রতন সরকার আরও কিছু প্রশ্ন করার আগেই বলতে লাগলাম, ‘মনে আছে কুইবেক সিটি ভ্রমণের সময় দেখেছিলাম ওখানকার প্রধান নদী সেন্ট লরেন্স?’
রতন সরকার চেঁচিয়ে উঠল, ‘হহ কী দারুণ সুন্দর আর খরস্রোতা নদী দাদা।’
ওকে থামিয়ে দিয়ে আমি বলতে লাগলাম — হ্যাঁ, খরস্রোতা কারণ জলপ্রপাত আর পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে এসেছে তাই।
—জলপ্রপাত? এখানে আবার জল প্রপাত কই-থেকা আইল দাদা?
আমি হেসে বললাম, ‘সেই কথাই বলছি শোনো মন দিয়ে।”
—আচ্ছা কন আপনে, বলে রতন মন দিয়ে শুনতে লাগল।
আমি বলতে শুরু করলাম, ‘ছেলেবেলায় ভূগোলের বইতে পড়া উত্তর আমেরিকা মহাদেশের পাঁচটি বিশাল হ্রদ— সুপিরিয়র, মিশিগান, হুরণ, ইরি, অন্টারিও-কে মনে আছে তো? ওরা একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে আছে কোথাও না কোথাও। ওই ‘ইরি’ হ্রদ থেকে উপচে পড়া জল হয়ে গেল বিশাল নায়াগ্রা জলপ্রপাত। প্রায় ১৭২ ফুট নীচে লাফিয়ে পড়ে এই প্রপাত নীচে নায়াগ্রা নদীতে মিশে একাকার হয়ে যায়। আবার এই খরস্রোতা নায়াগ্রা নদীই পঞ্চম বিশাল হ্রদ ‘অন্টারিও’-তে এসে নিজেকে বিলিয়ে দেয়।
আমাকে থামিয়ে দিয়ে রতন এক নিঃশ্বাসে বলে গেল, ‘আবার এই লেক অন্টারিও’র উপচে পড়া জল এক বিশাল নদী হয়ে বেরিয়ে পড়ল। এই উপচে পড়া নদীই হল কুইবেকের উত্তাল সেন্ট লরেন্স নদী, আবার সেন্ট লরেন্স গড়িয়ে গিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দেয় আটলান্টিক মহাসাগরে।”
আমি হেসে ঘাড় নাড়লাম, ‘মনে আছে দেখছি।’
—থাকব না? আপনে একজন প্রবীণ শিক্ষকের ন্যায় শিখাইলেন, ভুলা যায় নাকি? হাসল রতন।
আমিও হাসলাম।
এবার আমরা লেকের বাঁধানো পাড়ে হাঁটতে আরম্ভ করলাম।
সামনে জলের উপর দুলতে থাকা বোটগুলো দেখিয়ে বললাম, ‘বোটে চড়ে লেকের সফর করবে নাকি?”
—অবশ্যই, করব দাদা। নইলে সাত সমুদ্র, নদী-নালা পেরিয়ে আইলাম কেন? পিঠের ব্যাগটা ঠিক করতে করতে বলল রতন। হাঁটতে হাঁটতে রতন প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা এই বিশাল লেকটা কী করে তৈরি হল দাদা?”
আমি ওর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলতে লাগলাম, ‘ভূ-বৈজ্ঞানিকদের মতে কয়েক লক্ষ বছর আগে, বরফ যুগের অবসানের পর পৃথিবী যখন ধীরে ধীরে গরম হতে আরম্ভ করেছিল, তখন এই অঞ্চল থেকে বিশাল হিমবাহগুলি আরও উত্তরে পিছিয়ে যেতে লাগল। তখন স্থানীয় বরফ গলে গিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল এই পাঁচটি সুবিশাল লেক।’ বুঝতে পেরে রতন আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে লাগল।
আমি আবার বলে চললাম, ‘এই লেকগুলিতে যত ‘পেয়’ জল আছে সেই পরিমাণ পেয় জল পৃথিবীর আর কোথায়ও নেই। পৃথিবীর ২০ শতাংশের বেশি পেয় জল রয়েছে এই লেকগুলিতেই। আবার পাঁচটি লেকের মোট জলের অর্ধেকের বেশি জল রয়েছে সবার বড়ো লেক সুপিরিয়রে। তার পরেই রয়েছে লেক মিশিগানে। আর সবচেয়ে কম জল আছে লেক ইরিতে।
রতন বলে উঠল, “যেখান থেকে নায়াগ্রা ফলস তৈরি হয়েছে।’
আমি হেসে মাথা নাড়লাম। এবার রতন একটা মোক্ষম প্রশ্ন করে বসল।
—আচ্ছা দাদা, এই লেকগুলি কি সবই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সম্পত্তি?
আমি ওর দিকে চেয়ে স্মিত হেসে উত্তর দিলাম— না, সব লেকগুলো নয়, খালি মিশিগান লেকটিই পুরোপুরি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আর বাকি চারটি লেক আমেরিকা আর ক্যানাডার মধ্যে প্রায় আধা আধি ভাগে রয়েছে। এই লেকগুলি এতই বিশাল যে আটটি প্রদেশ বা স্টেট এদের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে।
—মিশিগানও বিরাট বড়ো, বলে উঠল রতন।
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম, মিশিগান লেকও এত বিশাল যে ওরই সঙ্গে জুড়ে রয়েছে অন্টারিও ছাড়া বাকি লেকগুলি।
—সবচেয়ে গভীর কোন লেকটি দাদা? প্রশ্ন করল রতন।
—লেক সুপিরিয়র, এতই গভীর যে নিউ ইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংটা পুরো ডুবে যাবে ওতে, বললাম আমি।
—বাপরে! বলে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রতন।
(ক্রমশ……)