নির্জন রাস্তার ওপর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছি। আমার আয়ু বড়োজোর আর কিছুক্ষণের। ছটফট করার মতো শক্তিটুকুও লোপ পেয়েছে। এই গল্পের নায়ক অন্য কেউ। আমি পার্শ্বচরিত্র মাত্র। আমি প্রীতিশাকে খুব ভালোবেসেছিলাম। ও আমার সঙ্গে একই কলেজে একই বিভাগে পড়ে। বিএ, বাংলা বিভাগ। তবে প্রথম দিন থেকে আমার মনে প্রীতিশার প্রতি ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি হলেও ও অন্য একজনকে ভালোবেসে ফেলেছিল। ছেলেটির নাম স্ময়ন। সে পুরো ক্লাসের চোখের মণি হয়ে উঠেছিল। ওর পার্সোনালিটিতেই এমন কিছু ছিল, যা প্রফেসর থেকে শুরু করে ক্লাসের সহপাঠীদের প্রবল ভাবে আকৃষ্ট করত। অল্প সময়ের মধ্যেই সে আমারও খুব ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। পড়াশোনায়ও সে খুব ভালো। আমিও তার আশেপাশেই নম্বর পেতাম।
প্রীতিশার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বেশ জমে উঠেছিল। বসন্তের মনোরম দুপুরে ক্যান্টিনে বসে ওর সঙ্গে সময় কাটাতে বেশ ভালোই লাগত। সেইসব দিনগুলোর কথা কোনও দিন ভুলব না। আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম আর কয়েকদিনের মধ্যেই প্রীতিশাকে আমার মনের কথা জানিয়ে দেব। তবে ওই যে কথায় আছে, ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। তবে এক্ষেত্রে অন্য কথা আসবে। কপালে নেই তো ঘি, ঠকঠকালে হবে কি? আমার আগেই স্ময়ন বাজি মেরে দিয়েছিল। প্রীতিশা আমারই চোখের সামনে অন্য একজনের হয়ে গিয়েছিল। সেই মুহুর্তে আমার মনের ভেতরটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল।
প্রীতিশা এই ঈশানের জীবন থেকে একটু একটু করে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল। সে কোনও দিনও আমার হবে না, ব্যাপারটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না। আমি মানছি, আমার স্মার্টনেস স্ময়নের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু তাই বলে প্রীতিশা আমার মন বুঝল না, সেটা ভেবেই ভিতরে ভিতরে আমি গুমরে মরছি। না, এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো আমি পাগল হয়ে যাব। আমি মনে মনে ঠিক করলাম— প্রীতিশার সঙ্গে একান্তে কথা বলব। পরের দিন প্রথম ক্লাস শেষ হওয়ার পর ওর কাছে গিয়ে বললাম, “তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে। আমার সঙ্গে ওপরে চল।”
প্রীতিশা আমার পিছন পিছন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করল, “কী কথা? এখানে বলা যায় না?”
“না যায় না।”
আমি ওকে তিনতলার একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে নিয়ে গিয়ে চোখে চোখ রেখে বললাম, “আমি তোকে আজ একটা কথা বলতে চাই। জানি না কথাটা শোনার পর তোর-আমার বন্ধুত্ব টিকবে কি না, কিন্তু আমি যেভাবে কষ্ট পাচ্ছি, তার তুলনায় সেই কষ্ট অনেক কম হবে।”
“ধোঁয়াশা না করে পরিষ্কার করে বল কী বলতে চাস?”
“আমি তোকে খুব ভালোবাসি। কলেজের প্রথম দিন থেকে একটু একটু করে তোর প্রতি যে-ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা অজান্তেই কবে ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আমি তোকে মনের কথা বলব বলব করেও বলতে পারিনি।”
“তবে আজ কেন বলছিস? তুই জানিস আমি স্ময়নকে ভালোবাসি। ক’দিন পরেই আমাদের এনগেজমেন্ট।”
“ক’দিন পর। এখনও তো হয়নি। তবে আটকাচ্ছে কোথায়? কত মেয়ে বিয়ের দিন মণ্ডপ ছেড়ে পালিয়ে যায়। সেখানে তো তোর…”
“পাগলামো করিস না। আমি তোকে কখনও ভালোবাসতে পারব না। কারণ আমি এখন স্ময়নের হয়ে গিয়েছি। তুই তো সব জানিস। তারপরেও তুই কেন এমন জেদ করছিস?”
আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। ঠিক সেই মুহুর্তে নিজেকে সামলানো বড়োই কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমি ওকে কাছে টেনে নিয়ে গালে, কপালে, চোখে চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলাম। প্রীতিশারও ভিতরটা বোধহয় সেই মুহুর্তে উথাল-পাথাল হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মুহুর্ত পর বুঝতে পারলাম আমি বড়ো ভুল করে ফেলেছি। এমনটা করা আমার উচিত হয়নি। প্রীতিশা কিছুক্ষণের জন্য কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারপর কিছু না বলে শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।
আমি বুঝতে পারিনি ঠিক সেই মুহুর্তে আমার কী করণীয় ছিল। তখনও আমি বুঝতে পারিনি আজ রাতে আমার জীবনে এমন মারাত্মক ঘটনা ঘটবে, যা আমাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবে। তবে আমার জীবনই শুধু নয়। তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আরও দুটো জীবন। এক প্রীতিশা, দুই আমার বাবা।
বাবা শ্বাসকষ্টের রোগী। বাবার আজ একটু বেশিই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। ইনহেলার শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাবার এই কষ্ট আমি একেবারেই সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই আমি তড়িঘড়ি করে মেডিকেল শপে ইনহেলার আনতে ছুটে গিয়েছিলাম।
বাড়ি ফেরার রাস্তাটা রাত দশটার পরে জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। সেই সুযোগ নিয়েই আমার সামনে হঠাৎ করে স্ময়ন এসে পড়ে। তারপরই আমার মুখের ওপর এলোপাথাড়ি ঘুষি চলতে থাকে। আর সে বলতে থাকে, “বল, তুই প্রীতিশার সঙ্গে কী করেছিস? ও কেন আজ হঠাৎ করে আমার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করার কথা বলল? তুই ওকে ফুসলিয়েছিস। আমি তোকে ছাড়ব না।”
প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যেও আমার এটা ভেবে সুখ হচ্ছিল যে, প্রীতিশা আমার ভালোবাসা স্বীকার করে নিয়েছে। আমার ভালোবাসা জিতে গিয়েছে। এর থেকে আনন্দ আমার আর কিছুতেই হবে না। ঠিক সেই মুহুর্তে স্ময়ন আচমকা প্যান্টের পকেট থেকে ছুরি বের করে পরপর দুটো কোপ আমার পেটের ওপর মারল। আমি অসহ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে পেটে হাত দিয়ে বসে পড়লাম। সে আমার আর্তনাদ শুনেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চম্পট দিয়েছে।
আমি ওঠার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। বেশ বুঝতে পারছি আমার আয়ু বড়োজোর আর কিছুক্ষণের। তারপর সব শেষ। এই তল্লাটে কেউ নেই যে আমাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে। আমার প্রাণ বাঁচাবে। যখন প্রীতিশা আমার চোখের সামনে অন্যের হয়ে গিয়েছিল, তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। আর আজ যখন ও আমার হয়ে গেল, তখন বাঁচার প্রবণতা আরও বেড়ে যেতে শুরু করল। কিন্তু আমার আয়ু আর ক্ষণিকের, কথাটা ভাবতেই চোখের জলে চারপাশের পরিবেশটা ঘোলাটে হয়ে এল।
আমি রাস্তার ওপর এলিয়ে পড়লাম। চোখদুটো বুজে এলো। ঠিক সেই মুহুর্তেই মনে হল কারা যেন এদিকে ছুটে এসে আমায় টেনে তুলছে, আর বলছে, “ওকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। না হলে ও বাঁচবে না। ভাগ্যিস এ রাস্তায় সিসিটিভি লাগানো ছিল। তাই দেখতে পেলাম কেউ ওর পেটে চাকু মেরেছে।”
ব্যস্, এটুকুই শুনতে পেয়েছিলাম। তারপর জ্ঞান হারাই। হসপিটালে চোখ খুলতেই দেখি প্রীতিশা আমার মাথার কাছে বসে আছে। আমি উঠে বসার চেষ্টা করতেই ও বলল, “ঈশান, এখন উঠিস না। ডাক্তারবাবু রেস্ট নিতে বলেছেন। আর স্ময়নকে আমি পুলিশে দিয়েছি। আমি বুঝতে পারিনি ছেলেটার তলে তলে এই ছিল। আমি ওকে খুব ভালো ভেবেছিলাম। যাই হোক, আমি এখন তোর, শুধুই তোর।”
শেষপর্যন্ত আমি পার্শ্বচরিত্র থেকে গল্পের নায়ক হয়ে গিয়েছি। আর বাবার কাছে ইনহেলারও সময়মতো পৌঁছে গিয়েছিল। প্রীতিশাকেও সারা জীবনের মতো পেয়ে গিয়েছি। একেই বলে হ্যাপি এন্ডিং।