কেস যখন প্রায় জন্ডিস, বাড়িতে অনিতা প্রায় হাঙ্গার স্ট্রাইকের মতন শুরু করেছেন। কোনও কথা শুনছেন না, রাগ দেখাচ্ছেন, জিনিসপত্র ছুড়ছেন। শাস্তি চাই, শাস্তি চাই রব তুলেছেন। তখন অজিত অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। তিনি প্রমাদ গুনলেন। কাদায় পড়া হাতির মতো ঝুম্পাকে স্মরণ করলেন। দ্বিধাগ্রস্ত অজিতবাবু। ঝুম্পা এখনকার রাজনৈতিক দলের মতো শিবির বদল করে যদি অনিতা দেবীর ঝান্ডা নিয়ে প্রচারে বেরোয় তখন কী হবে? ঝুম্পা অবশ্য বাবাকে নিরাশ করল না। একটা বেশ শাঁসালো মতলব দিল।

টেকো অভয়চরণ অজিতবাবুর কলেজবন্ধু। এ বাড়িতে তাঁর অবাধ যাতায়াত। আগে একটা চার্টার্ড ফার্মে কাজ করতেন। সাইড ব্যাবসা হিসাবে ঝোলায় রাখতেন হোমিওপ্যাথির নানাবিধ শিশি। তবে মনে হয়, এটা নিতান্তই তাঁর শখ। এর থেকে তিনি যা আয় করতেন, মাথার টাক পালিশ করার এক শিশি তেলের দামও পাওয়া মুশকিল ছিল। অবশ্য এই হোমিওপ্যাথির দৌলতে ঠাকুরপো আর বউঠানের মধুর সম্পর্ক ছিল। মাঝেমধ্যে জ্বরজারি হলে তাঁর দেওয়া পুরিয়াতেই কাজ হতো অনিতার।

এই তো সেদিন কইমাছের কাঁটা গলায় আটকে বিপত্তি। অভয়চরণবাবুর এক পুরিয়াতেই কাজ হল। বন্ধুর এই কেরামতিতে খুব খুশি হলেন অজিত। সারাদিন নিজের স্ত্রী খুব কষ্ট পাচ্ছিল। রাতে অভয়চরণকে ভূষণের দোকান থেকে মাছের কচুরি খাওয়ালেন। গিন্নি, বন্ধু দুজনেই খুব খুশি।

পরের দিন রাতের দিকে অভয়চরণ মিত্র বাড়িতে এলেন। সেই কালপ্রিট খাটের উপরেই বাবু হয়ে বসেছেন তিনি। একেবারে বিচারকের আসনে। বিপরীতে বিবাদী অজিতবাবু। একটা চেয়ারে বাদী পক্ষের অনিতা। এখানে কোনও সাক্ষীসাবুদ নেই। বেডরুমের ঘটনা!

অনিতা গতকাল রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনার আদ্যোপান্ত বিবরণ টেকো জজ অভয়চরণের কাছে পেশ করলেন আর মাঝে মাঝেই স্বামীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে হুংকার দিলেন। অজিতবাবু শরৎচন্দ্রের একটা নভেল পড়ছিলেন, অন্তত পড়ার ভান করছিলেন তিনি। কোনও প্রতিবাদ করলেন। না। কিন্তু লক্ষ্য করলেন অনিতা মামলা মজবুত করার জন্য তার বক্তব্যে খানিকটা জল মেশাচ্ছেন। তিনি যারপরনাই দুঃখিত হলেন কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও চেষ্টা করলেন না।

বিচারক অভয়চরণ রায় ঘোষণা করলেন, ‘কাল একজন ছুতোর মিস্ত্রি পাঠিয়ে দেব।’ দুজনেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। অদ্ভুত রায় ! অনিতার কণ্ঠে কৌতূহল, ‘ছুতোর কী করবে?” অজিত বাবুও মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

—আরে বাবা, এতদিন তো একসঙ্গে ছিলে, না হয় কিছুদিন আলাদা থাকো। হাসতে হাসতে রায়ের ওরাল কপি পেশ করলেন অভয়চরণ।

—সে তো পরের কথা কিন্তু ছুতোরের কাজ কী? এতক্ষণে মুখ খুলেছেন বিবাদী অজিত। খানিকটা যেন স্বামীর পক্ষ নিয়ে মাথা নাড়লেন অনিতা।

অভয়চরণ দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে সদর্পে বললেন, “খাট কেটে দু—ভাগ করা হবে।”

—কী? না, না। তা কী করে হবে! আমার বাবার নিজের হাতে বানানো খাট। প্রতিবাদের ঝড় তুললেন অনিতা।

বিবাদী-বাদী দুজনেরই রায় পছন্দ হল না। বিরস মুখে আদালত ছাড়লেন অভয়চরণ।

সেদিন রাতে অবশ্য সামান্য ডিনার করলেন অনিতা। তবে রাতে বিছানায় সেই “বিতর্কিত’ খাটে প্রায় যোজন দূরত্ব রেখে শুয়ে পড়লেন তিনি।

অজিতবাবু মুচকি হেসে ভাব জমাবার চেষ্টা করলেন, ‘পড়ে যাবে যে!” স্বামীর দিকে চোখে আইড্রপ দেওয়ার মতো করে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে ঘুমানোর ভান করলেন তিনি।

আজ বাজার থেকে ঝুম্পার কথামতো প্রায় এক ডজন কলা কিনেছেন অজিত। ঝুম্পা অবশ্য তিন—চারটে কিনতে বলেছিল। কিন্তু অজিত কোনও রিস্ক নিতে রাজি নন। তাই হাতের কাছে একটু বেশি কলা মজুত করেছেন। কলাগুলো বেশি পাকা এবং খারাপ দেখে নিতে বলেছিল ঝুম্পা। তাই করেছেন। বেছে বেছে রসালো কলা এনেছেন। মজা কলাগুলো বিক্রি করে দোকানিও খুশি। এখন ব্রেকফাস্ট টেবিলে শুধু অভিনয়টা করতে হবে। কাজের মেয়েটা আসার আগেই কাজ সারতে হবে। সে যদি আবার দাদাবাবুকে তুলতে আসে!

সকালের ব্রেকফাস্ট অজিতবাবুর দায়িত্বর মধ্যে পড়ে। সব ভেবেচিন্তেই ফন্দি এঁটেছে ঝুম্পা। ছোটো মেয়ের বুদ্ধির তারিফ করলেন তিনি। ব্রেড টোস্ট, ডিম সেদ্ধ,আর নিজের জন্য খারাপ দুটো কলা নিলেন। অপেক্ষাকৃত ভালো দুটো স্ত্রী অনিতার প্লেটের পাশে রাখলেন। অনিতা একটা টোস্টে কামড় দিয়ে খবরের কাগজটা টেনে নিলেন।

অজিতবাবু মঞ্চে নামলেন চার্লি চ্যাপলিন-কে স্মরণ করে। সুক্ষ অভিনয় করতে হবে। ধরা পড়লে প্রেস্টিজ পাংচার। ছোটো মেয়ের কাছেও ফেস লস হবে। তিনিও একটা টোস্ট কামড়ে কলার খোসাটা ছাড়িয়ে অতি সন্তর্পণে পায়ের নীচে ফেললেন। একটু সময় নিলেন। অভিনয়টা নিখুঁত করা চাই। কলায় একটু কামড় দিলেন। ডিমে কামড় দিয়ে কেলেঙ্কারি বাঁধল। গলায় আটকালো। বিষম লাগায় কাশি হতে লাগল। জল চাই। অনিতা বোতল থেকে গেলাসে জল ঢেলে এগিয়ে দিলেন। এই মরেছে! প্ল্যান না ভেস্তে যায়! জল খেতে খেতে আড়চোখে দেখলেন স্ত্রীকে। আবার খবরের কাগজে মন দিয়েছে সে।

কলার খোসার উপর আস্তে আস্তে ডান পা—টা দিয়ে সহসা পড়ে গিয়ে চিৎকার জুড়লেন তিনি। অনিতা হই হই করে এগিয়ে এলেন। নাটক জমেছে। কাজের মেয়েটাও চিৎকার শুনে এগিয়ে এসেছে। গিন্নিমা হুংকার দিলেন, “জলঘটের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দাদাবাবুকে ধর।’ দুজনে মিলে টেনে তুলল অজিতবাবুকে।

অভিনয়টা খুব ভালো হয়নি! পা-টা বেকায়দায় পড়েছে, উঠতে বেশ ব্যথা লাগছে। যাই হোক বিছানায় শুয়ে পড়লেন অজিতবাবু। এরপর থেকে স্ত্রী অনিতার কেয়ারে আছেন অজিত। একবার স্ত্রীর হাত ধরে টয়লেটে গেলেন। রাতে বিছানায় হট ওয়াটার ব্যাগ দিয়ে কোমরে সেঁক দিলেন অনিতা। সেই সময় বড়ো মেয়ে ফোন করেছিল। ফোন কেটে স্বামীর সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। রাতে মাথার বালিশটা অজিতবাবুর কাছাকাছি রেখে শুলেন তিনি। দূরত্বটা ঘুচিয়ে ফেলা দরকার!

একটু বেশি রাতে ছোটো মেয়ের মুঠোফোনে বাবার মেসেজ ঢুকল — ‘ব্যানানা মিশন সাকসেসফুল।”

ঝুম্পা প্রত্যুত্তরে বুড়ো আঙুলের ইমোজি পাঠাল। নিশ্চিন্তে ঘুম লাগালেন অজিতবাবু।

(সমাপ্ত)

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...