গোপন রাখতে বলা হচ্ছে শিশুকে। কোনও অপরিচিত ব্যক্তি যদি অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে বাড়িতে আসে এবং শিশুটিকে কোনও খাবার দেয় বা বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে, তাহলে শিশুটি তাকে সেই পাসওয়ার্ড জিজ্ঞেস করবে।মা-বাবার কাছ থেকে ব্যক্তিটি এসে থাকলে সে পাসওয়ার্ড বলতে সক্ষম হবে। নাহলে শিশুকে বুঝে নিতে হবে লোকটি মিথ্যাচার করছে, এতে তার বিপদ হতে পারে।
আসলে বদলে যাওয়া সময়ে সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে এবং শিশু সুরক্ষার কথা ভাবতে গিয়ে মা-বাবা-কেও ইনোভেটিভ হতে হচ্ছে। নয়া কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে। বাচ্চাদের ছোটো থেকেই অ্যালার্ট করা প্রয়োজন। কারণ দুষ্কৃতিরা আমাদের চারপাশেই ভিড়ে মিশে আছে। ছদ্ম ভালোমানুষির সাহায্যে তারা তাদের শিকার ধরতে সদা সচেষ্ট।
সমস্যা সামলাতে হলে
মুশকিল হল বাচ্চারা তাদের সরল বিশ্বাসে ভালো লোক, খারাপ লোক এটা বিচার করতে পারে না। তাই প্রথম থেকেই তাদের বোঝাতে হবে যাতে চট করে অচেনা মানুষকে বিশ্বাস না করে। কিন্তু এটা করতে হবে অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যাতে সে ভয় পেয়ে না যায়। তার প্রয়োজনে মা-বাবা শখসাধ মেটাবে। কিন্তু অচেনা লোকের থেকে কোনও কিছু, বিশেষ করে খাবার জিনিস গ্রহণ না করাই ভালো, এই শিক্ষা দেওয়া জরুরি।
প্রাথমিক ভাবে বাচ্চাদের আত্মরক্ষার উপায়ও শিখিয়ে রাখা উচিত। ক্যারাটে শেখা সব সময় ভালো। একান্ত সে সুযোগ না হলে অন্তত দুষ্কৃতি তার হাত চেপে ধরলে, সে যাতে জোরে চিত্কার করে লোক জড়ো করতে পারে সেটুকু তাকে শেখানো দরকার। বাড়িতে এই প্র্যাকটিস বাবা-মা-কে করাতে হবে। তার উপর অচেনা ব্যক্তি জোরজবরদস্তি করলে, প্রয়োজনে কামড়ে বা খিমচে নিজেকে তার কাছ থেকে মুক্ত করতে হবে। তত্ক্ষণাৎ সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যেতে হবে, এটাও শিক্ষারই অঙ্গ।
বাচ্চার ব্যাগে প্রয়োজনে চিলি স্প্রে-এর মতো Safety device দিয়ে রাখুন। খুব বিপদে পড়লে বাচ্চা যাতে সেটা ব্যবহার করতে পারে, তার প্র্যাকটিসও করিয়ে রাখুন।
আজকাল ভিডিয়ো-র মাধ্যমে বাচ্চাদের গুড টাচ ব্যাড টাচ-ই শুধু নয়, তার শরীরের কোন কোন অংশ তাকে বিপদে ফেলতে পারে, তা-ও বোঝানো হয়। ৭-১০ বছরের বাচ্চাদের বোঝার মতো এই ভিডিয়োগুলি বাবা-মাকেই দেখাতে হবে সন্তান বা সন্ততিকে। কেউ যদি তার শরীরের ডেঞ্জার পযে্টস স্পর্শ করে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদস্বরূপ চিত্কার করা এবং ফাঁকা জায়গা থেকে সরে ভিড়ের জায়গায় সুরক্ষিত ভাবে এসে দাঁড়ানোর শিক্ষা দিতে হবে। ছেলে বা মেয়ে দুজনেই কিন্তু এখন ভালনারেবল একথা ভুললে চলবে না। তাই এই ট্রেনিং পুত্র এবং কন্যা উভয়কেই দিন।
শিক্ষা প্রণালীতে পরিবর্তন
এক সময়ে অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের, আঁকা, নাচ, গান, আবৃত্তি শেখানোতেই আগ্রহী হতেন। কিন্তু এখন সেল্ফ ডিফেন্স শিক্ষা আবশ্যিক হওয়া উচিত। স্কুলের কারিকুলামেও এটা যুক্ত হওয়া উচিত বলে মনে করা হচ্ছে। ৫ বছর বয়স থেকে ১০ বছর পর্যন্ত এই শিক্ষা যদি ছেলেমেয়েদের দেওয়া যায়, তারা আর অসুরক্ষিত থাকবে না বলে মনে করছেন অভিভাবকদের একাংশ।
এবার প্রায়োরিটি সেট করতে হবে অভিভাবকদেরই যে, কন্যাকে কোনটা আগে শেখাবেন ক্যারাটে না ভারতনাট্যম। কোনও কোনও পরিবার শিশুকে দুরকমই শেখানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ক্যারাটে-টা ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে পাশে সরিয়ে রাখার দিন আর নেই। ললিতকলার পাশাপাশি শরীর গঠন, আত্মরক্ষার উপায় শেখা এখন সমান জরুরি। এটাই সময়ে চাহিদা।
সন্তানের ফিটনেস-এর প্রতি এখন মা-বাবারা সজাগ দৃষ্টি রাখেন তাই যোগ ব্যায়াম, সাঁতার, টেবিল টেনিস বা ক্রিকেট শেখানো হয়, বাচ্চাদের ক্ষিপ্রতা বাড়ানোর জন্য। যে-বাচ্চার !a: যত ভালো, সে বিপদের আঁচ করতে পারে তত তাড়াতাড়ি। চটজলদি মাথা ঠান্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুণও তৈরি হয় খেলাধুলো করলে। তাই বাচ্চা ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছে, কম্পিউটার বা ফোন নিয়ে সারাদিন সময় নষ্ট করছে দেখলেই সতর্ক হোন। কোনও অবস্থাতেই তাকে অলস হয়ে যেতে দেবেন না। আউটডোর অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে যুক্ত করুন। কোনও না কোনও খেলাধুলোর সঙ্গে যুক্ত থাকলে, সে মানসিক ভাবে চনমনে যেমন থাকবে, তেমন শারীরিক ভাবেও দৃঢ় হবে। তার মধ্যে অ্যালার্টনেস বাড়বে। এর পাশাপাশি ক্যারাটে ক্লাসে গেলে, তার আত্মরক্ষার উপায়গুলোও জানা হয়ে যাবে।
বাচ্চাদের সঙ্গে সংযোগ রাখুন
মা-বাবা যতই ব্যস্ততার জীবনশৈলী মেইনটেন করুন না কেন, বাচ্চার সঙ্গে এমন দূরত্ব তৈরি করে ফেলবেন না, যাতে তার ভালোমন্দের বিষয়ে খেয়ালই না থাকে। ওদের সঙ্গে নিয়মিত ভাবে কথা বলুন। ওদের শেয়ার করতে দিন মনের কথা। শাসন বা বকুনির ভয়ে যেন বাচ্চা গুটিয়ে না থাকে। তাই বন্ধুর মতো করে মিশুন। ওর সঙ্গে কোনও অপ্রিয় ঘটনা যদি ঘটে থাকে, বাচ্চা যেন সেটা আপনাকে জানাতে ভয় না পায়, এটা অবশ্যই খেয়াল রাখুন।
আপনার আরও একটু সতর্ক থাকা উচিত বাড়িতে কোন কোন বাইরের লোক যাতায়াত করে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখুন বাচ্চাকে যারা ঘিরে থাকে, ড্রাইভার, কাজের লোক, প্রাইভেট টিউটর প্রমুখ, তাদের কারও সাথে ওর কি কোনও আড়ষ্টতা আছে? জানার চেষ্টা করুন এদের কারও ব্যবহার কি সন্দেহজনক? মনে রাখবেন বাচ্চা যদি আপনার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে পারে তাহলে আপনার অর্ধেক সমস্যা মিটে যাবে।
বাড়ির পরিবেশ যথাসম্ভব বন্ধুত্বপূর্ণ রাখুন। বাচ্চাদের শেখান যাতে কোনও পরিস্থিতিতেই না ভয় পায়। প্রয়োজনে বোল্ড স্টেপ নিতে যেন দ্বিধা না করে। নিঃসংকোচে অন্যায়ে প্রতিবাদ যেন করতে পারে। বাচ্চাদের শরীরের সঙ্গে মনের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখাও জরুরি
বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে। মা-বাবাই প্রকৃত বন্ধু এই শিক্ষাতেই ওদের বড়ো করে তুলুন। খারাপ-ভালোর বোধ তাহলে ছোটো থেকেই তৈরি হয়ে যাবে। মা-বাবাকে আদর্শ করে সন্তান। তাই অবশ্যই নিজেরাও সংযত জীবনযাপন করুন।