এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে শহরের দিকে চললাম। পথের বাঁকে বাঁকেই কানাডার বিখ্যাত ‘সেন্ট লরেন্স’ নদীর সঙ্গে দেখা হতে লাগল।

রতন সরকার প্রশ্ন করার আগেই বলতে লাগলাম, ‘এখানের প্রধান নদী সেন্ট লরেন্স। ছেলেবেলায় ভূগোলের বইতে পড়া উত্তর আমেরিকা মহাদেশের পাঁচটি বিশাল হ্রদ-সুপিরিয়র, মিশিগান, হুরণ, ইরি, অন্টারিও-কে মনে পড়ে কি? এই ইরি হ্রদ থেকে উপচে পড়া জল হয়ে গেল বিশাল নায়াগ্রা জলপ্রপাত। প্রায় ১৭২ ফুট নীচে লাফিয়ে পড়ে এই প্রপাত নায়াগ্রা নদীতে একাকার হয়ে যায়। আবার এই বিশাল নদীই পঞ্চম বিশাল হ্রদ অন্টারিওতে নিজেকে মিলিয়ে দেয়। ওদিকে এই অন্টারিও-র উপচে পড়া জল এক বিশাল নদী হয়ে বেরিয়ে পড়ে। এই উপচে পড়া নদীই হল উত্তাল সেন্ট লরেন্স নদী। সেন্ট লরেন্স নদীর পাড়ের আনাচে-কানাচেই বাস করত কুইবেক অঞ্চলের আদিবাসীরা— আবেনাকি, এলগোকুইন, ইনু ইত্যাদি।

কুইবেক শহরের পূর্ব প্রান্তেই রয়েছে সুউচ্চ মন্টমরেন্সি জলপ্রপাত। এই প্রপাতটি প্রায় শহরের মধ্যেই বলা চলে। শহরের এত কাছে বলেই বোধহয় এই সুন্দর জলপ্রপাতটিকে মানায় না। প্রথমেই তাই আমাদের গন্তব্য হল মন্টমরেন্সি জলপ্রপাত। এটি আমেরিকা-কানাডার বর্ডারে অবস্থিত পৃথিবী বিখ্যাত নায়াগ্রা জলপ্রপাতের থেকেও ৯৯ফুট উঁচু। বিশাল গর্জন করে দুই ধারায় মন্টমরেন্সি নদী এক লাফে ২৭২ ফুট নীচে নেমে এসে সৃষ্টি করেছে ভুবন বিখ্যাত মন্টমরেন্সি জলপ্রপাত। নীচে নেমে সমতলের উপর কিছুদূর গড়িয়ে মিশে গেছে সেন্ট লরেন্সে। টিকিট কিনে কেবলকারে চড়ে জলপ্রপাতের একেবারে মাথার উপরে গিয়ে নামলাম। বেশ অনেকটা খাড়া পথ, দ্রুত গতির কেবলকারেই ১১মিনিট লাগল।

বেশ খাড়াই এই কেবল পথ। কেবলকারের হাতল শক্ত করে ধরে থাকতে হয়। ভয় ভয় করছিল কেবলকার উপরের বদলে নীচে না গড়িয়ে আসে! কেবলকার থেকে নেমে পাহাড়ি রাস্তায় সামান্য হেঁটে এসে গেলাম একেবারে জলপ্রপাতের মাথার উপরে। এখানে এক ঝুলন্ত পুলের উপরে দাঁড়িয়ে পায়ের নীচে গড়িয়ে পড়া মন্টমরেন্সি নদীকে দেখে ভীষণ ভয় করছিল। নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠে উপরে আমাদেরও না ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ঠিক পায়ের নীচেই ওই শক্তিশালী নদী গর্জন করতে করতে গড়িয়ে পড়ছিল ২৭২ ফুট নীচে।

কেবলকারে একসঙ্গে আসা কয়েকজন যাত্রী তো ভয়ে পুলের উপরই উঠল না। পায়ের ঠিক নীচে বিপুল গর্জনে বয়ে যাচ্ছিল মন্টমরেন্সি জলপ্রপাত। রতন সরকারও ভয়ে ভয়ে আমার একটা হাত ধরে রেখেছিল। আমরা হেঁটে লোহার পুল পেরিয়ে ওপারে চলে গেলাম। এখানে আছে একটি সুন্দর ফুলফলে ভরা সাজানো বাগান। এই পাড়ে একটি ছোটো টিলা থেকে আঁকাবাঁকা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে, একেবারে জলপ্রপাতের পায়ের কাছে যাবার ব্যবস্থা আছে। কয়েকজন দুঃসাহসী সেই পথে নেমে জলপ্রপাতের পদপ্রান্তে গিয়ে আনন্দ নিচ্ছিল।

রতন তখনও আমার হাত ছাড়েনি। শুনলাম, শীতের সময় এই বিশাল প্রপাত সম্পূর্ণ জমে যায়, তখন দেখলে মনে হবে এক মহান জটাজুটধারী ধ্যানমগ্ন তপস্বী বিশাল আকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর তাঁর পায়ের কাছে ছেয়ে রয়েছে সাদা বরফের টিলার সমারোহ। বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে আবার কেবলকারে চড়ে নেমে এলাম সমতলে।

কুইবেক শহর দু’ভাগে বিভক্ত— পুরোনো কুইবেক আর নতুন কুইবেক। অনেকটা আমাদের নতুন দিল্লি, পুরোনো দিল্লির মতো। শক্ত পাথরের দেয়াল আর উঁচু উঁচু সিঁড়ি আলাদা করে রেখেছে নতুন আর পুরোনো কুইবেক শহরকে। পুরোনো কুইবেক সেন্ট লরেন্স-এর পাড়ে অপেক্ষাকৃত নীচু স্থানে অবস্থিত। ইউনেসকো ১৯৮৫ সালে এই পুরোনো শহরকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ’ বলে ঘোষণা করেছে। পুরোনো কুইবেক পাথরের দেয়ালে ঘেরা সেন্ট লরেন্স নদীর কাছাকাছি অপেক্ষাকৃত নীচু স্থানে গড়ে উঠেছিল, আর নতুন কুইবেক শহর নদী থেকে দূরে উঁচু জায়গায় গড়ে উঠেছে। এখানে আছে হাল ফ্যাশনের হাই রাইজ অট্টালিকার সমারোহ।

পুরোনো কুইবেক ঠিক ইউরোপের পুরোনো শহরগুলির মতো— সরু সরু ঘোরানো পাথর বিছানো রাস্তা আর দু’পাশে সাজানো দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট আর সুভেনির দোকানের ভিড়। পুরোনো কুইবেক শহরে এখনও অতীত যুগের নিদর্শনস্বরূপ ছোটো ছোটো লাল ছাদওয়ালা বাড়ি দেখা যায়। টুরিস্টরা এইসব বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি নেয়। আমরাও নিলাম।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...