সমুদ্রের পাশেই আছে বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি। হাজার হাজার বছর ধরে সমুদ্রের বালি জমে তৈরি হয়েছে এই অপরূপ স্থলভাগ, যা গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র আর অরণ্যের মাঝখানে। এনা বে-র বিরুবি বিচে ঢুকেই প্রথমে চোখে পড়ল এই বালিয়াড়ি। যে-দিকে চোখ যায় সে দিকেই শুধু নরম সিল্কের মতো মোলায়েম আর দুধের মতো সাদা বালি। সূর্যের আলো পড়ে বালিগুলো থেকে যেন এক স্বর্গীয় আলোর ছটা বেরিয়ে আসছে। দেখেই মনে পড়ল দুবাই-এর কথা। ঠিক এরকমই বালিয়াড়ি দুবাই- এ দেখেছিলাম। কিন্তু সেখানে তো এটা খুবই স্বাভাবিক! অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র সৈকতের ধারে যে এরকম বালিয়াড়ি থাকতে পারে সেটা একমাত্র নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না!

ভিড়ও কিছু কম নয়। এই বালিয়াড়িতে অনেক রকমের আমোদের ব্যবস্থা আছে। উটে চড়া, ঘোড়া চড়া, চার চাকার সাইকেলে চড়া (Quad Bike), ফোর হুইল ড্রাইভ, এমনকী অনেককেই দেখলাম স্যান্ড বোর্ডে করে বালির টিলার উপর থেকে নীচে নামছে। টিলাগুলো প্রায় ৩০ মিটার উঁচু, সেই সাথে প্রায় ৬০ ডিগ্রির মতো ঢাল রয়েছে। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় টুরিস্টদের এই বালিয়াড়ি নিরাশ করবে না। চার চাকার বাইকে করে বালির পাহাড়ের টিলা থেকে নীচে নামার রোমাঞ্চই আলাদা। সারা জীবনের জন্য এই অভিজ্ঞতা মনের মণিকোঠায় সঞ্চিত থাকবে।

বালিয়াড়ির ঠিক পাশেই অপূর্ব সৈকত। উট আর ঘোড়াগুলো বালিয়াড়ির টিলা থেকে যাত্রা শুরু করে নীচে নেমে সমুদ্র সৈকতে কিছুক্ষণ ঘুরে আবার উপরে টিলায় ফিরে যায়। ঘড়িতে সময় এগোনোর সাথে সাথে বালির তাপমাত্রাও বাড়তে শুরু করেছে। তাই বালিয়াড়ি থেকে এবার সমুদ্রে যাবার পালা। সমুদ্রের ঠান্ডা জল পায়ে লাগাতেই মনে হল যেন দুবাই থেকে অস্ট্রেলিয়া এলাম। বালিয়াড়ির বালিতে হাঁটার চেয়ে বিচের বালিতে হাঁটা অনেকটাই সহজ। ঘন্টাখানেক বিচে হেঁটে, অন্যান্য টুরিস্টদের সাথে কথা বলে সময়টা বেশ ভালোই কাটল। এক যাত্রায় মরুভূমি আর সমুদ্র, দুয়েরই স্বাদ নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।

ফেরার পথে গ্যান গ্যান লুকআউটে কিছুটা সময় কাটানো হল। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবোরিজিনাল ভাষায় গ্যান গ্যান কথার অর্থ হল সামুদ্রিক ঈগল। পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে এই লুকআউট থেকে নীচে সমুদ্র দেখে মনে হয় সত্যিই যেন পাখির চোখ দিয়ে দেখছি। সেই জন্যই হয়তো জায়গাটার এরকম নামকরণ করা হয়েছিল। পাহাড়ের উপর এখানে সহজেই গাড়ি নিয়ে পৌঁছোনো যায়। উপর থেকে বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায়, যেখানে সমুদ্র আর অরণ্য মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রকৃতি যেন এক অপরূপ সাজে নিজেকে সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে আমাদের জন্য। দিনের মধ্যে যে-কোনও সময়ই এখানে যাওয়া যেতে পারে। তবে ঊষা আর গোধূলিবেলার রঙিন আকাশ প্রকৃতির এই রূপকে যেন আলাদা একটা মাত্র দেয়।

ওয়ান মাইল বিচ নামে অপূর্ব সুন্দর একটা সমুদ্র সৈকত আছে এখানে, যেটা না দেখলে সমুদ্র উপকূলের এই শহরে ভ্রমণটাই অপূর্ণ থেকে যাবে। বাচ্চা থেকে বুড়ো, সবার জন্যই এটা একটা বিশেষ উপভোগ্য জায়গা। নেলসন বে থেকে গাড়িতে মাত্র দশ মিনিট লাগল এই বিচে পৌঁছোতে। এখানকার অগভীর জল— সৈকতে হেঁটে বেড়ানো, সাঁতার কাটা বা বাচ্চাদের নিয়ে খেলা করার জন্য খুব উপযোগী। ঘন্টাখানেক বিচে হেঁটে দেখলাম কত বাবা-মা তাদের ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এসেছে। ছোটো বড়ো নির্বিশেষে সমুদ্র সৈকতে বসে বালি দিয়ে বানানো বিভিন্ন রকমের দুর্গ, নজর কাড়তে বাধ্য। এখানে লোকেরা বলে সমুদ্র সৈকতে বসে বালির দুর্গ বানানোটা একরকমের মেডিটেশন। তবে গোধূলিবেলায় এই বিচ আবার সম্পূর্ণ অন্যরকম এক স্বর্গীয় রূপ নিয়ে হাজির হয়। আকাশের ল্যাভেন্ডার কালার সমুদ্রের জলে প্রতিফলিত হলে মনে হয় যেন প্রকৃতি তার রং-তুলির খেলা খেলছে।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...