রাকেশের সঙ্গে তিতলির প্রেমটা যে জমে ক্ষীর হয়েছে, সেটা কলেজের প্রায় সবাই জানে।  বড়োলোক বাপের একমাত্র ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়ের সামনে যে একটা বড়ো কিউ থাকবে- সেটাই স্বাভাবিক। সেই লম্বা কিউ টপকে রাকেশ তিতলির মন জিতে নিয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেই তিতলি-ভক্তের দল রাকেশকে ঈর্ষা করে। রাকেশ অবশ্য সেটাকে বেশ উপভোগ করে।

তিতলির মন জিততে কম ঘাম ঝরাতে হয়নি রাকেশকে! তিতলি, জেদ আর অহংকারে ভরপুর। কিন্তু রাকেশও নাছোড়বান্দা। আর মন দিয়ে লেগে থাকলে কী না হয়! তবে রাকেশের বাবাও একেবারে ফ্যালনা নয়। তিতলির বাবার মতো বড়ো শিল্পপতি না হলেও ফেলে ছড়িয়ে খারাপ রোজগার করেন না।

কলকাতার বুকে দুটো শীতাতপনিয়ন্ত্রিত জুয়েলারি দোকান। আরও একটা খোলার চেষ্টা করছেন যাদবপুরে রাকেশের জন্য। কিন্তু রাকেশের দোকানদারিতে তেমন ইচ্ছে নেই। ও ম্যানেজমেন্ট পড়তে চায় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিতলিরও সেটাই পছন্দ।

খবরটা তিতলির বাবা সুনীলবাবুর কানেও উঠেছে। তিনি দেমাকি মানুষ হলেও অকারণে কাউকে নেগলেক্ট করেন না। সিনেমার টিপিক্যাল বড়োলোক বাপের মতো সবাইকে ফকির বলা তাঁর অভ্যাস নেই। কারণ তিনি নিজেও একদিন প্রায় ফকিরই ছিলেন। ইচ্ছে আর চেষ্টা থাকলে সাধারণ মানুষও যে অনেক উপরে উঠে আসতে পারে, এটা তিনি মানেন।

মেয়ের আচরণই মাঝে মাঝে তাঁকে খুব কষ্ট দেয়। একমাত্র মেয়ে বলে ছোটো থেকেই প্রাচুর্যের চূড়ান্ত। আর এই অক্লেশে সবকিছু পাওয়াটা ওর মধ্যে একটা দম্ভ এনে দিয়েছে। এর জন্য ওর মাকে দায়ী করলেও নিজের দোষ পুরোপুরি এড়িয়ে যান না সুনীলবাবু। টাকা রোজগারের নেশায় তিনিই বা কতটুকু সময় দিয়েছেন মেয়েকে?

মল্লিকার উপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে নিশ্চিন্ত থেকেছেন। মল্লিকা যে এভাবে মেয়েকে অহংকারী বানিয়ে ছেড়েছে, জানার পর প্রতিবাদ করেছিলেন সুনীলবাবু। মল্লিকা মানেননি এসব অভিযোগ। উলটে অনুযোগের সুরে বলেছিলেন, আহা, আমরা পাইনি বলে কি ও এসব পাবে না?

সুনীলবাবু কী জবাব দেবেন এই কথার! পাওয়া আর কষ্ট করে পাওয়ার তফাতটা কে বোঝাবে ওকে?

কথাটা কানে আসার পরেই লোক লাগিয়েছিলেন সুনীলবাবু। কলকাতা শহরে গোপন খবর সংগ্রহ করার অনেক গোয়েন্দা সংস্থা গজিয়েছে এখন। টাকার বিনিময়ে কাজ করে দেয়। এরকমই একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছেন সুনীলবাবু। ওরা যে-রিপোর্ট দিয়েছে তাতে খুব একটা অখুশি হননি। ছেলেটার বাবা বেশ অবস্থাবান। ছেলেটা একটু বদমেজাজি আর একগুঁয়ে, বন্ধুবান্ধব-সঙ্গ খুব একটা সুবিধার নয়। নেশা করার অভ্যাস আছে।

সিক্রেট গোয়েন্দা সংস্থার কর্ণধার নবীন সামন্ত এইসব বর্ণনা দেওয়ার পাশাপাশি কিছুটা উপদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতেই বললেন, একবারে নিরামিষ ছেলে কোথায় পাবেন স্যার? যেমন চলছে চলতে দিন। আমরা গোপনে নজর রেখে যাব। সেরকম কোনও খবর থাকলে সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে অ্যালার্ট করে দেব।

সুনীলবাবু হাসলেন। বিড়বিড় করে বললেন, দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা!

—কিছু বললেন স্যার?

—মনে রেখো, এতে আমার মেয়ের জীবন জড়িয়ে আছে। টাকা ইনকামের জন্য ওকে ব্যবহার করলে ফল কী হবে তুমি ভালো করেই জানো। বড়োলোক বাপের একমাত্র মেয়ে কিছু ছেলের সফ্ট টার্গেট। তুমি শুধু এটুকুই ক্লিয়ার করে দাও– এই ছেলেটি ওই টাইপের কিনা। বাকিটা আমি বুঝে নেব।

—ওকে স্যার। আমি টাইম টু টাইম আপনাকে রিপোর্ট দিয়ে যাব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

 

দুই

তিতলির মধ্যে ছেলে খেলানো বাতিক না থাকলেও সন্দেহপ্রবণতা যথেষ্ট আছে। আর আছে অন্যের উপর নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার অভ্যাস। রাকেশ অবশ্য দুটোতেই মানিয়ে নিয়েছে। ভালো-মন্দের তিতলি এখন শুধুই তার। তাই কেউ তিতলির পিছনে ঘুরঘুর করলে খেপে যায় রাকেশ। আরও বেশি রেগে যায় যখন দেখে তিতলিও তাদেরকে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দিচ্ছে। অথচ রাকেশের পিছনে কোনও মেয়ে এলেই তিতলির মুখ বেজার। তখন হাজার কৈফিয়ত দিতে হয় রাকেশকে। কেন এসেছিল? কী দরকার ছিল? ইত্যাদি ইত্যাদি। বড়ো অদ্ভুত এই মেয়ে!

একদিন রাকেশ রেগে গিয়ে বলেই ফেলল, দিস ইজ নট ফেয়ার। আমার সাথে কোনও মেয়ে কথা বলতে পারে না? তুমি যে সেদিন চিকুর সাথে অতক্ষণ কথা বললে, আমি কিছু বলেছি?

—তোমার সঙ্গে কোনও মেয়ে কথা বললে আমার হিংসে হয়।

—আর তুমি চিকুর সাথে কথা বললে আমার যে হিংসে হয়, তার বেলা?

—ছেলেদের হিংসে করতে নেই।

—হিংসে করার আবার নিয়ম আছে নাকি?

—আমি অতশত জানি না। যা বলেছি তাই করবে, ব্যস।

রাকেশ অবশ্য আর ঘাঁটায়নি তিতলিকে। মানিয়ে গুছিয়ে এই প্রেম পর্বটুকু চালিয়ে নিতে পারলেই সে এমন এক নারী সম্পদের অধিকারী হবে, যে-নারীকে বহু পুরুষ কামনা করে। যার গুণের পূজারি বহু পুরুষ।

যে-সম্পদের মূল্য বহু মানুষ দেয়, তা হস্তগত করার মধ্যে একটা অন্যরকমের আনন্দ আছে। সেকথা ভাবলেই একটা আত্মতৃপ্তি অনুভব করে রাকেশ।

তিতলির গুণ হল খুব সুন্দর গানের কন্ঠ ওর। ওর গানের ফ্যান শুধু কলেজেই নেই, বাইরেও আছে। তিতলির গান নিয়ে রাকেশও স্বপ্ন দেখে। ওর খুব ইচ্ছে ওকে একবার নামকরা রিয়ালিটি শো-তে নাম দেওয়াবে। রাকেশ নিশ্চিত, তিতলি এক চান্সে অডিশন পাশ করে যাবে। কে জানে তিতলি হয়তো একদিন হয়ে উঠবে ভারতের এক নম্বর প্লেব্যাক সিঙ্গার। এসব কথা তিতলিকেও শোনায় রাকেশ। শুনে তিতলি এক্সাইটেড হয়ে পড়ে। নামযশ কে না চায়! রাকেশকে আরও বেশি করে ভালোবাসতে থাকে তিতলি।

এমন করে কে তার জন্য ভেবেছে? এই ভাবে ভাবনায়, চাওয়া-পাওয়ায় জড়িয়ে থাকার নামই কি ভালোবাসা? অদ্ভুত এক মিষ্টি অনুভতিতে ছেয়ে যায় তিতলির মন। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে সবাইকে, শুধু বাবাকে বাদ দিয়ে৷ লোকটার ব্যাবসা আছে, টাকা আছে, বউ আছে কিন্তু রোমান্স নেই। যেন চৈত্র মাসের রোদে পোড়া মাঠ! মা যে কেমন করে লোকটার সঙ্গে সংসার করছে ভগবানই জানে!

তবে বাবা যে মনে মনে তিতলিকে খুব ভালোবাসে সেটা জানে তিতলি। রোদে পোড়া মাঠের ভালোবাসা৷ সে জিনিস বুঝতেও কষ্ট হয়। বাবার স্বভাব নারকোলের মতো। ওপরটা শক্ত, ভিতরটা শাঁসালো।

 

তিন

ভালোই চলছিল সব। প্রেম সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে। একটু অন্যরকম ঘটে গেল এবারের ভ্যালেনটাইনস ডে তে। বেমক্কা কে যেন একটা গোলাপ আর গ্রিটিং কার্ড ঢুকিয়ে রেখেছিল তিতলির ব্যাগে। কার্ডটিতে সুন্দর হাতে লেখা ছিল আই লাভ ইউ। তিতলি নিশ্চিত ছিল, ওটা রাকেশেরই দুষ্টুমি। নইলে কলেজে আর কার এত সাহস হবে?

কিন্তু রাকেশ যখন সিরিয়াস মুখে বলল ও রাখেনি তখন তিতলি একটু অবাক হল। পরক্ষণেই মনে হল, রাকেশ অভিনয় করছে না তো? কিন্তু এবার রাকেশ রেগে উঠতেই নিশ্চিত হল ওর কাজ নয়। তবে কে? রাকেশের রাগ খুব বাজে। কোনও কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। বিপদ বুঝে তিতলি ওকে থামানোর চেষ্টা করে বলল, ছেড়ে দাও তো, কেউ হয়তো মজা করেছে।

রাকেশ খেপে আগুন, এই ধরনের ইয়ার্কি করার সাহস কার হল আমি দেখেই ছাড়ব। ঠিক খুঁজে বের করব আমি। একটু শিক্ষা তো দিতেই হবে। তুলকালাম বাধিয়ে দিল রাকেশ। পুরো কলেজে শোরগোল পড়ে গেল। দেখার জন্য দর্শকও জুটে গেল অনেক।

তিতলি বিরক্ত হয়ে বলল, অনেক হয়েছে এবার থামো। এসব পাত্তা না দিলেই তো মিটে যায়।

রাকেশ বলল, ব্যাপারটা আমার ক্ষেত্রে ঘটলে তুমি কিন্তু ছাড়তে না। আমিও ছাড়ব না। এসব দেওয়ার অর্থ কেউ তোমাকে ভালোবাসে। আমি সহ্য করব না সেটা। আমাকে জানতেই হবে। তোমারও দেখা দরকার।

তিতলি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল রাকেশের দিকে। এ যেন এক অন্য রাকেশ! রাকেশের এই রূপ কি অন্ধ ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি? এতটাই ভালোবাসে রাকেশ তাকে, ধূলিস্মাৎ করে দিতে পারে প্রতিপক্ষকে? এই ভালোবাসা কতটা গ্রহণযোগ্য বুঝে উঠতে পারল না তিতলি। অসহায়ের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কলেজে রাকেশের অনুগামীর সংখ্যা অসংখ্য। তাদের কয়েজনকে গুপ্তচরবৃত্তির দায়িত্ব দিল রাকেশ।

কালপ্রিট ধরতে বেশি সময় লাগল না। রাকেশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী অঙ্কুশ রাকেশকে আড়ালে ডেকে বলল, যেটুকু সন্ধান করেছি তাতে মনে হচ্ছে কাজটা পরমব্রতর। যদিও কনফার্ম নই। তুই একটু বাজিয়ে দেখতে পারিস।

রাকেশের নির্দেশে তুলে আনা হল পরমব্রতকে। রাকেশ বিচিত্র কায়দায় ওকে জিজ্ঞাসা করল, কাজটা তুই করেছিস? হ্যাঁ না না?

পরমব্রত জড়ানো গলায় বলল, না মানে হ্যাঁ…

পরমব্রতকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অতর্কিতে ভিমরুল কামড়ানো ষাঁড়ের মতো ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাকেশ। এলোপাথাড়ি কিল-চড়-ঘুসিতে রক্তাক্ত করে দিল পরমব্রতকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরমব্রত প্রত্যাঘাত করার সুযোগ পেল না, চেষ্টাও করল না। নীরবে রাকেশের মারগুলো হজম করে গেল। বিপদ বুঝে আশেপাশের সবাই সরিয়ে দিল রাকেশকে। কারণ রোগা পাতলা পরমব্রতকে আর বেশি আঘাত করলে কোনও অঘটন ঘটে যেতে পারে, এই আশঙ্কা হল অনেকেরই। পুরো ঘটনায় ভীষণ বিরক্ত লাগল তিতলির। চুপিসাড়ে সে চলে গেল বাড়িতে।

রাতে রাকেশের ফোন এল, আই অ্যাম সরি বেবি। একটা বাজে ঘটনার জন্য পুরো দিনটা মাটি হয়ে গেল। সত্যিটা তো দেখলে নিজের চোখে। আমাদের মাঝখানে কেউ ঢোকার চেষ্টা করলে আমি এমনই হাল করে ছাড়ব। তা সে যেই হোক। তুমি আমার, স্রেফ আমার। এই চক্করে তোমাকে উইশই করতে পারিনি, এখন করছি। হ্যাপি ভ্যালেনটাইনস ডে। ছোট্ট একটা উপহার আছে তোমার জন্য। রামুদার কাছে দিয়ে এসেছি। তোমাদের বাড়ি ঢুকতে বারণ করেছ তুমি। যাকগে নীচে নেমে নিয়ে নিও। আই লাভ ইউ।

তিতলি শুনে গেল শুধু। রাকেশ তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তিতলিও কি অতটাই ভালোবাসে রাকেশকে? এতটা পাগল হতে পারবে রাকেশের জন্য? কোনও মনের মতো উত্তর এল না ভিতর থেকে। উলটে একটা প্রশ্ন উঠে এল, এই পাগলামির খুব কি দরকার ছিল? তিতলি তো কবেই ওকে মনপ্রাণ দিয়ে দিয়েছে।

 

চার

মাসখানেক পর হঠাৎ একদিন অঙ্কুশের ফোন পেয়ে অবাক হল তিতলি। অঙ্কুশ বলল, তোমাকে একটা খুব জরুরি কথা বলার ছিল তিতলি। একটু সদানন্দ পার্কে আসতে পারবে? রাকেশকে কিছু জানিও না। আরও অবাক হল তিতলি। কী এমন কথা বলতে চায় অঙ্কুশ, যেটা রাকেশ জানলে চলবে না? অঙ্কুশ রাকেশের বেস্ট ফ্রেন্ড। সেই রাকেশকে কী লুকোতে চায় অঙ্কুশ?

সদানন্দ পার্কে বসে অঙ্কুশ বলল, পরমব্রত চলে যাচ্ছে, জানো?

তিতলি অবাক হয়ে বলল, না। ও চলে গেলে তোমার কী? তোমার কীসের টেনশন?

মাথা নীচু করে অঙ্কুশ বলল, ঠিক টেনশন নয়। বিবেকের দংশন বলতে পারো। এমন একটা পরিস্থিতি যে, কাউকে খুলে বলতেও পারছি না। সামান্য একটা ঘটনা যে এই রূপ নেবে কে জানত? বড়ো একটা ব্লান্ডার হয়ে গেছে তিতলি।

তিতলি ভীষণ কৌতুহল নিয়ে তাকাল অঙ্কুশের দিকে, কী হয়েছে একটু খুলে বলবে প্লিজ?

অঙ্কুশ বলল, সেদিন পরমব্রত নয়, তোমার ব্যাগে গোলাপ আর কার্ডটা আমি রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম এবার একটু অন্যরকম মজা করব। পরমব্রতর সাথে কনসাল্ট করেই প্ল্যান করেছিলাম। ঠিক ছিল আমি ইচ্ছে করেই পরমব্রতর নাম বলব। কারণ পরমব্রত কলেজের সবচেয়ে ল্যাভেনডিশ ছেলে। আমরা নিশ্চিত ছিলাম তোমরা কিছুতেই বিশ্বাস করবে না। তারপর ধীরে ধীরে সব রহস্য ফাঁস করব। কিন্তু…

তিতলি মাথায় হাত দিয়ে বলে উঠল, আর ইউ ম্যাড? তুমি জানো না রাকেশের রাগ কেমন? শান্ত একটা ছেলেকে মার খাওয়ালে? ছিঃ ছিঃ। পরমব্রতটাই বা কেমন, একটুও প্রতিবাদ করল না, নিজের চোখেই তো দেখলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেল। তুমি তো এগিয়ে গেলে না সঙ্গে সঙ্গে?

—ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। রাকেশ যে অতটা হিংস্র হয়ে উঠবে ভাবতে পারিনি। এগোতে এগোতেই তো… দেখলেই তো সব।

—এতদিন পরে এসব বলছ আমাকে? সেদিনই বলতে পারলে না?

—শুনলে অবাক হবে, পরমব্রতই না করেছিল কাউকে কিছু বলতে। বলেছিল, যা হয়েছে তা নিয়ে আর জলঘোলা করে লাভ নেই, এতে নাকি তোমাদের সম্পর্কের ক্ষতি হবে। অদ্ভুত ছেলে! আমিও ভেবেছিলাম চেপে যাওয়াই ভালো। কিন্তু…

—কিন্তু কী?

—রাকেশ যে ভিতরে ভিতরে অন্য এক কাণ্ড করে বসে আছে তা তো আমি জানি না।

—কী করেছে রাকেশ?

—শিলিগুড়িতে পরমব্রতর মাকে ফোন করে যা তা বলেছে। এমনকী জানে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। পরমব্রতর বাবা নেই। বিধবা মা ভয় পেয়ে ওকে কলেজ ছাড়িয়ে শিলিগুড়ি নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

—তুমি রাকেশকে বোঝাওনি?

—সে চেষ্টা কী আর করিনি? সব শুনে রাকেশ হেসে বলল, ওকে যেতে দে, মিচকে শয়তান একটা। ও যদি সৎ হতো তাহলে চুপ করে না থেকে প্রতিবাদ করত। ওর মনে পাপ আছে।

—এটা রাকেশ ঠিকই বলেছে। ওর একবার প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। তোমার কী মনে হয়?

—ও এরকমই। সব দোষ আমার। ওকে এসবের মধ্যে জড়ানোই আমার ভুল হয়েছে। এখনও সময় আছে। তুমি একটু রাকেশকে বোঝাও। তোমার কথা রাকেশ ফেলতে পারবে না। ও যদি একবার পরমব্রতর মাকে ফোন করে সব খুলে বলে।

—লাভ নেই। রাকেশ কেমন গোঁয়ার তুমি ভালো করেই জানো। পৃথিবী উলটে গেলেও ও ওর ইগো থেকে সরবে না। আমি একটু পরমব্রতর সঙ্গে কথা বলতে চাই, তুমি ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?

—এ আর বেশি কথা কী। কালকেই ব্যবস্থা করে দেব।

 

পাঁচ

লাজুক প্রকৃতির শান্ত স্বভাবের ছেলে পরমব্রত। শরীরী ভঙ্গিমাতেও কোনও তেজিয়ান ভাব নেই। মাথা নত করে বেঞ্চের এক কোণায় বসে আছে। তিতলির কেমন জানি মায়া হল। একে মারার কী এমন দরকার ছিল রাকেশের?

তিতলি সরাসরি বলল, আমি সব শুনেছি পরমব্রত। তুমি সেদিন ওভাবে সব মেনে নিলে কেন? চিৎকার করে প্রতিবাদ তো করতেই পারতে। তোমার তো কোনও অন্যায় ছিল না। তবুও…

পরমব্রত মৃদু হেসে বলল, তুমি এখনও ওসব ধরে বসে আছো? আমি তো কবেই ভুলে গেছি। আর এখান থেকে চলে যাওয়ার কথাই যদি বলো, রাকেশের ভয়ে নয়, আমি মায়ের জন্য যাচ্ছি। মা খুব ভয় পেয়েছে।

—এভাবে কেন যাবে? মাকে বোঝাও। রাকেশকে আমি বোঝাব। তুমি তো পড়তেই এসেছ, এভাবে মাঝপথে চলে গেলে একটা বছর লস হবে। তোমার মা-ও সেটা বুঝবেন। কত কষ্ট করে উনি তোমার পড়ার খরচ চালান আমি সব শুনেছি।

—আমারই ভালো লাগছে না।

—কেন? কিছু একটা লুকোচ্ছ তুমি। জানি রাকেশ তোমাকে যে-অপমান করেছে, সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

—না না, রাকেশের ব্যাপারটা আমি একদম ভুলে গেছি। ও যেটা করেছে ওর দৃষ্টিতে ঠিকই করেছে। তোমাকে ও খুব ভালোবাসে। তাই করেছে। আসলে আমার নিজেকে কেমন জানি অসহায় লাগছে। ভয় নয়। অদ্ভুত এক অসহায়তা। বলে বোঝানো মুশকিল। আমাকে যেতে দাও তিতলি।

—ঠিক আছে যাও। কিছু বলার নেই আমার। যাওয়ার আগে একটু বলে যাও কেন তুমি যাচ্ছো? নইলে সারা জীবন তোমার কাছে অপরাধী থেকে যাব আমি। রাকেশ যদি তোমার অপরাধী হয়, তাহলে আমিও সমান ভাবেই তোমার অপরাধী।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল পরমব্রত। খানিকক্ষণ মনের যুদ্ধ সেরে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, বেশ। যাওয়ার আগে আমার একটা কনফেশন করে যাওয়া দরকার। মনে শান্তি পাব। আশা করি এর মধ্যে তোমার প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে যাবে।

বিস্ময়মাখা চোখে তাকাল তিতলি। মুখে অবশ্য কিছু বলল না। পরমব্রতের উত্তরের অপেক্ষায় চুপ করে রইল।

পরমব্রত মাথা নীচু করে বলল, হয়তো শুনে তোমার খুব খারাপ লাগবে এখন আমি যা বলব। কিন্তু সত্যি তো সত্যিই, সেটাকে স্বীকার বা অস্বীকার যাই করি একই থেকে যায়। তোমার অসংখ্য গুণমুগ্ধ ভক্তের মধ্যে আমিও একজন। হ্যাঁ, আজ তোমার সামনেই স্বীকার করে নিচ্ছি। কিন্তু সবদিক থেকেই আমি তোমার এতটা অযোগ্য যে তোমার কাছে ঘেঁষার দুঃসাহস করতে পারিনি। অথচ তোমাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসার কোনও অভাব আমার হয়নি।

তুমি আমার ভালোবাসার রাজকন্যা হয়ে আমার অন্তরে থেকেছ সব সময়। তাই তো রাকেশের সঙ্গে তোমার রিলেশনে আমার কোনওদিন কষ্ট হয়নি। অঙ্কুশ যেদিন গোলাপ আর গ্রিটিং কার্ড দেওয়ার পরিকল্পনা জানাল- কী জানি অদ্ভুত এক আনন্দ হয়েছিল আমার। মনে হয়েছিল, কে যেন অদৃশ্য এক সুতো দিয়ে তোমার সঙ্গে আমাকে বেঁধে দিচ্ছে… থামল পরমব্রত।

তিতলির কেমন জানি ঘোর ঘোর লাগছিল। এসব কী শুনছে? এ কোনও রূপকথার অলীক গল্প?

পরমব্রত আবার শুরু করল, ওরা যখন আমাকে রাকেশের সামনে এনে হাজির করল, কী জানি কী যে হয়ে গেল আমার মধ্যে! রাকেশের কথার কী উত্তর দেব, নিজেও ভেবে পেলাম না। রাকেশ আক্রমণ করল। আমি আত্মরক্ষার চেষ্টা তো করতেই পারতাম কিন্তু করিনি। করতে দিল না কেউ। আমার অন্তরে সেই সময় যে-অনুভতি এসেছিল তার কথা বললে তুমি আমাকে নির্ঘাত পাগল ভাববে। আমার মধ্যে একটা প্রশ্ন জেগে উঠেছিল।

—কী প্রশ্ন? অস্ফুটে বলল তিতলি।

—কোন সত্যটা বলব রাকেশকে? আমি গোলাপ ও গ্রিটিং কার্ড রাখিনি এটা যেমন সত্য, তেমনি আমি যে অন্তর থেকে তোমাকে ভালোবাসি, সেটাও তো সত্যি। রাকেশ তো আমাকে ওই দুটো জিনিস রাখার জন্য আক্রমণ করেনি। করেছিল আমি তোমাকে ভালোবাসি সেই সন্দেহে। এই চরম সত্যটা কোনও ভাবে তো এল! তা সে যত খারাপ ভাবেই হোক। তাই আমি মিথ্যেটা বলতে পারিনি।

মার খেতে খেতে আমার মনে হয়েছিল আজ আমার মরে যেতেও কষ্ট হবে না। কেমন বেহায়া পাগল আমি, তাই না তিতলি? যাইহোক তুমি এসব গায়ে মেখো না। পাগলে তো কত কিছুই বলে, কত কিছুই করে। আমি চাই না তোমাদের সুন্দর সম্পর্কের ওপর কারও নজর পড়ুক। ভালোবাসা তো একতরফা হয় না।

তিতলি অবাক হয়ে তাকাল পরমব্রতর দিকে। এসব কী ওর মনের কথা? মনে মনে এত কথা তৈরি হয়? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। বিড়বিড় করে বলল, তোমার প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করছে না?

পরমব্রত ফিকে হাসি হাসল শুধু। কোনও উত্তর দিল না। তিতলির মনে হল, এই পৃথিবীতে এরকমও বোধহয় কিছু মানুষ থাকে যারা এসব তুচ্ছ প্রশ্নের উর্ধ্বে থাকে। পরমব্রতর সবটুকুই যেন এইমুহুর্তে দেখতে পাচ্ছে তিতলি। এই স্বচ্ছ দৃষ্টিশক্তি আগে কোনওদিন ছিল না তার। পরমব্রতও কি একই ভাবে দেখতে পাচ্ছে তাকে? কেমন জানি শীত শীত করতে লাগল, অসহায় বোধ হল তিতলির।

 

ছয়

এসব ভাবনার ঘোরেই দু’দিন কেটে গেল তিতলির। ঘর বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে রইল মনজগতে। বাবা মা দু’জনেই অবাক হল তার এই আচরণে। বন্ধুদের নিয়ে হইচই করে কাটানো মেযোর হলটা কী! কিন্তু মুখে কেউ কিছু বলল না। একসময় তিতলি নিজেই বেরিয়ে এল সেই জগৎ থেকে। অঙ্কুশের সঙ্গে দেখা করে বলল, তোমার একটু হেল্প চাই অঙ্কুশ, করবে?

অঙ্কুশ বলল, অফকোর্স করব। বলো কী করতে হবে?

তিতলি যেটা বলল সেটা শুনে অঙ্কুশ আঁতকে উঠে বলল, উরে বাপ! এর কী রিয়্যাকশন হবে বুঝতে পারছ? রাকেশকে তো তুমি ভালো করেই চেনো। যা তা কাণ্ড ঘটিয়ে দেবে।

তিতলি শান্ত গলায় বলল, আমি পরমব্রত নই অঙ্কুশ। শুধু যেটা বললাম তুমি সেটা করে দাও। তোমার কোনও ভয় নেই। বাকিটা আমি সামলাব।

অনেক লড়াই করেছে ক’দিন তিতলি। নিজের মনের সঙ্গেই লড়াই। এমন লড়াই জীবনে কোনওদিন করেনি। লড়াই করতে গিয়ে বুঝেছে, একটা মানুষের মধ্যে আরও অনেক মানুষ থাকে। লুকিয়ে থাকে। তাদের দেখা যায় না। সময়মতো জেগে ওঠে। লড়াই করতে করতেই শুনতে পেয়েছে অন্তরাত্মার টান!

রাকেশের কাছে সে শুধুই বড়োলোক বাপের লোভনীয় সুন্দরী মেয়ে, যে শুধু ওর স্টেটাস বাড়াবে। সেই মেয়ের ওপর আধিপত্য বিস্তার করাই ওর লক্ষ্য। সেই আধিপত্য স্থাপন করতে গিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে নিজের নখ-দাঁত বের করা বীভৎস রূপ। একে ভালোবাসা বলে না। ভালোবাসার রূপ অন্যরকম। মায়ামাখা। না দেখলে হয়তো কোনওদিন জানতেও পারত না।

পরমব্রতকে একদিন একটা গোলাপ দিয়ে বলল, হ্যাপি ভ্যালেনটাইনস ডে।

পরমব্রত অবাক হয়ে বলল, সে তো পেরিয়ে গেছে কবে…

তিতলি বলল, কে বলল? তোমার গোলাপ সেদিন নিয়েছি। আজ আমারটা দিলাম। আর এখান থেকে যাবে না কথা দাও। তোমার মাকে আমি ফোন করে সব বলেছি। তুমি বললেই তিনি মেনে নেবেন।

—কিন্তু রাকেশ?

রাকেশকে মনে হয়েছিল আকাশ। কিন্তু রাকেশ আকাশ হতে পারেনি। এই রাকেশকে আমি চিনি না।

নবীন সামন্ত চরম উত্তেজিত হয়ে বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে স্যার। তিতলি তো রাকেশকে ছেড়ে পথের এক ফকিরের প্রেমে পড়ে গেছে! চালচুলোহীন একটা ছেলে। শিলিগুড়ি বাড়ি। মা প্রাইমারি স্কুলের দিদিমণি। বাবা নেই। দু’কাঠার একটা দোতলা বাড়ি ছাড়া কিছুই নেই। তবে ছেলেটা পড়াশোনায় বেশ ভালো। এমন একটা ছেলের সঙ্গে…

মাঝপথে থামিয়ে দিলেন সুনীলবাবু, আমি এ খবরটি আগেই পেয়ে গেছি নবীন। তিতলির এক বন্ধু ফোন করে সব জানিয়েছে। তিতলির আচরণেও কিছুটা বুঝছিলাম, সামথিং ইজ রং। তবে তোমার ভয় নেই। তোমার কাজ যাচ্ছে না। তুমি থাকছ। তবে এবার দায়িত্বটা একটু অন্যরকম হবে।

নবীন সামন্ত অবাক হয়ে বললেন, কীরকম স্যার?

সুনীলবাবু বললেন, তোমাকে দেখতে হবে ওই রাকেশ নামের ছেলেটা যেন তিতলি বা পরমব্রত নামের ছেলেটাকে কোনও রকম ডিসটার্ব করতে না পারে। সেরকম কিছু দেখলেই আমাকে জানাবে, তা সে যখনই হোক। মনে থাকবে তো?

হেবলুর মতো মাথা নেড়ে নবীন সামন্ত বললেন, ইয়েস স্যার।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...