গতমাসে দেশের বাড়ি থেকে কলকাতায় ফেরার পর থেকে অবনী কিছুতেই মনের মধ্যে একটুও যেন স্বস্তি পাচ্ছে না। দিনরাত মাটির উপরে উবু হয়ে বসে, বিস্ফারিত চোখে দেয়ালের দিকে চেয়ে থাকে সে। দেশের বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকে অবনীর এই গুম মেরে যাওয়ার ব্যাপারটা সকলেরই নজরে পড়ছে।

অবনী কলকাতার ডালহৌসি অফিসপাড়ার কাছে ম্যাঙ্গো লেনের একটা উঁচু অফিসবাড়ির সাততলায় কাজ করে। এই সাততলায় আট-টা কোম্পানির অফিস। সেখানে অবনীর কাজ বলতে— রোজ ঘুম থেকে উঠে প্রত্যেকটা অফিসের চেয়ার-টেবিল, আসবাবপত্র, কাচের দরজাগুলো সব মুছে সাফ করে। ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে জমা হওয়া আগের দিনের সব ছেঁড়াখোঁড়া কাগজপত্র ফেলে দিয়ে, প্রত্যেকটা অফিসঘর ঝাঁটপোছ করে দেয় অবনী। তারপরে প্রত্যেকটা টেবিলে একটা করে খাবার জলের বোতল রেখে দেয় সে।

বেলা বাড়লে, প্রতিটা অফিস ঘুরে ঘুরে অবনী জানতে চায়— কোন বাবুদের পান লাগবে, কোন বাবুদের চা লাগবে, সিগারেট লাগবে। এইভাবে দিনে তিন-চারবার

চা-পান-সিগারেটের জোগান দেয় অবনী। আবার যেসব কোম্পানির অফিসে নিজস্ব জেরক্স মেশিন নেই, তারা প্রায়ই গোছা গোছা চিঠিপত্র অবনীর হাতে দিয়ে, জেরক্স করিয়ে আনতে বলে। জেরক্স করতে যাওয়ার সময়, অবনী একবার করে দরজা ঠেলে সব অফিসে ঢুকেই জানতে চায়— -নীচে যাচ্ছি, আপনাদের কোনও কাজ আছে?

তখন কেউ বলে, ‘অবনীদা তুমি নীচে যখন যাচ্ছ, পোস্ট অফিস থেকে আমাদের জন্য কয়েকটা রেভিনিউ স্ট্যাম্প এনে দাও না। কেউ বলে আমাদের এই চিঠিগুলো পোস্ট অফিসের ড্রপবক্সে ফেলে দিও।’ কখনও কোনও কাজে না নেই অবনীর। যে যা বলে, হাসিমুখে সব করে দেয় সে। কারও অধীনে চাকরি করে না সে কিন্তু প্রতিটা কোম্পানির থেকে একটা মাসোহারা পায়। যে যা দেয় তা নির্দ্বিধায়, বিনা অসন্তোষে নিয়ে নেয় অবনী। অনেকে আবার ছোটোখাটো কাজের জন্য, হাতে দশ-বিশ টাকা বকশিশ দেয়। সব মিলিয়ে মাস গেলে আট-দশ হাজার টাকা আয় হয় অবনীর।

এই উপার্জনকে সম্বল করেই, গত পঁচিশটা বছর নির্ঝঞ্ঝাটে কাটিয়ে দিয়েছে অবনী। দিনান্তে ম্যাঙ্গো লেনের এই অফিসবাড়ির কেয়ারটেকার মণি বাহাদুরের ঘরে রাত গুজরান করে। মণি বাহাদুরের সঙ্গেই একসাথে তার খাওয়াদাওয়া, ওঠাবসা সব। কেবল মাস পড়লে প্রথম শুক্রবার রাতে দু’দিনের জন্য দেশের বাড়িতে যায় অবনী।

অবনীর দেশের বাড়ি নদীয়া জেলার করিমপুরে। বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া গ্রাম বারিকপাড়ায়। সেখানেই অবনী বারিকের বাপ-ঠাকুরদার ভিটে। অবনীর মা-বাবা যখন মারা যায় তখন অবনীর বয়স মাত্র পনেরো বছর। কাকা কাজ করতেন ডালহৌসি পাড়ার এক বেসরকারি সংস্থায়। কাকার হাত ধরেই কলকাতায় এসে, সেই যে ম্যাঙ্গো লেনের এই বাড়িতে কাজে ঢুকেছিল অবনী, তা সে এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। কাকা গত হয়েছেন দীর্ঘদিন। শরিকি ভাগে যেটুকু বাস্তু জমি মিলেছিল, সেখানে ক্রমে ক্রমে একখানা এক কামরার ঘর তুলেছে সে। সেই ঘরেই স্ত্রী মল্লিকা আর মেয়ে বকুলকে নিয়ে অবনীর সংসার।

দেশের বাড়ির পিছনে যে বিঘেখানেক চাষের জমি পেয়েছিল, সেখানে শীতের আগে শনি-রবি দুটো দিন খেটে ফুলকপি, গাজর, বাঁধাকপি, ওলকপি লাগিয়েছে নিজের হাতে। গেল মাসে গিয়ে দেখে এসেছে, ফুলকপিগুলো বেশ ডাগর হয়েছে। জমির পাশে বাড়ির পিছনে বাঁশ ও গুটিকয়েক তক্তা, নারকেল দড়ি দিয়ে বেঁধে, একটা কুঁজি বানিয়ে দিয়েছে অবনী। শীতের দুপুরে মল্লিকা রোজ সেখানে গিয়ে বসে পাখি তাড়ায়, যাতে পাখিগুলো সবজিগুলোকে নষ্ট না করতে পারে।

এদিকে স্কুল থেকে ফিরে মায়ের পাশে গিয়ে বসে বকুল। সে সময় স্কুলের বন্ধুবান্ধবের গল্প, মাস্টারমশাইদের গল্প, আসা-যাওয়ার পথে নিজের চোখে দেখা গ্রামের মানুষজনের আলাপ আলোচনা সম্বন্ধে নানান ফিরিস্তি শোনায় মাকে। অবনীকে ছাড়াই মেয়েকে নিয়ে দিব্যি দিন কাটায় মল্লিকা।

মাসের প্রথমে অবনী ঘরে ফিরলে, সারাটাদিন সে খেতের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে। রাতের বেলায় মেঝেতে বিছানা পেতে শুতে হয় অবনীকে। মল্লিকা আর বকুল শোয় তক্তপোষের উপরে। রাতে মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে, মল্লিকা মেঝেতে নেমে আসে অবনীর পাশে। সারাটা মাস স্বামী-স্ত্রীর দুটো অভুক্ত শরীর নিঃশব্দে পরষ্পরের ভিতরে আহারের সন্ধানে মেতে ওঠে। শরীর-মন তৃপ্ত হলে, মল্লিকা আবার তক্তপোষে উঠে মেয়ের পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

অবনীকে দেখলে বকুলের মনও খুশিতে নেচে ওঠে। বাবাকে দেখামাত্র তাকে জড়িয়ে ধরে, টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসায় বকুল। বাবার পাশে বসে, কলকাতা শহরের নানান গল্প শুনতে চায় সে। সারাটাদিন বাবার হাতে হাতে চা-জলখাবার বাড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে, বাবার ছাড়া জামাকাপড় কেচে উঠোনের তারে মেলে, শুকিয়ে, ভাঁজ করে আবার বাবার ব্যাগে ভরে দেয় বকুল।

মেয়েকে দেখে অবনীও খুশি হয়। বকুল যেন একেবারে মল্লিকার ছায়া। মল্লিকা তার মেয়েকে ধীরে ধীরে নিজের মতো করে গড়ে তুলছে। পড়াশোনাতেও ভালো হয়েছে মেয়েটা। প্রতিবছর প্রথম হয়ে ক্লাসে ওঠে বকুল। গেল বছর সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছে সে। বকুল সেভেনে উঠতেই মল্লিকা জানিয়েছিল, এতদিন মেয়েটা একা একা পড়াশুনা করে এতদূর এগিয়েছে। এবার ঘরে ওর জন্য একটা মাস্টার না রাখলেই নয়। নিদেনপক্ষে ইংরাজি আর অঙ্কের জন্য। বাকি বিষয়গুলো ও নিজেই চালিয়ে নিতে পারবে।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...