ইংরেজিতে একটি আপ্তবাক্য আছে— ‘ব্রেকফাস্ট লাইক দ্য কিং, লাঞ্চ লাইক দ্য প্রিন্স অ্যান্ড ডিনার লাইক দ্য পপার’। এটা সকলেই প্রায় জেনে বড়ো হয়েছি যে, প্রাতরাশ আমাদের সুস্থ জীবনশৈলীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সেই কারণেই নিউট্রিশনিস্টরা পরামর্শ দেন, ভারী ব্রেকফাস্ট দিয়ে দিন শুরু করতে। রাতে ঘুমোনোর পর বেশ কয়েক ঘন্টা আমরা না খেয়ে থাকি। এই উপোস বা ‘ফাস্ট’ ভাঙার নামই হল ব্রেকফাস্ট। প্রাতরাশে আমরা যে-খাদ্য গ্রহণ করি, তার মাধ্যমে শরীরে গ্লুকোজ তৈরি হয়। এটাই আমাদের শরীরে এনার্জির মূল উৎস।

কিন্তু সবকিছু জানা সত্ত্বেও অনেকেরই হ্যাবিট আছে ব্রেকফাস্ট স্কিপ করার। সারা সকাল কিছুই না খেয়ে, সরাসরি ভারী লাঞ্চ করার। কেউ কেউ মনে করেন রোগা থাকতে গেলে ব্রেকফাস্ট জীবনশৈলী থেকে বাদ দিতে হবে। কিন্তু এই অভ্যাসের দরুণ আমাদের শরীরে মেটাবলিজমের প্রক্রিয়া ধীরগতির হয়ে পড়ে এবং শরীরে ফোলাভাব এসে যায়। অনেকে আবার ব্রেকফাস্ট হয়তো করেন কিন্তু তার ফুডভ্যালু জিরো। সেক্ষেত্রে শরীর তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। এর ফল হল, সারাদিন শরীরে ক্লান্তির ভাব থেকে যায়। এটা আমাদের সামগ্রিক কর্মক্ষমতার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটা যাতে না হয়, তাই একবার তলিয়ে ভেবে দেখুন তো— আপনি কোনও ব্রেকফাস্ট মিস্টেক করছেন না তো?

চাকফির অভ্যাস

আমরা অনেকেই দিনের শুরুটা চা কফি দিয়ে করতে পছন্দ করি। এরপর আবার প্রাতরাশ শেষ করেই চা-কফির জন্য আশক্তি দেখা দেয়। এতে একটা তাৎক্ষণিক ফ্রেশ ভাব এলেও, এটা আখেরে সুফল দেয় না। কারণ এর দরুণ ব্রেকফাস্ট-এর মাধ্যমে আমরা যে-নিউট্রিশন গ্রহণ করি, শরীর সেগুলি ঠিকমতো শোষণ করতে পারে না। তাই ব্রেকফাস্ট করার অন্ততপক্ষে ১ ঘন্টা আগে অথবা ১ ঘন্টা পরে চা-কফি সেবন করা উচিত।

ব্রেকফাস্ট বাদ দেওয়া

লেট নাইট ডিনার করার অভ্যাস যাদের থাকে, তাদের সকাল অবধি পেট ভরে থাকার অনুভূতি হয়। এদের মধ্যেই ব্রেকফাস্ট স্কিপ করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। অনেকেই ভাবেন ব্রেকফাস্ট বাদ দিলে ক্যালোরি কন্ট্রোল করা বুঝি সহজ হবে। তাদের জানাই— এই ধারণা কিন্তু একেবারেই ভুল। রাতের লম্বা উপোসের পর, প্রাতরাশ মেটাবলিজম বুস্ট করতে সাহায্য করে। এটা শুধু আমাদের ওজনকেই নিয়ন্ত্রণ করে না বরং গ্লুকোজের মাত্রাকেও নিয়ন্ত্রিত করে। গ্লুকোজ লেভেল কন্ট্রোল করার অর্থ হল, সারাদিন ক্লান্তিহীন ভাবে আমরা কাজ করতে পারব। কম খাওয়া বা প্রাতরাশ বাদ দেওয়ার ফলে শুধু যে এনার্জির ঘাটতি হয় তা-ই নয়, ব্লাড কোলেস্টেরল বৃদ্ধি পাওয়া ও হার্টের সমস্যা, এমনকী টাইপ ২ ডায়াবিটিজ-এর মাত্রাও বাড়তে পারে। তাই ব্রেকফাস্ট তো স্কিপ করবেনই না, বরং খেয়াল রাখুন প্রাতরাশে যেন যথেষ্ট প্রোটিন ও ফাইবার থাকে৷

ফ্যাট: যারা ব্রেকফাস্ট স্কিপ করে ভারী লাঞ্চ করেন, দেখা গেছে তারা লাঞ্চে ওভার ইটিং-এর কারণে অনেক বেশি ক্যলোরি গ্রহণ করে থাকেন। এটা শরীরের জন্য বেশ ক্ষতিকারক। এছাড়া সারাদিন আলস্য আর ক্লান্তি তাদের ঘিরে রাখে। কাজ করার এনার্জিটাই তাদের কম থাকে।

টিপ: ব্রেকফাস্ট-এ প্রোটিন থাকা বিশেষ ভাবে জরুরি। হিসেবমতো ৭-৮ গ্রাম প্রোটিন। এর জন্য ব্রেকফাস্ট-এ রাখুন ১ বাটি স্প্রাউটস্ বা ৪০ গ্রাম পনির বা তফু কিংবা ১টা ডিম। এর মধ্যে থেকে যে-কোনও একটি নিয়মিত ব্রেকফাস্ট-এ খান। সেইসঙ্গে দরকার ক্যালসিয়াম। তাই দুধ বা দই কিংবা লস্যি-এর যে-কোনও একটি দৈনিক বরাদ্দ করুন।

মিসিং প্রোটিন ইন ব্রেকফাস্ট

আমরা দ্বিতীয় ভুলটা করে ফেলি ব্রেকফাস্ট-এ প্রোটিন বাদ দিয়ে। অধিকাংশ মানুষ, ব্রেকফাস্ট-এ সেটাই খেতে পছন্দ করেন যা তার অতি প্রিয় খাবার। অর্থাৎ আমরা জিভের স্বাদকে গুরুত্ব দিই, ফুড ভ্যালুকে নয়।

অনেকেই আবার প্রাতরাশে হাই কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করে ফেলেন। এতে ব্লাড সুগার লেভেল বেড়ে গিয়ে এই কার্ব কন্টেন্ট-কে ফ্যাটে রূপান্তরিত করে দেয়। এটাই ডায়াবিটিজ তথা অন্য অনেক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রোটিন রিচ ব্রেকফাস্ট গ্রহণ করলে আমাদের মাসলস মজবুত থাকে, দীর্ঘক্ষণ খিদের অনুভূতি থাকে না। ফলে সারাদিনে এক্সট্রা ক্যালোরি ইনটেক-এর সম্ভাবনা হ্রাস পায়।

এছাড়াও জেনে রাখুন, প্রোটিন রিচ ব্রেকফাস্ট, টিরোসিনে নামক অ্যামিনো অ্যাসিড-এর লেভেল বাড়িয়ে দেয়। এটি ডোপামাইন উৎপন্ন করে, আমাদের এনার্জি ও মুড বুস্ট করার কাজে সহায়তা করে। অর্থাৎ প্রোটিন স্কিপ যদি করেন, তাহলে অচিরেই আপনাকে কার্বোহাইড্রেটের উপর নির্ভর করতে হবে বেশি। এর ফলে ওজন তো বাড়বেই, তাড়াতাড়ি খিদেও পেয়ে যাবে।

ফ্যাট: যারা প্রোটিনের সঠিক মাত্রা রেখে ব্যালেন্সড ব্রেকফাস্ট করেন, তাদের খিদে বোধ কম হয়। এর ফলে নিজের ওজন ম্যানেজ করাও সহজ হয়।

টিপ: রোজ ব্রেকফাস্ট-এর পদ বদলান। প্রোটিনের জন্য হয় ডিম, নয়তো স্প্রাউটস, কলা, ডালের প্যানকেক বা চিলা, পালংশাকের র‍্যাপ, ডাল-রুটি, ওটমিল প্রভৃতি অপশন রাখুন।

ফাস্ট ইটিং

এই ভুলটা আমরা কম-বেশি সকলেই করে থাকি। কাজে বেরনোর তাড়াহুড়োয় ফাস্ট ইটিং আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। ব্রেকফাস্ট করার মতো ফুরসতও যেন আমাদের নেই। এই তাড়াহুড়োয়, বেশিরভাগ সময় আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খাবারটা গলধঃকরণ করি বা চলার পথে রাস্তায় যা পারি তাই খেয়ে নিই। এর ফলে না তো আমরা ব্রেকফাস্টটা এনজয় করি, আর না যথেষ্ট চিবিয়ে খাবারটা খাই। হজমের সমস্যা হয়, আর শরীরে খাবারটা ঠিকমতো শোষিত হয় না। অনেকে তাড়াহুড়োয় বেশিও খেয়ে ফেলেন, যার ফল হল ওজন বৃদ্ধি।

তাই সিট অ্যান্ড ইট পদ্ধতি মেনটেইন করুন। বসে সঠিক পরিমাণের ব্রেকফাস্ট গ্রহণ করার অভ্যাস তৈরি করুন। ভালো করে চিবিয়ে খান, যাতে খাবার হজম হতে সমস্যা না হয়।

ফ্যাট: গবেষণা বলছে, যে-মানুষরা স্বাভাবিক স্পিডে প্রাতরাশ করেন, তারা খাবারটা এনজয় করার সঙ্গে সঙ্গে, হজমের সমস্যায়ও কম ভোগেন।

টিপ: ঘুম থেকে ওঠার ২ ঘন্টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে ফেলুন। এতে অ্যালার্টনেস বৃদ্ধি পাবে, এনার্জি লেভেলও বুস্ট হবে দ্রুত। অর্থাৎ ব্রেকফাস্ট করার সঠিক সময় হল সকাল ৮.৩০ মিনিট থেকে ১০ টার ভেতর।

কার্বোহাইড্রেটএ নিয়ন্ত্রণ

আমরা যখনই ওয়েট কন্ট্রোলিং-এর কথা ভাবি, তখনই ব্রেকফাস্ট থেকে কার্বোহাইড্রেট পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিই। অথচ আমরা ভুলে যাই, কার্বস-ই আমাদের ব্রেইন-কে কাজ করার মূল ইন্ধন যোগায়। কিন্তু কমপ্লেক্স কার্ব অর্থাৎ যাতে ভিটামিন, মিনারেল ও ফাইবার আছে— তা যদি ব্রেকফাস্ট থেকে বাদ দিয়ে দেন, এতে আপনার শরীরে ক্লান্তিভাব বেড়ে যাবে। মাথা ঘোরা, দুর্বলতার মতো উপসর্গ দেখা দেবে। তাই ব্রেকফাস্ট যেমন প্রোটিন-রিচ হওয়া দরকার, তেমনি ব্যালেন্সড মাত্রায় কমপ্লেক্স কার্বসও থাকা জরুরি। এতে আপনি অনেক বেশি এনার্জেটিক ফিল করবেন।

ফ্যাট: ওটমিল কমপ্লেক্স কার্বস-এর গুণাগুণে সমৃদ্ধ। এটা শরীরে এনার্জি দিতে পারে যেমন, তেমন এই ফাইবার হৃদযন্ত্র-কে সুস্থ রাখতে সহায়ক।

টিপ: প্রত্যেকদিন ব্রেকফাস্ট-এ কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট শামিল করুন। ভেজিটেবল চিঁড়ের পোলাও, ভেজিটেবল উপমা, ভেজিটেবল দালিয়া, ওটস-এর যে-কোনওটি ব্রেকফাস্ট-এর জন্য আদর্শ।

ফলের বদলে জুস নেওয়ার ভুল

আধুনিক জীবনশৈলীতে আমরা গোটা ফল খাওয়ার অভ্যাস প্রায় ত্যাগ করেছি। মর্নিং ব্রেকফাস্ট-এ জায়গা করে নিচ্ছে প্রসেসড জুস। এতে ক্যালোরির মাত্রা যেমন বেশি, তেমনই ফাইবারের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। টেস্ট বাড়ে বটে এই জুস-এ কিন্তু ফুডভ্যালু কমে যায়। রাতের উপোসের পর জুস কিন্তু পাচনতন্ত্রের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কনস্টিপেশনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ব্রেকফাস্ট-এ গোটা ফল শামিল করুন। এর পুষ্টিগুণ এনার্জি বাড়াতে সাহায্য করবে। এছাড়া আপনার শরীরকে ডিটক্স করতেও সহায়তা করবে।

ফ্যাট: ১ গেলাস জুস-এ আপনি জিরো ফাইবার গ্রহণ করেন। কিন্তু ১টা গোটা আপেলে ৪ গ্রাম ফাইবারও পেয়ে যাবেন আপেলের পুষ্টিগুণের সঙ্গে।

টিপ: রোজ ১৫০ গ্রাম ফল খাওয়া জরুরি। এটি পাচন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...