ওই ব্রডি’স ক্লোসের খানিকটা ভিতরেই রয়েছে ডিকন ব্রডির পৈতৃক আবাসগৃহ এবং ডিকন ব্রডি’র কর্মশালা। সেই আবাসগৃহে এখনও বসবাস করে ব্রডি পরিবারের উত্তরসূরীরা। ওই ব্রডি’স ক্লোসের পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘ডিকন’স হাউস কাফে’। ওই বাড়ির পাশেই, লন-মার্কেট ও ব্যাংক স্ট্রিটের সংযোগস্থলে অবস্থান করছে ‘ব্যাংক অব স্কটল্যান্ড’-এর আন্তর্জাতিক সদর দফতর। ব্যাংক অব স্কটল্যান্ডের বিপরীত দিকে ব্যাংক স্ট্রিটের যে-পথ সোজা ‘লয়েডস ব্যাংক”-এর প্রধান শাখার অভিমুখে ঢুকে যাচ্ছে, তার কোনায় চোখে পড়ল ‘ডিকন ব্রডি’স ট্যাভার্ন’ (Deacon Brodie’s Tavern)। রাস্তা পার হয়ে পায়ে পায়ে সিঁড়ি দিয়ে বাড়িটার দোতলায় উঠতেই, বুকের ভিতরটা ভারী হয়ে উঠল। নিজের বৈঠকখানার টেবিলের সামনে বসে আছেন হ্যাট পরিহিত ‘ডিকন ব্রডি’।
সে নিখুঁত এক সৃষ্টি। উপরতলার দেয়ালে সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে দু’-খানি কাচের বাক্স। এর মধ্যে যে-সব যন্ত্রপাতি ও চাবিসমূহের সাহায্যে ব্রডি তার পেশাগত কর্ম সম্পাদন করতেন, তার সবটুকু সংরক্ষিত আছে। নীচে নেমে এসে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, একমনে চেয়ে রইলাম, ‘ডিকন ব্রডি’স ট্যাভার্ন’ নামক বাড়িটার গায়ে আঁকা ‘ডিকন ব্রডির’ অবয়ব-সহ সযত্নে লিপিবদ্ধ তার ‘জীবন ও কর্মবৃত্তান্ত’-এর দিকে।
পাঠক বর্গের স্বাভাবিক ভাবেই কৌতূহলের উদ্রেক হবে— কে এই ডিকন ব্রডি! স্কটল্যান্ডের কৃতি সন্তান লেখক, রবার্ট লুই স্টিভেনসনের নাম আমরা সবাই যেমন জানি, তেমনই এটাও জানি ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে (ডিকন ব্রডির মৃত্যুর প্রায় একশো বছর পরে) রচিত তাঁর যুগান্তকারী উপন্যাস স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডক্টর জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড (Strange case of Dr. Jekyll and Mr. Hyde)-এর নাম। যে-চরিত্রের ‘ডাইকোটমি’ (Dichotomy) বা চারিত্রিক বৈপরীত্য দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে রবার্ট লুই স্টিভেনসন এই উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন, তিনি হলেন ‘ডিকন ব্রডি’। আসল নাম উইলিয়াম ব্রডি।
স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরা শহরের ‘রয়াল মাইল’ সড়কের ‘ব্রডি’স ক্লোস্’-এর ভিতরঘরে তাঁর জন্ম হয়েছিল ২৮ সেপ্টেম্বর ১৭৪১ সালে। উইলিয়াম ব্রডি’র বাবা ছিলেন শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং তাঁর পিতামহ ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। কিন্তু উইলিয়াম ব্রডি তাঁর পূর্বসূরিদের পেশা অনুসরণ না করে, বেছে নিয়েছিলেন এক কারিগরি শিল্পীর (Craftsman) পেশা। তিনি ঘরের আসবাব, আলমারি, ক্যাবিনেট প্রভৃতি যেমন বানাতে পারতেন, তেমনই ছিলেন একজন দক্ষ তালাচাবি প্রস্তুতকারক (Locksmith)।
এই পেশার সুবাদে উইলিয়াম ব্রডি’র আসা-যাওয়া শুরু হল শহরের মস্ত মস্ত সব ধনী সম্প্রদায়ের মানুষদের ঘরে। ধীরে ধীরে এইভাবে তিনি যেমন শহরের ধনী, প্রভাবশালী মানুষদের সঙ্গলাভ করলেন, তেমনই প্রচুর অর্থ উপার্জন করার সুবাদে এডিনবরা শহরের নির্মাতা ও স্থপতিদের সংগঠন Wrights and Masons’ Incorporation-এর ‘Deacon’ বা সভাপতিপদ প্রাপ্ত করলেন। নাম হল তাঁর ‘ডিকন ব্রডি’। এর ফলে ‘শহর পরিচালন সমিতি’ বা কাউন্সিল-এর সভ্যপদ লাভ করলেন।
কিন্তু পেশাগত কারণে দিনেরবেলায় যে-সব বাড়িতে তিনি যেতেন, সেই সব বাড়ির মূল ফটক, ধনসম্পদ রাখার ক্যাবিনেটের চাবি বানিয়ে দেওয়ার পরে, মোমের পাতের উপরে সেই চাবির ছাপ তুলে রেখে, পরে তার থেকে নকল চাবি বানিয়ে রাতের অন্ধকারে শহরের ধনীদের ঘরে ঢুকে শুরু করলেন চুরি-ডাকাতি। এইভাবে ১৭৬৮ সালে একটা ব্যাংক-এর দরজার চাবি নকল করে, রাতের অন্ধকারে ব্যাংক-এ প্রবেশ করে লুঠ করলেন আটশ’ পাউন্ড৷
এর মধ্যেই ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে ডিকন ব্রডি’র পিতৃবিয়োগ হয়। এবং মৃত্যুর আগে তিনি দশ হাজার পাউন্ড রেখে যান ডিকন ব্রডি’র জন্য। এই পিতৃধন এবং স্ব-উপার্জিত বিপুল সম্পত্তি তাঁকে সমাজে প্রতিষ্ঠা এনে দিলেও, তা সযত্নে রক্ষা করতে পারেননি ডিকন। ইতিমধ্যেই এডিনবরা শহরে তাঁর দুটি স্ত্রী ও পাঁচটি সন্তান বর্তমান। যদিও সেই স্ত্রী-রা কেউই পরস্পরের সাথে পরিচিত ছিল না।
ডিকন ব্রডি ছিলেন তৎকালীন এডিনবরা শহরের অভিজাত ‘দি কেপ’ (The Cape) ক্লাবের সদস্য এবং তৎসুবাদে ‘স্যার লয়েড’ ছদ্মনামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। এই সুবাদেই শুরু হল, সমাজের নানান প্রতিথযশা ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা। কবি রবার্ট বার্নস, অঙ্কন শিল্পী হেনরি রেবার্ন-এর মতো প্রতিভাধর মানুষেরা ছিলেন ডিকন ব্রডি’র দিনের বেলার সাথি। কিন্তু প্রভূত সম্পত্তি তাঁকে দিনেরবেলায় যেমন আভিজাত্য এনে দিয়েছিল, তেমনই রাতের অন্ধকারে জুয়া, কক-ফাইটিং, মাদকাসক্তিতে ডুব দিতেন। দু-দুটো পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণের পিছনে নদীর স্রোতের মতো অর্থ ব্যয় করতেন ডিকন। আর তাই ক্রমে ক্রমে নিয়মিত ভাবে উপার্জনের নতুন পথ হিসাবে আঁকড়ে ধরলেন, ধনীর ঘরে রাতের অন্ধকারে চুরির পেশা।