স্থানীয় একটি সংস্থার গাড়ি বুক করে ঘুরে আসি কাছেপিঠে। পাহাড়ি আলোছায়ার পথ উজিয়ে মিরিক, গোপালধারা চা-বাগিচা, সীমানা ভিউ পয়েন্ট, মানেভঞ্জন, সুখিয়াপোখরি, ঘুম, বাতাসিয়া লুপ। শীতের শিহরণ, পাহাড়ছোঁয়া হিমেলবাতাস চা বাগানের সবুজ, নতুন ভাবে মন ও চোখকে জিরেন দেয়।

বাদামতাম: আমাদের গন্তব্যে আরও এক অনবদ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ঠেক কার্শিয়ং থেকে ৪৫.৭ কিলোমিটার দুরত্বে বাদামতাম। হিলকার্ট রোড ধরে খারিয়া বস্তি, সিপিয়াঝোরা চা-বাগান, রংবুল ইত্যাদি পেরিয়ে দার্জিলিংকে পাশ কাটিয়ে লেবং রোড ধরে পাহাড়ি বসতি, চা-বাগান, লেবং রেসকোর্স, দুধারে ছোটো ছোটো গ্রাম পাশে নিয়ে বাদামদাম বলে দারুণ এক স্থান। আদপে এটি বাদামদাম টি এস্টেট। কার্শিয়ং দার্জিলিংয়ে মতো ব্যস্ত শহরের থেকে দূরে নির্জনতার স্পর্শ এনে দিতে সদা সহায়ক।

দার্জিলিং এলাকার চাবাগানগুলির মধ্যে সেরা চাবাগানের একটি, ১১.৯৯৫ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই বাদামতাম। চা-বাগানটি ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ জমানায় পত্তন হয়। এখানে ইদানীং সম্পূর্ণ জৈব প্রক্রিয়ায় ও পদ্ধতিতে চা প্রস্তুত করা হয়। বাদামতাম বাজার থেকে পথের বাঁদিকে তাকালেই চোখে পড়বে বাদামতাম টি ফ্যাক্টরি। বিশেষ অনুমতিসাপেক্ষে চা কারখানাটি দেখেও নেওয়া যায়।

লেপচা শব্দ বাদামতাম মানে হল, বাঁশ নির্মিত জলের বাহক। চারিদিক সবুজ বদলে বদলে যাওয়া পাহাড়। প্রায় প্রতিটি ধাপেই চা-বাগান। নিসর্গ আর সৃষ্টির প্রহরে বহুরৈখিক সবুজের চিত্র। মাঝে মাঝে পাহাড়ি গ্রাম্য বসতবাড়ি। এসবের মাঝে নীরবতা ভাঙছে পাখির কলতান। সবুজ উপত্যকা চিরে বয়ে চলেছে রঙ্গিত ও রংদুং খোলা নামের নদীদ্বয়। মাঝহিতারে এসে নদী দুটি মিশেছে। ভারি মনোরম এবং নিঝুম পুরো এলাকাটি।

নদীর ওপরে সেই ব্রিটিশ যুগের তৈরি ঝুলন্ত সেতু। সেতুর ওপারে সিকিমের রংপো। এপারে পশ্চিমবঙ্গের মাঝহিতার। গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত নয় এই সেতু। তাই পায়ে হেঁটেই সেতু পেরিয়ে বিদেশের স্পর্শ পেতে রংপো ঘুরে আসা যায়। গেলামও। এদিকটায় কিছু দোকানপাট, বাজার, ঘরবাড়ি নিয়ে সিকিমের গ্রামটি ভারি সুন্দর। ওদিকে রয়েছে খড়ের ছাউনি দেওয়া মাচা করা বাদামতাম নজরমিনার। বসার জন্য কাঠের গুঁড়ি কেটে বানানো প্রাকৃতিক বেঞ্চ।

নীল আকাশের সীমানা জুড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার হাসিমুখ আর একরাশ হিমেল হাওয়াটুকুই যথেষ্ট। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে এত অপরূপ দেখায়। এখানে বাদামতাম মঠে ১৪ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। ওদিকে দুপুর গড়িয়ে এসেছে। এখানে বাদামতাম হোমস্টে-তে মধ্যাহ্ন আহার সেরে এবার কার্শিয়ং অভিমুখে।

পাইন, শাল, ওয়ালনট, কনিফার, লালিগুরাস বা রডোডেনড্রন, ফার্ন, লিচেন গাছগুলির ফাঁক গলে খেলা করছে রূপসি কার্শিয়ং ও কাঞ্চনজঙ্ঘা। অপলক চেয়ে থাকি স্বপার্ষদ কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে। প্রকৃতির অমোঘ কারসাজিতে মাঝেমাঝেই ভোল পালটাচ্ছেন তারা। মেঘেদের লুকোচুরি খেলা পাহাড়ভূমে যেমন চলে আর কী!

কখনও মেঘ-কুয়াশায় মুড়ে নিচ্ছেন নিজেদের, তখনই আমাদের মন উশখুশ করতে শুরু করেছে কী করেনি, পরক্ষণেই মেঘের চাদর সরিয়ে পাহাড়শ্রেণির খানিকটা অংশে রোদের ঝিলিক। আবার উধাও। অফুরান দৃশ্যাবলীর কথা জমতে থাকে।

শৌখিন কফি কাপে চুমুক দিয়ে ডায়ারি খুলে লিখতে বসি। আজ সারাদিনের কার্শিয়ং বেড়ানোর গল্প। হাতে আমার তখনও ধূমায়িত কফিকাপ। আমার সজাগ ক্যামেরা দিশেহারা হয় প্রকৃতির সারল্যে। যেন এই আমি আর আমার পর্যটন মুহূর্তগুলোই সত্য।

কীভাবে যাবেন: কলকাতা থেকে বাস বা ট্রেনে শিলিগুড়ি বা নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে, সেখান থেকে ভাড়া গাড়ি বা শেয়ার জিপে সোজাসুজি কার্শিয়ং চলে যাওয়া যায়। বিমানপথে গেলে বাগডোগরা বিমানবন্দর। অনেকসময় হোটেলে বলা থাকলেও হোটেল কর্তৃপক্ষ স্টেশন বা বিমানবন্দরে মূল্যের বিনিময় গাড়ি পাঠিয়ে দেন।

কোথায় থাকবেন: কার্শিয়ং শহরে থাকার জন্য বেশ কয়েটি মহার্ঘ্য হোটেল রিসর্ট ছাড়াও নানা বাজেটের হোটেল রয়েছে। এছাড়া হোমস্টে, লজ, গেস্টহাউসও রয়েছে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...