কর্ণাটক বললেই আমাদের চোখের সামনে প্রথমেই ভেসে আসে বেঙ্গালুরু শহর। ভারতের আইটি হাব। এবারের ভ্রমণ সেই বেঙ্গালুরু থেকেই শুরু করেছিলাম। গিয়েছিলাম কর্ণাটকের পরিচিত জায়গাগুলোর বাইরে বেশ কিছু অফবিট জায়গায়। কোঙ্কন উপকূলের শান্ত, স্থিতধী, রহস্যময় রূপটি দেখার জন্য কর্ণাটকের এই অঞ্চলগুলো একদম আদর্শ টুরিস্ট ডেসটিনেশন।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর উদুপি, মারাবাস্থে, কারওয়ার, মালপে বিচ, সেন্ট মেরিস আইল্যান্ড প্রভৃতি জায়গাগুলোই এবারের ভ্রমণের প্রধান দ্রষ্টব্য তালিকায় ছিল। পাহাড়, অরণ্য, সমুদ্র সবকিছু নিয়ে এই জায়গাগুলো— একদিকে যেমন মনোমুগ্ধকর সুন্দর, তেমনি আবার অপেক্ষাকৃত কম টুরিস্ট হওয়ায় জায়গাগুলোর নির্জনতাও মানসিক শান্তি দেয়।

কলকাতা থেকে বিকেলের ফ্লাইট ধরে সন্ধে সাতটা নাগাদ বেঙ্গালুরু এসে পৌঁছোলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই ঝকঝকে পরিষ্কার, সুন্দর রাস্তা পার হয়ে চলে এলাম সরকারি বাসস্ট্যান্ডে। এখান থেকেই রাত সাড়ে আটটায় মনিপালের বাস ছাড়বে। সাড়ে আটটা বাজার মিনিট দশেক আগেই বাস চলে এল। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাসে বসার ব্যবস্থা খুবই আরামদায়ক।

বাসে ওঠার পরেই যাত্রীদের দেওয়া হল একটি করে কম্বল ও জলের বোতল। তাছাড়া বাসে রয়েছে একটি ছোটো টয়লেটও। সারারাত বাস জার্নির পরে সকালবেলা এসে পৌঁছোলাম ভারতের অন্যতম পরিষ্কার ও সমৃদ্ধশালী শহর মনিপালে। ম্যাঙ্গালোর থেকে ৬৪ কিলোমিটার এবং উদুপি থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে মনিপাল শহরটি একটি মালভূমির উপরে অবস্থিত। এখান থেকে আরব সাগরের অসাধারণ সুন্দর একটি প্যানোরামিক ভিউ পাওয়া যায়।

মনিপাল শহরটাকে ঘুরে দেখার জন্য পরদিন সকালবেলাই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। পশ্চিমঘাট পাহাড়ের গায়ে, সমুদ্রে ঘেরা মালভূমির উপরে ছোট্ট এই শহরটা অবস্থিত। এই শহরের অনেকটা জায়গা জুড়েই রয়েছে মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ- সহ অনেকগুলো কলেজ, ইউনিভার্সিটি। শহরের ঝাঁ চকচকে পরিষ্কার রাস্তাঘাট, শপিংমল, সুন্দর সুন্দর বাড়ি, রোস্তারাঁ— সবকিছু দেখে মন ভরে গেল।

তবে সবরকম আধুনিক সুযোগ সুবিধা থাকলেও শহরটা মোটেই ঘিঞ্জি নয়। বরং দেখে মনে হয় সবুজে মোড়া অসাধারণ এক সুন্দর উপত্যকার, খাঁজে খাঁজে কোনও শিল্পী যেন নিখুঁত ভাবে বাড়িঘরগুলো সাজিয়ে রেখেছে। এটি ভারতের অন্যতম পরিষ্কার শহরও বটে। ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টে সকালের খাবার খেয়ে আমরা মালপে বিচে যাওয়ার বাস ধরলাম।

বাসে করে প্রথমে এলাম উদুপি শহরের কেন্দ্রস্থলে। তারপর ওখান থেকে আবার বাস ধরে গেলাম মালপে বিচে। মে মাসের দীর্ঘ তপ্তদিনের গরমকে উপেক্ষা করে আমরা যখন মালপে ফিশিং হারবারে এলাম, ততক্ষণে সূর্য প্রায় মাথার উপরে উঠে গেছে। চারিদিকের বাতাসে মাছের আঁশটে গন্ধ। তারই মাঝে মাছের কেনাবেচা চলছে। ব্যস্ত জনজীবনের ছবি দেখতে দেখতে আমরা ফিশিং হারবার পার হয়ে চলে এলাম মালপে বিচে। সমুদ্রের হাওয়ায় এতক্ষণের ঘামে ভেজা ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। সূর্যের আলোয় ঝিকিমিকি করা সমুদ্র দেখতে দেখতে কিছুটা হেঁটে আসার পরেই পড়ল সেন্ট মেরিস বিচে যাওয়ার লঞ্চঘাট। মাথাপিছু ২৫০ টাকা টিকিট কেটে আমরা লঞ্চে চড়ে বসলাম।

প্রথমে লঞ্চে চড়ে সমুদ্রের মধ্য দিয়ে চললাম। তারপর তীরের কাছাকাছি এসে সেই লঞ্চ থেকেই স্পিডবোটে উঠে, স্পিডবোট চড়েই চলে এলাম সেন্ট মেরিস আইল্যান্ড। ১৪৯৪ সালে এই সেন্ট মেরিজ দ্বীপপুঞ্জেই ভাস্কো দা গামা প্রথম এসেছিলেন। তিনি এই দ্বীপের নাম দিয়েছিলেন পাদ্রাও দে সান্তা মারিয়া। তবে কালিকট যাওয়ার আগে তিনি এই দ্বীপপুঞ্জটিকে মাদার মেরির নামে উৎসর্গ করে যান। সেই থেকেই এই দ্বীপপুঞ্জের নাম সেন্ট মেরিজ আইল্যান্ডে। মোট চারটি দ্বীপ নিয়ে এই আইল্যান্ডটি। দ্বীপে অসংখ্য নারকেল গাছ। তাই এই দ্বীপপুঞ্জকে কোকোনাট দ্বীপও বলা হয়। নারকেল গাছে ছাওয়া সবুজ দ্বীপের তটভূমিতে দাঁড়িয়ে আরব সাগরের জলে আসমানি রং এর খেলা দেখতে বেশ লাগছিল।

তবে জুন মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বর্ষার জন্য এই দ্বীপ পর্যটকদের জন্য বন্ধ থাকে। দ্বীপের মাঝে মাঝেই সমুদ্রের জল ঢুকে অগভীর জলা তৈরি করেছে। আরব সাগরের নীল জল সেখানে টলটল করছে। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে সেখানে কাউকে নামতে দেওয়া হয় না। দ্বীপের মাঝে ইতিউতি ছড়িয়ে আছে আগ্নেয়শিলা। ভালো লাগল দ্বীপের পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা। ঘন্টা দুয়েক থেকে আবার আমরা চলে এলাম মালপে বিচে। সমুদ্রের নোনতা বাতাস মেখে বিচের সামনের একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর আরও কিছুক্ষণ মালপে বিচে বসে থেকে চলে এলাম মন্দির শহর উদুপিতে।

প্রথমে দেখলাম প্রাচীন দুটি শিবমন্দির, একটি চন্দ্রমৌলিশ্বর ও দ্বিতীয়টি অনন্তেশ্বর। তারপর গেলাম তেরোশো শতকের পুরোনো বিষ্ণুমন্দিরে। ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। মাথার উপরে দড়িতে বাঁধা অবস্থায় ঝুলছে ফানুসের মতো দেখতে সাদা কাপড়ে ঘেরা এক বিশেষ ধরনের সন্ধ্যা প্রদীপ। রাস্তার ধারের ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে ফুল, মালা। স্থানীয় মেয়েরা সেখান থেকে মালা কিনে চুলে জড়াচ্ছে।

(ক্রমশ……)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...