সম্প্রতি কলকাতা প্রেস ক্লাব-এ আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে, বিশ্ব স্ট্রোক দিবস উপলক্ষ্যে, ব্রেন স্ট্রোক-এর রোগীদের বাঁচানোর ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। প্রসঙ্গত তাঁরা জানিয়েছেন, হাই ব্লাড সুগার, কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপে ভোগা ব্যক্তিদের ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা সবসময় বেশি। আগে ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা থাকত প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১ জনের। এখন সেটা প্রতি ৪ জনের মধ্যে ১ জনে নেমে এসেছে। এই বিপুল বদলের প্রধান কারণ হল খারাপ জীবনযাত্রা এবং খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসে বদল।
যাইহোক, চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন, স্ট্রোক হওয়ার ৪.৫ ঘন্টার মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা খুব জরুরি, কারণ তারপর স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। যার ফলে সম্পূর্ণ পক্ষাঘাত, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। স্ট্রোকের রোগীদের জন্য এই ‘গোল্ডেন টাইম’ যেহেতু ভীষণ জরুরি, তাই যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে অ্যাডমিট হওয়া জরুরি। শুধু তাই নয়, এমার্জেন্সি চিকিৎসক, নিউরোলজিস্ট, নিউরো-রেডিওলজিস্ট এবং ক্যাথ-ল্যাব টেকনিশিয়ান-এর সহায়তায় তৎক্ষণাৎ উপযুক্ত চিকিৎসা পরিষেবা নেওয়া দরকার। এ বিষয়ে মনে রাখা দরকার, স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা গেলেই একটা ‘কোড স্ট্রোক’ ঘোষণা করা হয়, যা অবিলম্বে রোগীকে দেখার সংকেত হিসাবে কাজ করে। রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে সিটি স্ক্যান করতে নিয়ে যাওয়া হয়, তারপর প্রয়োজন অনুযায়ী মেডিকাল বা ক্লিনিকাল চিকিৎসা করা হয়।
এ বিষয়ে অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটালস কলকাতার নিউরোলজি ডিপার্টমেন্ট-এর ডিরেক্টর ডা. অমিতাভ ঘোষ জানিয়েছেন, স্ট্রোক হয় দু’রকমের– -ইসকিমিক স্ট্রোক এবং হেমারেজিক স্ট্রোক। ইসকিমিজ স্ট্রোক-এর ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের একটা অংশে রক্ত সঞ্চালন কমে গিয়ে সেই এলাকার ব্রেন টিস্যুগুলো অকেজো হয়ে যায়। আর হেমারেজিক স্ট্রোক-এর ক্ষেত্রে ব্রেন টিস্যু, ভেন্ট্রিকল বা দুটোতেই হঠাৎ রক্তক্ষরণ হয়। দু’রকম স্ট্রোকই ব্রেন সেলগুলোর ক্ষতি করে। কারণ, সেগুলো রক্ত সঞ্চালন থেকে বঞ্চিত হয়। তবে এখন চিকিৎসার ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা যায়, তাহলে ব্রেন সেলের স্থায়ী ক্ষতি আটকানো সম্ভব। চারজন মানুষের মধ্যে একজনের জীবনের যে-কোনও সময়ে স্ট্রোক হতে পারে এবং সেটার চিকিৎসা না হলে স্থায়ী পঙ্গুত্ব, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।’
অ্যাপোলো মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটালস, কলকাতা-র এমার্জেন্সি মেডিসিন-এর সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. অরিজিৎ বোস জানিয়েছেন, ‘যখন কোনও রোগীর ইসকিমিক স্ট্রোক হয়, তখন প্রত্যেকটা সেকেন্ড মূল্যবান। কারণ, রক্ত সঞ্চালন কম হলে ব্রেন টিস্যুগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। প্রত্যেক মুহূর্তে ব্রেন টিস্যুর এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয় বলে অ্যাকিউট ইসকিমিক স্ট্রোকের লক্ষণগুলো তৎক্ষণাৎ জানা যায়।’
অ্যাপোলো কলকাতা-র ইন্টারভেনশনাল নিউরো-রেডিওলজিস্ট বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. নির্মাল্য রায়, জানিয়েছেন, ‘আগে স্ট্রোকের চিকিৎসা মানে ছিল শুধু ওষুধপত্র আর ফিজিওথেরাপি। কিন্তু চিকিৎসায় প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এখন ক্যাথ ল্যাবে এন্ডোভাস্কুলার থেরাপি, এমনকি লার্জ ভেসেল অক্লুশনের ব্যবস্থাও করা যায়। যান্ত্রিকভাবে ক্লট বার করে দেওয়ার নতুন পদ্ধতি চালু হওয়ার ফলে এখন অনেক সুবিধে হয়েছে। এই চিকিৎসা ৬ ঘন্টা পর থেকে ২৪ ঘন্টা পর্যন্তও এমন কিছু কিছু রোগীর উপর প্রয়োগ করা যায়, যাঁদের ওতে লাভ হবে। এই নতুন চিকিৎসায় রোগীর কুঁচকি বা কবজিতে একটা সূঁচের মত গর্ত করে সেখান দিয়ে ক্লটটাকে হয় সাকশন দিয়ে অথবা একটা স্টেন্টের সাহায্যে বার করে আনা যায়। এই প্রোসিডিওর যত তাড়াতাড়ি করা যায়, রোগীর সেরে ওঠার সম্ভাবনা তত বেশি থাকে।’
এই উপলক্ষ্যে অ্যাপোলো কলকাতা-র ডিএমএস ডা. সুরিন্দর সিং ভাটিয়া জানিয়েছেন, ‘ব্রেন স্ট্রোকের লক্ষণগুলো খুব প্রকট। যেমন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা, মাথাব্যথা বা মাথা ঘোরা, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া, মুখের একটা দিক, হাত বা পা ঝুলে পড়া, দুর্বলতা, কথা বলতে সমস্যা। কারওর স্ট্রোক হয়েছে কিনা বোঝা খুব সহজ এবং তাকে স্ট্রোকের চিকিৎসার উপযুক্ত কেন্দ্রে অর্থাৎ ২৪ ঘন্টা ক্যাথ ল্যাব সাপোর্ট এবং নিউরোলজিস্ট আর নিউরো-ইন্টারভেনশনিস্টদের দল আছে এমন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। কারণ, একজন রোগীকে মেরে ফেলতে পারে একটা কার্ডিয়াক অ্যাটাক । কিন্তু একটা ব্রেন স্ট্রোক শুধু একজন রোগী নয়, একটা আস্ত পরিবারকে বিপদে ফেলতে পারে রোগীর পঙ্গুত্বের কারণে। সুতরাং আপনার স্ট্রোকের চিকিৎসার উপযুক্ত কেন্দ্র সম্পর্কে জেনে রাখুন।’