শিশুরা অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং নরম মনের। যে-কোনও রকমের মানসিক চাপ, Uncertainty, আতঙ্ক তাদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে। যার ফলে শিশু মানসিক ভাবে অবসাদগ্রস্ত হতে পারে। বিগত এই মহামারি শিশু থেকে শুরু করে বড়োদেরও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। বাচ্চাদের বহুদিন স্কুল বন্ধ থেকেছে, অনলাইনে ক্লাস করতে হয়েছে এবং কাছের বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগটাও খুব কমে গেছে। এর পাশাপাশি কেউ কেউ বাবা-মায়ের মধ্যে একজন অথবা দু’জনকেই হারিয়েছে। এইসব বিষয়গুলি শিশুদের মানসিক বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলেছে। যে-পরিবেশে তাদের বেড়ে ওঠা উচিত ছিল, যা তাদের স্বাভাবিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিশুরা সেই অবস্থা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
শিশুর জীবনে প্রথম ৫ বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক চাপের কারণে শিশুদের প্রতিক্রিয়া, প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো এক হয় না। কেউ হয়তো নির্দিষ্ট কোনও জিনিসকে আঁকড়ে ধরে, কেউ কেউ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, কেউ আবার আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে, কেউ কেউ আবার অবসন্নও হয়ে পড়ে। তাই শিশুর মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা করাটা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যদি আমরা বুঝতে পারি আশেপাশের পরিবেশের কারণে শিশুর মনে প্রভাব পড়ছে তখন আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারি। শিশুরা অনেক সময় একটি ঘটনাকে তাদের নিজেদের মতো করে নেয়। Uncertainty, আতঙ্ক, অসুস্থ হওয়া অথবা নিকটজনদের মৃত্যু তাদের মনে প্রতিকূল প্রভাব ফেলতে পারে। কখনও আবার শিশুরা তাদের ভয়, উদ্বেগ বা আতঙ্কের কথা বড়োদের ঠিক করে বোঝাতে পারে না।
তাই শিশুদের আচার-আচরণের ওপর নজর রাখা প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিষয়ে শিশুদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভাবনা প্রকাশ করানোর জন্য প্রাপ্ত বয়স্কদের সাহায্য একান্ত দরকার। শিশুদের বিভিন্ন বিষয়ে তাদের নিজস্ব ভাবনা এবং মতামত প্রকাশ করাতে উৎসাহ দিতে হবে, যাতে তারা নিজেদের মনের মতো পরিবেশে তাদের কথা জানাতে পারে। তারা যদি কথায় না বোঝাতে পারে তাহলে আঁকা, রং করা-সহ অন্যান্য মাধ্যমের সাহায্যে তাদের মনের ভাব জানাতে উৎসাহিত করতে হবে। অভিভাবক, শিক্ষক, প্রাপ্তবয়স্কদের — শিশুদের সঙ্গে নম্রভাবে মতবিনিময় করতে হবে। শিশুদের বোঝার জন্য সৃজনশীল পন্থা-পদ্ধতি গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
মহামারি কিন্তু বড়ো ছেলেমেয়েদের মনেও অনিশ্চয়তার বীজ বপন করতে সফল হয়েছে। তাদের লেখাপড়া এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকার ভূমিকা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগোতে সাহায্য করতে হবে এবং বোঝাতে হবে মহামারির কারণে পৃথিবী জুড়ে তাদের মতোই অনেক শিশু একই পরিস্থিতির সম্মুখীন। বাবা-মায়ের ভূমিকাও এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তব জীবনে যাতে শিশু মানিয়ে নিতে পারে তার জন্য অভিভাবকদের এগিয়ে এসে ধীরে ধীরে শিশুকে বাস্তবের সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে। কাজের জায়গা এবং ব্যক্তিগত পরিসরের মধ্যে যে- পার্থক্য ছিল, সেটা এখন নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক মা-বাবাই তাঁদের সন্তানের শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন চাহিদা পূরণে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে সমস্যায় পড়ছেন। বিভিন্ন বয়সি শিশুদের চাহিদা একে অপরের থেকে আলাদা। তাদের প্রয়োজন, সময়, বিভিন্ন কাজে যুক্ত থাকার ধরনও আলাদা। বাড়িতে যদি উত্তেজনার পরিবেশ থাকে তাহলে শিশুর মানসিক বিকাশে সমস্যা হতে পারে। বর্তমানে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যে- সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা রোধ করতে নিরাপদ পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুরা যাতে ব্যস্ত থাকে বাবা-মা’দের সেদিকটি খেয়াল রাখতে হবে। শিশুদের জন্য ইতিবাচক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। বাবা-মা’দের দৈনন্দিন কাজকর্মের ফাঁকে বাচ্চাদের জন্য সময় বার করতে হবে।
যে-শিশু মানসিক চাপ থেকে বার হতে পারছে না তাকে সাহায্য করতে পারে তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব অথবা কোনও পেশাদার ব্যক্তি।
ছোটো থেকেই বাচ্চাদের এই অভ্যাসগুলি রপ্ত করালে ভবিষ্যতে কমবে রোগভোগের আশঙ্কা!
প্রতিদিনের স্বাস্থ্যকর অভ্যাসই শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে কাজ করবে। সেই সঙ্গে রোগ এড়াতেও সাহায্য করবে। শিশুদের মধ্যে ভালো অভ্যাস গড়ে তুললে দীর্ঘমেয়াদে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে শেখান
ছোটোবেলা থেকেই শিশুদের স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে উৎসাহিত করুন। স্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি বাচ্চার আগ্রহ বাড়াতে বাচ্চাকে বাজারে নিয়ে যান। তাকে ফল, শাকসবজি বাছতে শেখান, খাবারের লেবেল পড়তে দিন। নানারকম রঙিন শাকসবজি, গ্রিন ভেজিটেবল বাচ্চার খাবার তালিকায় রাখুন। খাবার তৈরিতে তাদের সাহায্য নিন। জুস-এর বদলে আস্ত ফল খেতে দিন। কোল্ড ড্রিংকস-এর চেয়ে জল যে উপকারী তৃষ্ণা নিবারক, ছোটো থেকেই বাচ্চাকে সেটা শেখান।
খেলাধুলোয় উৎসাহ দিন
বাচ্চাদের সব সময় চুপ করে বসে থাকতে বলবেন না। বরং বাচ্চাকে দৌড়াদৌড়ি করতে উৎসাহ দিন। শিশুদের ঘরের বাইরে খেলাধুলো করার সুযোগ করে দিন। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন অনুসারে, একজন শিশুকে দিনে অন্তত ৬০ মিনিট শারীরিক ভাবে সক্রিয় থাকতে হবে। যে-কোনও খেলাধুলোয় অংশ নিতে উৎসাহিত করুন। যেসব শিশু শারীরিক ভাবে নিষ্ক্রিয়, তাদের উচ্চরক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগে পড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
বাচ্চাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে যান
বাচ্চাদের সঙ্গে টাকা-পয়সা নিয়েও আলোচনা করা প্রয়োজন, যা তাদের ভবিষ্যতে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করতে পারে। বাচ্চাকে ছোটো ছোটো জিনিস কিনতে দিন। যখনই আপনি কেনাকাটা করতে যাবেন, বাচ্চাকেও সঙ্গে নিয়ে যান। বিশেষজ্ঞদের মতে, মনোপলির মতো গেম খেললেও উপকার পাওয়া যায়। এর সাহায্যে শিশু অর্থ-সম্পর্কিত প্রাথমিক নিয়মগুলি বুঝতে পারে।
পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন
শিক্ষা দক্ষতা উন্নত করার সর্বোত্তম উপায় হল বই পড়া। যখন বাচ্চারা পড়াশোনা করে, তখন এটি তাদের শব্দভাণ্ডার, ভাষার দক্ষতা, একাগ্রতা এবং কল্পনার বিকাশে সহায়তা করে। নানা ধরনের বই পড়লে শিশুদের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং অন্যদের অনুভূতি বুঝতে সুবিধা হবে। শিশুর আগ্রহ অনুযায়ী তার জন্য বই কিনে আনুন।