শিল্প-সংস্কৃতি এবং সভ্যতার অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য ভারত বিশেষ ভাবে পরিচিত সারা বিশ্বে। প্রত্যেক ভারতবাসী এর জন্য গর্ব অনুভব করেন। আর এই অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য বেশিরভাগ কৃতিত্বের দাবিদার ভারতীয় নারীরা। আর এই নারীদের মধ্যে অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছেন মায়েরা। কারণ, ‘মা’ এই শব্দটি শুনলেই ভালোবাসা, মমত্ব, করুণা, দয়া, ত্যাগ, সেবা প্রভৃতি ভাবমূর্তি ফুটে ওঠে চোখের সামনে। আসলে, মা মানেই নিরাপত্তা এবং ভালোবাসার আশ্রয়স্থল। এইসব গুণ মায়েরা পেয়েছেন প্রকৃতিগত ভাবেই।
বেশিরভাগ পরিবারে দেখা যায়, মা তার সমস্ত গুণ এবং শক্তি দিয়ে পরিবারকে সুখময় করতে চান। প্রাকৃতিক নিয়মেই মায়েরা সংসারের হাল ধরেন শক্ত হাতে। এর জন্য তারা অনেক সময় আত্মসুখ বিসর্জনও দিয়ে থাকেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই যে, এত কিছু ত্যাগ স্বীকার করার পরও মায়েদের উপর অত্যাচার বন্ধ হয়নি আজও। আর এইসব অত্যাচারের প্রতিফলন ঘটছে, কুপ্রভাব পড়ছে তাদের দেহে-মনে। তাদের চিত্ত তাই দোলাচলে। কখনও তারা বিরক্ত, কখনও তৈরি হচ্ছে মানসিক অস্থিরতা এবং অস্তিত্বের সংকট। কিছু ক্ষেত্রে মায়েরা আজ দিশাহারা, তাই খুঁজছেন অস্তিত্বের অর্থ। কিন্তু কবে কাটবে এই অস্তিত্বের সংকট?
সন্তান প্রসঙ্গে
লিঙ্গ নির্ধারণ দণ্ডনীয় অপরাধ, তবু আজও কি তা বন্ধ হয়েছে পুরোপুরি? প্রশ্ন থেকে যায়। বিস্ময় জাগে মনে, আজও কেন বন্ধ হয়নি কন্যাভ্রূণ হত্যা! মায়েদের আত্ম-নির্ভরতা তো অনেক দূরের বিষয়, কন্যা সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোরও সুযোগ পান না কেউ কেউ। অথচ পৃথিবীর কোনও মা-ই হয়তো চান না যে, তিনি শুধু পুত্র সন্তানের মা হবেন, কন্যা সন্তান পছন্দ করবেন না।
মানসিকতার তফাৎ
স্ত্রী-র সফলতা যে ফিল্ড-এই হোক-না কেন, অনেক স্বামীর তাতে গাত্রদাহ হয়, ইগো প্রবলেম হয়। স্ত্রী যদি উপার্জনও করেন, মা হয়ে ঘরে বাইরে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন— তাহলেও তাকে স্বামীর হাতে মার খেতে হয় অনেকসময়।
অনেক স্বামী আছেন যারা এমনও ভাবেন যে, বাড়ি ছেড়ে আর যাবে কোথায়, দাসীর মতো-ই থাকতে হবে তার কাছে। আর যারা স্ত্রী-কে চাকরি কিংবা ব্যাবসা করার অনুমতিও দেন, তারা স্ত্রী-র উপার্জিত টাকা আত্মসাৎ করেন।
অবশ্য এটা ঠিক যে, ধনী পরিবারের অনেক মায়েরা হয়তো প্রচুর টাকা খরচ করেন নানা ভাবে। তারা হয়তো দামি শাড়ি, গয়না কেনেন, বিউটি পার্লারে যান কিংবা কিটি পার্টিতে টাকা খরচ করেন। এসব আসলে স্ত্রী-র মন ভালো রাখার জন্য স্বামীরা করতে দেন কিন্তু স্ত্রী-কে তার আনুগত্যে রাখার এও এক কৌশল। এরপর স্ত্রী হয়ে যান স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি। যেভাবে ইচ্ছে তিনি সেই সম্পত্তি ব্যবহার করার অধিকার কায়েম করেন।
কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার, অকারণে স্ত্রীর চরিত্র কলুষিত করার কোনও অধিকার স্বামীর নেই। এটাও মনে রাখতে হবে যে, অন্যায় করার পর আদালতের নির্দেশে স্ত্রী এবং সন্তানের জন্য ১০ হাজার টাকা খোরপোশ দিলেই স্বামী মহান ব্যক্তি হয়ে যান না।
বিষয়টা হল এই যে, যাদের স্বার্থে ঘা পড়ছে, তারাই স্ত্রীর উপর জুলুমবাজি করছেন। আর অন্যদিকে সাধারণ এক শ্রেণির মহিলা আছেন যারা পৃথিবীর যে-প্রান্তেই থাকুন না কেন, অত্যন্ত ধর্মভীরু প্রকৃতির। সংসারের শৃঙ্খলে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে এমনই বেঁধে ফেলেন যে, যেখান থেকে তাদের মানসিক উত্তরণ আর ঘটে না।
এই মানসিকতার ধর্মভীরু দুর্বল মায়েদের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের প্রায় ১২০০ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। হয়তো আধুনিক প্রযুক্তি সামান্য পরিমাণে তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়েছে কিন্তু মানসিক ভাবে অনগ্রসরই রয়ে গেছেন তারা।
আসল কথা
আসলে আইনের সীমাবদ্ধতা নয়, এই সীমাবদ্ধতা আমাদের সমাজের মানসিকতার এবং পরিকাঠামোগত দুর্নীতির। একবার অপরাধী পার পেয়ে গেলে, তা অন্যদের আরও সাহসী করে তোলে। ক্ষমতা ও অর্থ সব অপরাধকে লঘু করে দেয়। কখনও ধর্মের জোরে, কখনও অর্থের জোরে পুরুষশাসিত সমাজ মায়েদের আরও বেশি করে যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দেয়। দোষ দেবেন কাকে? কে আসল অপরাধী?
আধুনিকতা আজ পুরোনো চিত্রটা বদলে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু গ্রামের চেহারার পরিবর্তন শহরের তুলনায় কম। এখনও সেখানে পুরুষের সমান অধিকার মেয়েদের দেওয়া হয় না। পরিবারে মায়েরা স্বাধীনতা দাবি করতে গেলেই লাগে দ্বন্দ্ব। ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থা আজও মায়েদের সঠিক মান স্থাপন করতে পেরেছে কিনা মাঝে মাঝে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থাকে। রাস্তায় যেতে আসতে অনেক সময়েই শুনতে হয়, ‘কীসের জন্য চাকরি করছ যখন তোমার স্বামী এত ভালো উপার্জন করছেন? সন্তানের যত্ন নাও ঠিক করে।” এইসব মানসিকতার লোকেদের এটাই হয়তো মনে হয়, ‘মা মানেই শুধু দাসীর মতো কর্তব্য পালন করে যাবে। আর যদি চাকরি করে, তাহলে সে তার সন্তানকে অবহেলা করছে নিজের স্বার্থে অর্থ উপার্জনের জন্য।’ অথচ আধুনিক মায়েরা চাকরি করব বলেই যে মনস্থির করেন, সেটা ঠিক নয় সবসময়। সংসারের আর্থিক চাহিদা মেটানোর জন্যই হয়তো পুরুষদের মতোই চাকরি করতে শুরু করেন তারা। এটাই স্বাভাবিক আজ তাদের কাছে।
বিবাহ পরম্পরায় মেয়েরা স্বামীর সম্পত্তি হিসাবে এক গৃহ থেকে অন্য গৃহে যান। কোনও কোনও জায়গায় তো বহুবিবাহ প্রথা এখনও চালু আছে। স্বামীর একাধিক স্ত্রী দ্বারা সন্তান উৎপাদনের অধিকার থাকলেও, কোনও স্ত্রী যদি পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্কের দরুন সন্তানসম্ভবা হয়, তাহলে সেই সন্তান অবৈধ হিসাবে গণ্য হয়। অর্থাৎ মেয়েদের মনেই বপন করা আছে এক প্রাগৈতিহাসিক ন্যায়-অন্যায়ের বোধ, যার দরুন বাস্তবটা তাদের চোখে পড়ে না।
পরিবর্তন
কিছুদিন আগে পর্যন্ত মায়েদের হাতের কলম কেড়ে নিয়ে ঘরকন্নার কাজে তাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। শিক্ষার আলোর বদলে টেনে নামানো হতো সংসার নামক অন্ধকারের জাঁতাকলে। সেটাই তাদের জীবন, বারবার মনে করানো হতো। তবে আশীর্বাদ এটাই যে, কিছু মানুষ বদলাচ্ছে, সচেতনতা বাড়ছে। কন্যাসন্তানের প্রতি মা-বাবা, সমাজের ধারণায়ও কিছু পরিবর্তন এসেছে।
অনেক সময় দেখা যায় স্বামী কর্মসূত্রে অন্যত্র থাকে। সেই পরিস্থিতিতে স্ত্রী-কেই বাড়ির পুরো দায়িত্ব পালন করতে হয়। বাড়ির বাইরের কাজ যেমন, বাচ্চাদের পড়াশোনা, স্কুলের নানা ঝামেলা, বিভিন্ন বিলের পেমেন্ট, দোকানবাজার— এসব কিছুও স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রীকেই করতে হয়। এছাড়াও তার নিজস্ব সোশ্যাল লাইফ, বন্ধুবান্ধব, নানারকম পলিটিক্যাল কাজে যোগদান করা ইত্যাদিও তার জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবেই জড়িয়ে থাকে।
সবসময় চাকরি করতে বাড়ির বাইরেই যেতে হবে এমন কনসেপ্ট-এ বিশ্বাস করেন না আধুনিক গৃহবধূরা। নিজেদের সোশ্যাল লাইফ, স্ট্যাটাস, মডেল রোল বজায় রাখার জন্য বাড়িতে বসেই অর্থ উপার্জনের বিভিন্ন পন্থা বেছে নেন। অনেকে সফট টয়, চিত্রকলা, ফুলের বোকে বানিয়ে প্রদর্শন করেন এবং বিক্রিও করেন। আবার ছাত্র-ছাত্রী জোগাড় করে বাড়িতে ব্যাচ বানিয়ে নানা ধরনের বিষয়ের উপর ক্লাসও কনডাক্ট করেন। এর থেকেও অর্থ উপার্জনের এবং স্বাধীন থাকার একটা সহজ রাস্তা অনায়াসে বেরিয়ে আসে আধুনিক মায়েদের।
এখন অনেক বাড়ির মায়েরা এতটাই আত্মসচেতন হয়ে গেছেন যে, বাড়িতে তাদের স্বামীরাও স্ত্রী-কে খুশি ও আরামে রাখার জন্য, বাড়ির প্রতিটি কাজে শ্রমদান করতে এতটুকু ইতস্তত করেন না। শিক্ষার দৌলতে এবং সোশ্যাল এক্সপোজারের কারণে এখন অনেক মা ম্যাচিওর হয়ে গেছেন। সুতরাং তারা শক্ত হাতে ‘ঘর ও বাহির’ সামলাচ্ছেন। চাকুরিরতা মহিলা এবং গৃহবধূর মধ্যে আজ আর কোনও তফাৎ নেই। দিনের শেষে দু’জনেই নিজেদের কাজে পারফেক্ট।
মনে রাখতে হবে, এই মায়েরা মুখ বন্ধ করে পরিবারের প্রত্যেকের জীবনের ওঠা-নামার সঙ্গে নিজেকে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রাখেন। সোনার কাঠি ও রুপোর কাঠির ছোঁয়ায় পরিবারের প্রত্যেককে রূপকথার কাহিনির পাত্র-পাত্রী করে তোলেন। তাই তাদের দয়া নয়, সামাজিক অধিকারগুলির বিষয়ে সচেতন করা দরকার।