দিল্লির সুস্বাদু কিছু খাবার
দিল্লিতে বাঙালি পাড়াগুলোতে অর্থাৎ চিত্তরঞ্জন পার্ক, নিবেদিতা এনক্লেভ, মহাবীর এনক্লেভ ইত্যাদি জায়গায় বাঙালিদের মোটামুটি প্রায় সব জিনিসই পাওয়া যায়। শুক্তো থেকে চাটনি, মাছ, মাংস, হাঁসের ডিম সবই পেয়ে যাবেন এই বাজারগুলোতে। এমনকী মোয়া, নাড়ু থেকে মোগলাই পরোটা, বিভিন্ন ধরনের চপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি- এসব বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। তাই দিল্লির বাঙালিরা বাংলার খাওয়ার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হন না। এখানে মোচা, মুড়ি, ঝালমুড়ির সাথে সাথে কলকাতার ফুচকাও পাবেন। তবে দিল্লিতে প্রধানত পাঞ্জাবিদের বা উত্তর ভারতের খাবারের প্রাধান্য বেশি, যা একবার খেলে আপনাকে তারিফ করতেই হবে।
প্রথমেই আসি ‘পরোটা’-র কথায়। এখানকার স্থানীয় লোকেরা যখন উচ্চারণ করেন তখন ‘পরোঠা’-র মতো শোনায়। এই পরোটা দিল্লিতে খুবই প্রচলিত একটি খাবার। অনেক লোকই এই পরোটা দিয়ে তাদের সকালের জলখাবার সারেন। এখানে বিভিন্ন ধরনের পরোটা পাওয়া যায়। প্লেন পরোটা থেকে শুরু করে আলুর, ফুলকপির, মুলোর, ডিমের, ডালের ইত্যাদির হয়। সে পরোটা একবার খেলে আপনার মুখে স্বাদ লেগে থাকবে। পুরাতন দিল্লিতে ‘পরোঠাওয়ালি গলি’ খুবই বিখ্যাত ছিল এক সময়ে। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি দোকান সেই গলিতে। পরোটার বিশেষত্ব দেশি ঘি-এর পরোটা বানানো হয় এবং সাথে ছোটো ছোটো বাটিতে দশ-বারো রকমের তরকারি পরিবেশন করা হয়, চাটনি, আচার ইত্যাদির সাথে। মাটির পাত্রে পরোটা ভাজা হয়। আজও সেখানে দেশি ঘিয়ের সাথে বহু ব্যাঞ্জন সহযোগে পরোটা পাওয়া যায়। দিল্লিতে এলে লাচ্ছা পরোটা অবশ্যই একবার চেখে দেখবেন। ভাঁজে ভাঁজে বা পরতে পরতে দেশি ঘি দিয়ে বানানো এই পরোটার স্বাদ আপনার বহুদিন মনে থাকবে।
দিল্লির আরেকটি সুস্বাদু খাবার হল, চাট। এই চাট-ওয়ালাদের কাছে পাবেন, আলুরটিক্কি, দহিভাল্লা, পাপড়ি চাট, গোলগাপ্পা। দিল্লিতে স্ট্রিট ফুডের মধ্যে চাট হল একটি জনপ্রিয় খাবার। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি চাঁদনি চকের স্ট্রিট ফুড খুব বিখ্যাত। যারা দিল্লির চাট খেয়েছেন তারা জানেন, দিল্লির চাটের স্বাদ অতুলনীয়। এ স্বাদ দিল্লির বাইরে আপনি কোথাও পাবেন না। সুস্বাদু আলুটিক্কি সব জায়গায় পাওয়া গেলেও চাঁদনি চকের নটরাজ কাফে এর জন্য খুবই বিখ্যাত।
দিল্লির কয়েকটি জায়গা চাটের জন্য বিখ্যাত, যেমন ইউপিএসসি-র কাছে অর্থাৎ শাহজাহান রোডে, বিটুটিক্কিওয়ালা করোল বাগে, দৌলত কি চাট চাঁদনি চকে এবং নটরাজ দহিভাল্লেওয়ালা চাঁদনি চকে।
আপনি যদি আমিষাশী হয়ে থাকেন তবে দিল্লির ‘বাটার চিকেন’- এর স্বাদ নিতে ভুলবেন না। আজকাল দিল্লির প্রায় সব জায়গাতেই রাস্তার ধারে বা বাজারগুলোতে এ ধরনের খাবারগুলো পেয়ে যাবেন। সাধারণত ভাত বা নান দিয়েই পরিবেশন করা হয়।
দিল্লিতে যেহেতু মোঘলরা রাজত্ব করেছে একসময় তাই তাদের কিছু কিছু খাবার আজও এখানে পাওয়া যায়। তার মধ্যে সুস্বাদু একটি খাবার হল ‘কাবাব’। পাঁঠার মাংস বা মুরগির মাংস বা মাছ দিয়ে বিভিন্ন সুগন্ধিজাত মশলা দিয়ে ম্যারিনেট করে গ্রিলড করে বানানো হয় এই কাবাব। অপূর্ব এর স্বাদ। বহু জায়গায় পনীরের কাবাবও পাওয়া যায়। এই খাবারগুলোও আজকাল প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যায়।
দিল্লির আর একটি নামকরা খাবার হল ছোলে বটুরে (ভটুরে)। এটি খুবই মুখরোচক, মশলাযুক্ত এবং তৈলাক্ত খাবার। দিল্লির মতো ছোলে বটুরে আপনি এই রাজ্যের বাইরে কোথাও পাবেন না, তাই দিল্লিতে এলে প্রাতরাশের তালিকায় এটিকে রাখতে ভুলবেন না। সাধারণত এর সাথে লস্যি পরিবেশন করা হয়। তবে আপনি যদি সস্তায় টিফিন সারতে চান তাহলে আছে কুলচে-ছোলে। এটিও উত্তর ভারতে একটি জনপ্রিয় খাবার।
মোঘলরা আরও একটি খাবার ছেড়ে গেছে, সেটি হল বিরিয়ানি। তবে দিল্লিতে বিভিন্ন জায়গায় বিরিয়ানির স্বাদ আলাদা আলাদা। ধাবার বিরিয়ানির স্বাদ, বড়ো দোকানের বিরিয়ানির স্বাদ এবং পাঁচতারা হোটেলের বিরিয়ানির স্বাদ স্বাভাবিক ভাবেই আলাদা আলাদা হতে বাধ্য। এখানকার বিরিয়ানির বিশেষত্ব হল, এখানে অনেক জায়গাতেই মাটির হাঁড়িতে মুখবন্ধ অবস্থায় বিরিয়ানি পরিবেশন করা হয় যাতে মশলার স্বাদ ও গন্ধ অটুট থাকে। এখানকার বিরিয়ানিতে কিন্তু কলকাতার বিরিয়ানির মতো আলু খুঁজলেও পাবেন না।
দিল্লির রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অনেক জায়গায় হয়তো মাংস এবং মশলার ঘ্রাণ আপনার নাকে ভেসে আসবে। এই মাংসের ঝোলকে স্থানীয় ভাষায় নিহারি-ও বলে থাকেন অনেকে। নিহারি নামে এই মাংসের ঝোল নাকি অনেকক্ষণ ধরে জাল দেওয়া হয়। সাধারণত তন্দুরি রুটি সহযোগে পরিবেশন করা হয়। পুরাতন দিল্লিতে সকাল সকাল রাস্তার ধারে রিকশাওয়ালা, শ্রমিক ইত্যাদিদের ভিড় দেখা যায় এইসব দোকানগুলোর সামনে। যদিও কলকাতা রোলের জন্য বিখ্যাত, তবে দিল্লিতেও বেশকিছু হোটেল এবং রেস্টুরেন্টেও এই কাঠিরোল বিক্রি হয়। এখানে রাস্তার আশেপাশে লেবানিজ মিট ডিস শশুরমা (Shawarma) প্রায় সব জায়গাতেই পাওয়া যায়।
মোমোর সম্পর্কে তো আর বলতে হবে না। মনে হয় সারা ভারতবর্ষে আজকাল মোমো ছেয়ে গেছে। অফিসপাড়ায়, জন্মদিনের পার্টিতে এবং ককটেল পার্টিতেও মোমোর উপস্থিতি দেখা যায়। এখানে ভেজ এবং নন-ভেজ ষ্টিম মোমো ছাড়াও ফ্রাইড মোমো, তন্দুরি মোমো, কুড়কুড়ে মোমো ইত্যাদি আরও অনেক ভ্যারাইটি পাওয়া যায়।
দিল্লির মানুষদেরও বাঙালিদের মতো খাওয়ার শেষে মিষ্টি খাওয়ার একটি অভ্যেস আছে। তাই তাদের বলতে শোনা যায়— খানে কা বাদ কুছ মিঠা হো যায়ে। এখানে ভালো ছানার মিষ্টি হয়তো সব জায়গায় পাবেন না, তবে দেশি ঘিয়ে ভাজা জিলিপি, বিভিন্ন ধরনের আইসক্রিম, রাবড়ি ফালুদা, কাস্টার্ড, আম পাঁপড় (আমসত্ত্ব), দেশি ঘি-এর তৈরি মতিচুরের লাড্ডু, বেসনের তৈরি লাড্ডু, গুলাবজামুন ইত্যাদি খেতেও কিন্তু অত্যন্ত সুস্বাদু।
দিল্লিতে আলুর তরকারির সাথে কচুরিও বেশ সুস্বাদু। তবে এগুলো সব খাস্তা হিং-এর কচুরির মতো। বিশেষ বিশেষ কিছু জায়গা আছে দিল্লিতে যেখানকার কচুরি খেতে বহু দূর থেকেও লোকেদের আসতে দেখেছি। যেমন শেখ সরাই, ফেস-২। দিল্লিতে এসে যদি আপনি কর্ণাটকের বিসি বেলে ভাত খেতে চান তাহলে আপনাকে যেতে হবে রাও তুলা রাম মার্গে, কর্ণাটক সংঘ- র কর্ণাটক ফুড সেন্টার-এ। অন্ধ্র-র ভালো খাবার খেতে হলে চলে যাবেন অন্ধ্র ভবন-এ। সেখানে কম মূল্যে ভালো অন্ধ্রের খাবার পাওয়া যায়। তবে ইডলি, দোসা আপনি দিল্লির সর্বত্রই পাবেন, কারণ দিল্লিতে দক্ষিণ ভারতের লোকও আছে প্রচুর।
দিল্লির কয়েকটি মিষ্টির মধ্যে শোন হালুয়া খুব প্রসিদ্ধ। দেশি ঘি, কর্নফ্লাওয়ার, দুধ এবং স্যাফ্রন ইত্যাদি দিয়ে বানানো হয় এই মিষ্টি। এই মিষ্টিটি বেশ সুস্বাদু এবং দামও অন্যান্য মিষ্টির চেয়ে একটু বেশি।