ফাজিল হেসে বেরিয়ে গেল শুভ্রা। মানব চেয়ারে গা এলিয়ে কয়েক সেকেন্ড হাসিমুখে থাকার পর, শুভ্রার রেখে যাওয়া ফাইলটা নিয়ে কাজ করতে শুরু করে দিল।

আসলে শুভ্রা এবং মানবের এই সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা মাত্র দু’বছরের। এর আগে অফিসের অন্য ব্রাঞ্চ-এ ছিল শুভ্রা। কিন্তু পার্কস্ট্রিট-এর এই ব্রাঞ্চ-এ আসার পর থেকে কাজের সূত্রে প্রতিদিন দু’তিনবার মুখোমুখি হতে হয় মানবকে। আর কাজের ফাঁকেই দু’জনের মধ্যে কথাবার্তা এবং টুকটাক রসিকতা চলতেই থাকে। এভাবেই কখন যেন মনের কোণে একে অন্যের প্রতি হালকা দুর্বলতা তৈরি হয়ে গেছে। এখন কাজের অবসরে মাঝেমধ্যে পরস্পরের মুখোমুখি হলে ভালোই লাগে উভয়ের। হয়তো এর পিছনে মানসিক খিদেও থাকতে পারে! কারণ মানবের বউ সুমিতার যেমন স্বামী ছাড়াও অন্য নিজস্ব জগৎ রয়েছে, ঠিক তেমনই শুভ্রার বর বিপ্লবও তেমন বউ-ভক্ত নয়। হয়তো দু’জনের লাইফ পার্টনার-এর প্রতি মানসিক দূরত্ব বেড়েছে এই কারণেই।

যাইহোক মানব এবং শুভ্রা দুজনে জমিয়ে লাঞ্চ করে এসেছে একটা বড়ো রেস্তোরাঁ থেকে। তাই দুজনের মেজাজ বেশ ফুরফুরে ছিল অনেকক্ষণ। কিন্তু বাড়ি গিয়ে অপছন্দের আচার অনুষ্ঠান পালন করতে হবে ভেবে, মানবের থেকে বেশি মন খারাপ হয়ে গেল শুভ্রার। তাই বিষণ্ন মনে বাড়ি ফিরল দু’জনে।

মানব এবং শুভ্রা যে-যার বাড়ি পৌঁছোনোর পর দু’রকম ঘটনা ঘটল।

বাড়ি পৌঁছে মানব দেখল, প্রতিবেশী মেয়ে-বউদের সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে হইহই করছে সুমিতা। ঘরভর্তি এতজনকে দেখে খুব রাগ হল মানবের। কারণ সে চায় একটু নিরিবিলি পরিবেশ। নিজের পরিবারের সদস্যরা হইহুল্লোড় করলে তার খারাপ লাগে না কিন্তু তাই বলে পাড়া-প্রতিবেশীরা এসে হুল্লোড় করে বাড়ি মাথায় তুলবে, এ যেন তার সহ্য হয় না। তাই বেডরুমে ঢুকে মন খারাপ করে শুয়ে পড়ল মানব। এরপর যখন বাড়ি খালি হল তখন মানবের মনখারাপ কাটাতে গিয়ে চোখের জল ঝরাতে হয়েছিল সুমিতাকে।

অন্যদিকে, উপোস আছে এমন ভান করে শুভ্রা বর এবং শাশুড়িকে নিয়ে দ্রুত সমস্ত নিয়মনিষ্ঠা পালন করে শিবের ব্রত শেষ করল। তারপর ওর পাঁচ বছরের মেয়েকে খাইয়ে ঘুম পাড়াল। নিজেও রাতের খাবার জমিয়ে খেলো বরের সঙ্গে বসে। শুভ্রার মধ্যে এমন পরিবর্তন দেখে বিপ্লব বেশ খুশি হল। সে বুঝতেই পারল না শুভ্রার অন্তরের আসল ইচ্ছেটা। শুভ্রা যে এইসব উপোস, ভক্তি ইত্যাদিকে সংস্কার নয়, কুসংস্কার হিসাবেই দ্যাখে, তা অনেকবার বর কিংবা শাশুড়িকে বুঝিয়েও যখন কাজ হয়নি তখন সে সবকিছু মেনে নেওয়ার অভিনয় করে গেল নীরবে। আর আপাত ভাবে সবকিছু ঠিকঠাক মনে হলেও, বিপ্লবের সঙ্গে শুভ্রার মনের দূরত্বটাও নীরবে বেড়ে চলল প্রতিদিন। শুভ্রার প্রতি মুহূর্তে মনে হতে লাগল, যাকে সে একসময় ভালোবেসে বিয়ে করেছিল, সেই বিপ্লবই তার পছন্দ-অপছন্দকে গুরুত্ব দিল না, চাপিয়ে দিল তার নিজের সিদ্ধান্তকে। আর ঠিক তখনই তার আরও আপনজন মনে হতে থাকল মানবকে। অন্তত তার সঙ্গে মতের মিল আছে মানবের, মানব তাকে সঠিক ভাবে বোঝে, তার ইচ্ছেকে মর্যাদা দেয়— এটাই অনেক বড়ো পাওয়া হয়ে উঠল শুভ্রার কাছে।

মানবও যেন সুমিতার অতি সামাজিক হয়ে ওঠা, ধর্মকর্মের বাড়বাড়ন্ত আর সহ্য করতে পারছিল না। ধীরে ধীরে ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও দূরত্ব বাড়তে শুরু করল। মানবও তখন প্রকৃত বন্ধু, মনের মানুষ ভাবতে শুরু করল সহকর্মী শুভ্রাকে। আর তাই সময় যত এগোতে লাগল, মানবের সঙ্গে শুভ্রার ওঠাবসা, সময় কাটানো বাড়তে শুরু করল ততই। এভাবেই দিন, মাস পেরিয়ে এগিয়ে এল আরও এক শিবরাত্রির দিন। মানব এবং শুভ্রাও তাদের সম্পর্ককে আর নিছক বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইল না। সংসারের মোহ কাটিয়ে এক অন্যরকম তৃপ্তির স্বাদ অনুভবের পরিকল্পনা করল।

পরিকল্পনা মাফিক ওরা দুই পরিবার শিবরাত্রির আগেই একদিন মিলিত হয়ে আলাপ পরিচয় করাল যে যার লাইফ পার্টনার-এর সঙ্গে। এর ফলে বেশ একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠল দুই পরিবারের মধ্যে। মানবের স্ত্রী সুমিতা এবং শুভ্রার বর বিপ্লব জানাল যে, মানব এবং শুভ্রার মধ্যে সহকর্মী হিসাবে ভালো সম্পর্ক আছে, তাই ওরা পারিবারিক আড্ডা জমাল।

যাইহোক প্রথম দিনের হইহুল্লোড় এবং ভুরিভোজের পর সবাই মিলে আবার গেট টুগেদারের পরিকল্পনা করল। শুভ্রা জানাল, “শোনো আগামী শিবরাত্রির দিন আমরা সবাই কারও একজনের বাড়িতে একসঙ্গে উৎসব পালন করব, খুব মজা হবে।’

শুভ্রার প্রস্তাব শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি হল ওর বর বিপ্লব। কারণ বিপ্লব ভাবল, শুভ্রা খুব বদলে গেছে, আগের মতো আর ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বিরক্ত হচ্ছে না, পরিবর্তে নিজেই প্রস্তাব দিচ্ছে। তাই অত্যন্ত খুশি হয়ে বিপ্লব জানাল, ‘তাহলে আমাদের বাড়িতেই সবাই মিলে মজা করব।’

—না না, এবারটা আমাদের বাড়িতে হোক। পরের বার না হয় আপনাদের বাড়িতে হবে। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাল মানবের স্ত্রী সুমিতা।

কার বাড়িতে সবাই মিলিত হবে শিবরাত্রির দিন, সেই নিয়ে দড়ি টানাটানি চলতে চলতে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল, এবারটা বিপ্লব- শুভ্রার বাড়িতেই হবে হইহই। সেইসঙ্গে এ-ও ফাইনাল হল যে, মানবের স্ত্রী, সন্তান, মা, বাবা সবাই সকাল থেকে বিপ্লবদের বাড়িতে থাকবে। আর মানব, শুভ্রা এবং বিপ্লব যদি ছুটি না নিতে পারে, তাহলে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসে হইহুল্লোড়ে যোগ দেবে। ওদের অনুপস্থিতিতে বিপ্লবের মা-বাবা ওদের ছোট্ট নাতনিকে নিয়ে সুমিতাদের সঙ্গ দেবেন এও জানাল বিপ্লব।

(ক্রমশ……)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...