বুকে জল জমার অসুখটি নতুন নয়। এই অসুখের কথা অনেকের মুখ থেকেই শোনা যায়। কিন্তু মজার কথা হল এই যে, সবার মুখ থেকেই দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা পদ্ধতির কথা শোনা যায়। সিরিঞ্জ নিড্ল দিয়েই চেস্ট-ওয়াটার বের করেন অধিকাংশ চিকিৎসক এবং এই পদ্ধতিতে বারবার জল বের করেও, চেস্ট জলমুক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর এই সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি যখন পুরোপুরি সাফল্য পায় না, তখনই চেস্ট-টিউবের সাহায্য নেওয়া হয়। প্রসঙ্গত এই অসুখটি সম্পর্কে আরও অনেককিছু জানা গেল সম্প্রতি।

বুকে জল জমার বিষয়ে বিশদে জানাবেন?

চেস্টের মধ্যে যদি শুধু জল জমে তাহলে চিকিৎসা পরিভাষায় বলা হয় ‘হাইড্রোথোরেক্স’। আবার যখন জলের পরিবর্তে রক্ত সঞ্চিত হতে থাকে চেস্টে, তখন সেই সমস্যাটিকে ‘হিমোথোরেক্স’ এবং ফ্লুয়িড জমলে বলা হয়  ‘চিলোথোরেক্স’। এইসব পদার্থ লাং এবং চেস্টের মাঝের ওয়ালে জমলে শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা তৈরি হয়। আর লাং অ্যাক্টিভেট অর্থাৎ সংকোচন প্রসারণ হতে যে ফাঁকা জায়গার প্রয়োজন হয়, সেই জায়গাটিকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলে ‘প্লিউরাল স্পেস’।

সাধারণত ফুসফুসের বাহ্যিক আচ্ছাদন-ই অল্প পরিমাণে জমে থাকা জলের হাত থেকে বাঁচায়। কিন্তু অনেকসময় চেস্ট এবং অ্যাবডোমেন-এর পার্টিশন ওয়ালের গহ্বর দিয়ে অ্যাবডোমেন ওয়াটার চলে আসে চেস্টে। আর তখন থেকেই চেস্টের সমস্যা তৈরি হয়। তবে সুস্থ স্বাভাবিক থাকাকালীন আমাদের চেস্ট অল্প পরিমাণ জল শোষন করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু জলের পরিমাণ বেড়ে গেলেই বিপত্তি।

কেন জল জমে বুকে?

আমাদের দেশে বুকে জল জমার প্রধান কারণ হিসাবে দায়ী করা যায় টিউবারকুলার ইনফেকশন বা টিবি সংক্রমণ-কে। এই ধরনের সংক্রমণের ফলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় চেস্টে। গাঢ় হলুদ-রঙা জল দ্রুত জমতে থাকে এবং যে তীব্রতায় এই জল জমে, সেই তীব্রতায় চেস্টের ইনার ওয়াল সমস্ত জল শোষণ করতে পারে না। ফলে শুরু হয় সমস্যা। আর সময়মতো যদি এই টিউবারকুলার ইনফেকটেড ওয়াটার না বের করে দেওয়া হয়, তাহলে এই অসুখটি জটিল রূপ নেয়।

সময়মতো চিকিৎসা না করালে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?

দীর্ঘদিন বুকে জল জমে থাকলে ক্যান্সারও হতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণত তিন ধরনের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রথমটি লাং ক্যান্সার, দ্বিতীয়টি ব্রেস্ট ক্যান্সার এবং তৃতীয়টিকে বলা হয় লিম্ফনোড ক্যান্সার। এর পাশাপাশি, লিভারের সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

বুকে জল জমেছে বোঝা যাবে কীভাবে?

-প্রতি সন্ধ্যায় গায়ে জ্বর অনুভব করা।

-ওজন কমে যাওয়া।

-শ্বাসকষ্ট এবং চেস্টপেন হওয়া।

-কাশির সঙ্গে কফ উঠা।

-ঝাঁকুনিতে চেস্ট থেকে গার্গেল করার মতো শব্দ শোনা হওয়া।

-চেস্ট-এর দুদিক ভারী-ভারী লাগা।

চিকিৎসা শুরু করা উচিত কীভাবে?

যদি কাশির সঙ্গে শ্লেষ্মাযুক্ত কফ ওঠে এবং চেস্টপেন হয়, তাহলে প্রথমে চেস্ট এক্স-রে করাতে হবে। কারণ চেস্ট এক্স-রে থেকেই বোঝা যাবে এই অসুখ কতটা জটিল আকার ধারণ করেছে। যদি সত্যিই বুকে জল জমে থাকে, তাহলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে চেস্টের আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষার প্রয়োজন। আর ওই পরীক্ষা থেকে যদি বোঝা যায় বুকে ৩০০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার জল জমেছে, তাহলে চিকিৎসার বিষয়ে চেস্ট সার্জনের পরামর্শ নিতে হবে। অবশ্য বুকের জমা জল যদি আয়ত্তে থাকে তাহলে অ্যান্টি-টিউবারকুলার মেডিসিন দিয়ে রোগমুক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। তবে প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, বুকের জল নিকাশের জন্য সিরিঞ্জ নিড্ল ব্যবহার করা খুব রিস্কি। যদি আল্ট্রাসাউন্ড কিংবা সিটি-গাইড না মেনে সিরিঞ্জ নিড্ল ব্যবহার করা হয় তাহলে রক্তক্ষরণ ছাড়াও, অন্যান্য সমস্যা হতে পারে।

বুকের জল নিকাশের জন্য চেস্ট-টিউবের ব্যবহার-ই কি সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি?

যদি ৪০০ মিলিলিটারের বেশি জল জমে থাকে বুকে, তাহলে থোরাসিস সার্জেনের সঙ্গে পরামার্শ করে চেস্ট-টিউবের সাহায্যে জল নিকাশের ব্যবস্থা করা উচিত। কারণ এই পদ্ধতির চিকিৎসা অনেক ঝুঁকিহীন এবং চিন্তামুক্ত রাখে। তবে দুঃখের বিষয় হল এই যে, ভারতবর্ষে চেস্ট-টিউবের সাহায্যে বুকের জল নিকাশ করেন খুব কম চিকিৎসক। এখনও সেই পুরোনো পদ্ধতিতে সিরিঞ্জ নিডলের সাহায্যেই জল নিকাশ করতে দেখা যায় অধিকাংশ চিকিৎসককে।

চিকিৎসার পরে কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত?

বুকের জল নিকাশের পরে, চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী অ্যান্টি-টিউবারকুলার মেডিসিন সেবন করে যেতে হবে। কারণ চেস্ট-কে পুরোপুরি জলমুক্ত করতে এবং সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে, অ্যান্টি-বায়োটিকের সাহায্য নিতেই হবে। এরই পাশাপাশি, মাঝেমধ্যে থোরাসিস সার্জেন-কে দিয়ে চেক-আপ করিয়ে নিতে হবে।

চেস্ট-কে জলমুক্ত করার পরও কি সমস্যা দেখা দিতে পারে?

চেস্ট-টিউব দিয়ে জল বের করার পর, সাধারণ রোগীর ক্ষেত্রে খুব বেশি সমস্যা হয় না। কিন্তু ক্যান্সার পেশেন্টের ক্ষেত্রে বুকের জল নিকাশের পরও আবার জল জমতে থাকে। তাই ক্যান্সার পেশেন্টের চেস্টের জল জমার সমস্যা দূর করতে ‘প্লিউরোডেসিস’ নামক স্পেশাল টেকনিকে ট্রিটমেন্ট করতে হবে। এই টেকনিকে এক বিশেষ ধরনের ওষুধ প্রয়োগ করতে হয় রোগীর শরীরে। তবে সব ধরণের চিকিৎসার পরও যদি ফুসফুসের অবস্থা ভালো না থাকে, তাহলে থোরাসিস সার্জনের সঙ্গে পরামর্শ করে লাং-এর ক্ষতিগ্রস্থ অংশ প্রয়োজনে কেটে বাদ দিতে হবে। আর তা যদি না করা হয়, তাহলে অন্য সুস্থ ফুসফুসটিও সংক্রামিত এবং বিকল হতে পারে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...