৬টা ৪৫-এ ভদ্রকালী থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হল। হিন্দমোটর ফ্যাক্টরির শর্টকাট রাস্তা দিয়ে গাড়ি রঘুনাথপুরে চলে এল ৭টা নাগাদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্ডিগো ডানকুনি পেরিয়ে এনএইচ-২ ধরে নিল। জাতীয় সড়কের দু’পাশেই সবুজের মেলা— আম, কলা, নারকেল আর কৃষ্ণচূড়া চোখে পড়ছে বেশি। মুকুটমণিপুরের দূরত্ব কম নয়, এনএইচ-২ ধরে প্রায় ২০০ কিমি, আর এনএইচ-১৬ দিয়ে প্রায় ২৩০ কিমি। সময় লাগবে কম করেও সাড়ে ৫ ঘণ্টা।
ড্রাইভার বুম্বা-র বিশ্বস্ত হাতে গাড়ি ছুটছে দুরন্ত গতিতে। রাস্তার বাঁ পাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে কাশফুলের রাজত্ব। ডান পাশে কলকাতা ফেরার রাস্তায় বেশ লম্বা জ্যাম। মশাগ্রাম পার করতেই চলে এল দ্বিতীয় টোলগেট। এরপর শক্তিগড় পেরোলাম। গলসি পেরোলাম, বাঁয়ে মিনিট ২০ পরে “পানাগড় মিলিটারি ক্যাম্প’-এর বিশাল এলাকা শুরু হ’ল। চলে এলাম কোটগ্রামে। ডান দিকে ‘পানাগড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক”-এর এলাকা।
গাড়ি মুচিপাড়া-র রাস্তা ধরল। এখান থেকে বাঁকুড়া আরও ৫৫ কিমি দূরে। বাঁকুড়া রোডের ওভারব্রিজে লম্বা জ্যাম। সাড়ে ১০টা নাগাদ দুর্গাপুর ব্যারেজ— নীচে দামোদর। এখন চলেছি বড়জোড়া রোড ধরে। মিনিট ১০ যাবার পরেই রাস্তার দু’পাশে ঘন জঙ্গল শুরু হ’ল৷ প্রধানত শাল-পলাশের এই বন এখানে পরিচিত ‘তিন মাইলের জঙ্গল’ নামে। ফুলবেড়িয়া পার করে বিনকা, চলেছি এসএইচ-৯ ধরে। আমরা সোজা এগোলাম, আর ডান দিকের রাস্তায় ৩ কিমি এগোলেই বাঁকুড়া টাউন।
কয়েক কিমি এগোতেই আবার জঙ্গল। ধরমপুর পেরিয়ে গেলাম দুপুর সাড়ে ১২টায়। এখন পথের দু’পাশে সবুজ ধানখেত। হাতিরামপুর পেরোতেই আবার দু’পাশে জঙ্গল। বাঁকুড়ায় এত গাছপালা আর জঙ্গল, ভাবলেই মনে আনন্দ জাগে! এবার ডান দিকে বাঁক নিয়ে মুকুটমণিপুরের পথে চলে এলাম। কিছুটা এগিয়েই ‘আরণ্যক রিসর্ট”-এর গেট পেরিয়ে গাড়ি এসে থামল রিসর্টের সবুজ পরিবেশে। গাড়ি থেকে লাগেজ নামিয়ে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট চার-শয্যার ঘরে ঢুকে পড়লাম।
দ্রুত স্নান সেরে চলে এলাম ডাইনিং রুমে। লাঞ্চ শেষ করে ঘর বন্ধ করে গাড়িতে করে চলে এলাম মুকুটমণিপুরের বিশাল জলাধারের কাছে নৌকা বিহারের জন্য। গোড়াবাড়ি অঞ্চলের মুকুটমণিপুর উন্নয়ন পর্ষদ নৌকা বিহার পরিষেবা সমবায় সমিতি লিমিটেড দ্বারা পরিচালিত জেটির কাছে এসে পৌঁছোলাম। নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্ক করে, ১২০০ টাকায় একটি নৌকা বুক করলাম ৩ ঘণ্টার জন্য।
কংসাবতী ড্যামের অথৈ জলরাশির মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলল যন্ত্রচালিত নৌকা। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম, মাটির তৈরি এই ড্যাম দৈর্ঘ্যে ১১ কিলোমিটার, যা নির্মিত হয়েছিল পশ্চিম বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডা বিধান চন্দ্র রায়ের তত্ত্বাবধানে। জলের মাঝে মিষ্টি হাওয়ায় মন-প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। আমাদের প্রথম গন্তব্য ডিয়ার পার্ক। ক্যামেরায় চোখ রাখলে তীরের হদিশ পাওয়া যায় না। দূরে জলরাশির বুকে দেখা যাচ্ছে ৩-৪টি রহস্যময় দ্বীপ। প্রায় ৪০ মিনিট পরে নৌকা এসে ভিড়ল নদীতীরে। আমরা ধীরে ধীরে নেমে এলাম ডাঙায়।
কয়েক মিনিট হেঁটে উঠে এলাম রাস্তায়। বনপুকুরিয়ায় অবস্থিত ডিয়ার পার্ক-এ পৌঁছোতে হবে ভ্যান-রিক্সায় চেপে। অদূরেই টিকিট ঘর, আমরা যাতায়াতের ৪টে টিকিট কেটে চড়ে বসলাম ভ্যানে। নদীতীর থেকে বনপুকুরিয়া গ্রামের দূরত্ব ৩ কিমি। পিচ উঠে যাওয়া রাস্তার অবস্থা ভালো নয়, তবে দু’পাশের সবুজ গাছপালা মনে এনে দেয় এক দারুণ ভালোলাগা। ১০-১২ মিনিটেই পৌঁছে গেলাম ডিয়ার পার্কে। উঁচু জাল দিয়ে ঘেরা পার্ক আর তার মাঝে বেশ কয়েকটি ছোটো-বড়ো, চিতল হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
গ্রামের কয়েকটি ছোটো ছেলেমেয়ে পার্কের বাইরে ৫-১০ টাকায় বিক্রি করছে কয়েক রকম পাতার গোছা, হরিণগুলোকে খাওয়ানোর জন্য। বিক্রেতাদের কাছ থেকে আমরা কয়েক গোছা পাতা কিনে নিরীহ হরিণদের খাওয়ালাম। মিনিট ১০ সেখানে কাটিয়ে আমরা আবার ভ্যানে চেপে ফিরে চললাম নদীর তীরে। নৌকায় উঠে বসতেই মাঝি ইঞ্জিন স্টার্ট করল। এবার চলেছি কংসাবতী ও কুমারী নদীর মোহনায়।