অবনী সায় দিয়েছিল মল্লিকার কথায়। বারিকপাড়ার অমূল্য মাস্টারকে বলেকয়ে রাজি করিয়েছিল অবনী। বকুলকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড়ো করে শহরের কলেজে ভর্তি করানোর সাধ অবনীর দীর্ঘদিনের। অবনী চায় শহুরে মেয়েদের মতন চাকরিবাকরি করে, নিজের মতো করে ঘরসংসার করুক বকুল। এই সাধপূরণের জন্য, সবরকমের কৃচ্ছ্রসাধন করতে রাজি আছে সে।
কিন্তু গত মাসছয়েক আগে, দেশে গিয়ে অবনী মনে ধাক্কা খেল। মেয়ে ছুটে এসে খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরা তো দূরের কথা বাবার পাশে এসে বসা, বাবার হাতে চা-জলখাবার বাড়িয়ে দেওয়া, বাবার জামাকাপড় কাচাকুচি করা— সব বন্ধ করে, সারাটা দিন ঘাড় গুঁজে বারান্দায় বসে রইল বকুল।
রাতে খেতে বসে মল্লিকার কাছে অবনী জানতে চাইল, ‘কী ব্যাপার বলো তো!”
—কীসের কী ব্যাপার?
—তোমার মেয়ের হলটা কী! আমাকে দেখে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি তক্তপোষের উপরে গিয়ে বসলে, ও সেখান থেকে নেমে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। সারাটাদিন মাথা গুঁজে বারান্দায় বসে রয়েছে। কথা বললে মুখে কুলুপ এঁটে, মাথা নীচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ করে এই পরিবর্তন! কোনও অন্যায় টন্যায় করে, তোমার কাছে বকা খেয়েছে মনে হচ্ছে!
—বকুল কি আমাদের তেমন মেয়ে না-কি গো! ওকে কি কোনও অন্যায় করতে দেখেছ কোনওদিন? কাল রাত পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল, আজ সকাল থেকে আমিও এই পরিবর্তন দেখছি ওর মধ্যে।
—কিন্তু হঠাৎ করে এই পরিবর্তন কেন! ওর কাছে জানতে চাও কী হয়েছে। অবনী সে যাত্রায় মল্লিকাকে এই নির্দেশ দিয়ে কলকাতায় ফিরে আসলেও, মল্লিকা তার মেয়ের মধ্যে এহেন পরিবর্তনের রহস্যের কোনও কূল কিনারা খুঁজে পায় না। উলটে বকুলের এই অস্বাভাবিকতা দিনকে দিন বরং বাড়তেই থাকে। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মাকে সে জানায়, ‘আমি কাল থেকে আর এই স্কুলে যাব না। তোমরা আমাকে মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করে দাও!”
রাত্রে অমূল্য মাস্টার পড়াতে এলে, মাথা গুঁজে ভয়ে ভরা চোখ মুখ নিয়ে চুপ করে বসে থাকে বকুল। মাস্টার মশাইয়ের কোনও প্রশ্নের উত্তর পর্যন্ত দিতে চায় না সে। বিরক্ত হয়ে অমূল্য মাস্টার সেদিন ফিরে যাওয়ার পরে, বকুল মায়ের কাছে গিয়ে কাঁচুমাচু মুখে জানায়— সে আর অমূল্য মাস্টারের কাছে পড়তে চায় না।
একমাস পরে অবনী ঘরে ফিরলে, মল্লিকা মেয়ের সাম্প্রতিক এইসব অস্বাভাবিকতার বিষয়ে খুলে জানায় স্বামীকে। অবনী সবকিছু জানার পরে, সেই শনিবার দিনই দুপুরবেলাতে মেয়েকে নিয়ে গ্রামের পোড়া অশ্বত্থতলার মনসাবাড়িতে গুরুবাবার কাছে গিয়ে হাজির হল। প্রতি শনিবার দুপুরে গুরুবাবার ভর হয়। বকুলকে সামনে বসিয়ে গুরুবাবা চোখ বুজলেন। তারপরে হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে, বকুলের কাছে গিয়ে, ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জিজ্ঞাসা করতে থাকেন, ‘বল! কী জন্য তুই এর শরীরে ঢুকেছিস? চুপ করে থাকলে চলবে না। বলতেই হবে তোকে, তুই ওর শরীর থেকে বেরোবি কি-না!”
বকুল অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে, গুরুবাবার পায়ে পড়ে কঁকিয়ে ওঠে, ‘আমাকে মারছ কেন? তুমি যা জানতে চাইছ, আমি তার কিছুই জানি না।’
ভর ভাঙলে গুরুবাবা অবনীকে ডেকে জানিয়ে দেন, “তোমার বাড়ির পিছনে খেত পাহারার জন্য তুমি যে কুঁজি বেঁধেছ, সেখানে দুপুরে খেত পাহারা দেওয়ার সময় ওর শরীরে অশরীরীর প্রবেশ হয়েছে। আজই বাড়ি ফিরে গিয়ে ওই কুঁজি ভেঙে দিতে হবে। আজ থেকে আমার দেওয়া জল, মিশিয়ে স্নান করালে শীঘ্রই তোমার মেয়ে ভালো হয়ে যাবে!”
কিন্তু ভালো হওয়া তো দূরের কথা, দিনকে দিন বকুলের অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল। অবনী কলকাতায় ফিরে আসার আগে, সেবার অমূল্য মাস্টারের কাছেও ছুটেছিল। সব শুনে তিনি বললেন, “মনে হচ্ছে ওর মনের মধ্যে কোনও একটা বিষয়ে বড়োসড়ো ভয় ঢুকেছে। এসব ওঝা গুণিনের কাছে না ছুটে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কৃষ্ণনগরে জেলা হাসপাতালের একজন ভালো মনোবিদের কাছে নিয়ে যাও মেয়েকে। ওর মনের মধ্যে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ভয়ের কারণের হদিশ নিশ্চয়ই খুঁজে পাবেন উনি। এত ভালো একটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট হতে দিও না!”
এইসব শোনার পরে, সোমবার সকালে ম্যাঙ্গো লেনের অফিসে অবনী ফিরে এলেও, তার মন পড়ে থাকে দেশের বাড়িতে। ‘মেয়েটাকে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারবে তো! বকুলকে নিয়ে তার দীর্ঘদিনের স্বপ্নপূরণ হবে তো!’—এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে, মণি বাহাদুরের ঘরের দেয়ালের দিকে বিস্ফারিত চোখে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে অবনী। নাওয়া খাওয়া ভুলে একস্থানে স্থানুবত্ বসে থাকে সারাটা দিন।
দীর্ঘদিন ধরে অবনীকে যারা দেখছে, তাদের মধ্যে অনেকেই এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে, “কি গো অবুদা, কী হয়েছে তোমার? সারাদিন আনমনা হয়ে বসে থাকছ। চিন্তায় চিন্তায় একি চেহারা করেছ!”
অবনীর কাছ থেকে সব শোনার পরে, তারা ভরসা দেয়, “চিন্তা কোরো না অবুদা, আমরা তো আছি। তোমার চাকরির কোনও ক্ষতি হবে না। খরচ খরচা নিয়ে চিন্তা কোরো না। প্রতি সপ্তাহের শেষে তুমি বাড়ি চলে যাও, ভালো একজন মনোবিদের কাছে নিয়ে যাও মেয়েটাকে। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
সবাই মিলে কিছু টাকা-পয়সাও তুলে দেয় অবনীর হাতে। তাই নিয়ে অবনী ছুটে যায় দেশের বাড়িতে। মেয়েকে নিয়ে সে হাজির হয় সদর হাসপাতালের বড়ো মনোবিদ ডাক্তার মৃন্ময় নন্দীর কাছে। ডাক্তারবাবুকে মেয়ের সব সমস্যার কথা খুলে জানায় অবনী ও মল্লিকা। মল্লিকা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, “আপনি আমাদের মেয়েটাকে বাঁচান ডাক্তারবাবু। মেয়েটা আমাদের বড়ো ভালো। লেখাপড়া, আচার আচরণ, ব্যবহার সবদিক থেকেই আমাদের গ্রামের মধ্যে সেরা ছিল ও। কিন্তু গত মাস ছয়েক ধরে কী যে একটা ভয় পেয়ে বসেছে ওকে; দিনরাত মাথা নীচু করে মুখ গুঁজে বসে থাকে। স্কুল যাওয়া, খেলাধূলা সব ছেড়েছে। এমনকী ঘর থেকে বেরিয়ে কারও দিকে মুখ তুলে চাইতেও ওর সব সময় ভয় করে। বিশেষ করে পুরুষ মানুষ দেখলেই ওর যত ভয়, নিজেকে গুটিয়ে রাখে সবসময়। সে স্কুলের সহপাঠী হোক, বাড়ির মাস্টারমশাই কিংবা নিজের বাবা হোক- — সব জায়গা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে, কী জানি কী এক অজানা ভয়ে!
(ক্রমশ…)