নারকেলনাড়ু খেতে খেতে মল্লিকা বলল, ‘তুই এসেছিস আমি খুব খুশি হয়েছি। চোখে দেখতে তো পাই না কিন্তু অন্তর দিয়ে তোকে খুব ভালো করে দেখতে পাচ্ছি। আর আশীর্বাদ করছি এবারে একটা সুন্দর মনের মেয়ে দেখে তোর বিয়ে হোক। খুব সুখী হবি তুই।’

রাজেশ বলল, ‘ওসব কথা থাক। এবার আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব আমাদের বাড়িতে। আগামীকাল তুমি তৈরি হয়ে থাকবে। মা আছেন, বাবা আছেন, তুমিও থাকবে আমার সঙ্গে। তোমার কোনও সমস্যা হবে না। আমি এখন তোমাদের আশীর্বাদে সবার দায়িত্ব নিতে পারি।’ মল্লিকা হো হো করে হেসে উঠল।

—ধুর পাগল! এই বয়সে আর কোথাও যাব না রে! উপরওলার দিকে পথ চেয়ে বসে আছি।

—তুমি এমন কথা বললে কিন্তু আমি আর আসব না জেঠিমা।

-আচ্ছা ঠিক আছে। এই মুখে কুলুপ দিলাম! আজ আমি খুব খুশি।

আজ বুধবার। সকাল সকাল রাজেশ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। রাজেশ গাড়িটা বৃদ্ধাশ্রমের সামনে রাখল। বড়ো আনন্দের দিন আজ। যার আশ্রয়ে ও শিক্ষায় নিজে বিকশিত হয়েছে পৃথিবীর বুকে, আজ তাকে নিজের হাতে যত্ন করে সেবা করতে চায় সে। সঙ্গে মাস্টারমশাই ও মা-বাবা-ও এসেছেন সেন বউদিকে নিজেদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। গেট পেরোতে ভিড় উপচে পড়ছে। বয়স্কা আলো মুখার্জি রাজেশকে দেখে এগিয়ে এল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তোমার জেঠিমা আজ কাকভোরে চলে গেলেন। ওনার ছেলে এসেছে কিন্তু উনি শেষ ইচ্ছে আমাদেরকে জানিয়ে গেছেন।”

আলো মুখার্জি আঁচলের গিট খুলে মোটা হীরের নেকলেস রাজেশের হাতে দিয়ে বলল, “এটা দিদি তোমাকে দিতে বলেছেন। তাঁর পূর্বপুরুষের সম্পত্তি যা বহু কষ্ট করে ছেলের হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। আর একটা ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তুমি যেন তাঁর মুখাগ্নি করো, তবেই তাঁর আত্মার শান্তি মিলবে।’

—কিন্তু আমি তো গতকালই জেঠিমার সঙ্গে দেখা করে গেলাম, ঠিকই তো ছিলেন… হঠাৎ কী হল?

—আমাদের এই বয়সে মৃত্যু হঠাৎই আসবে বাছা। দিদির ঘুমের মধ্যে স্ট্রোক হয়েছিল।

চেক আপ করলাম। গ্রামের মাস্টারমশাই রাজেশকে বললেন, ‘বউদির শেষ ইচ্ছে তুমি পূর্ণ করো।”

মায়ের খবর পাওয়া মাত্রই নীল (নীলায়ন সেন) জামশেদপুর থেকে সোজা গাড়ি চালিয়ে এসেছে। পথে আসতে আসতে মনে হল এবার থেকে আর আশ্রমে টাকা পাঠাতে হবে না। কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেল! কিন্তু আশ্রমে এসে বহুদিন পর মাকে দেখে কোথা থেকে ঘনীভূত হওয়া জলীয় বাষ্প হুহু করে অন্তর কাঁপিয়ে তুলল। চারিদিক থেকে যেন মায়ের স্বর প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে ফিরে আসছে—

“বাবু খেয়েছিস তো? কী ভীষণ পরিশ্রম করতে হচ্ছে আজকাল তোকে ! কত রোগা হয়ে গেছিস! আমাকে একবার তোর ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবি? বউমার কোনও কষ্ট হবে না, আমি সব করে দেব। তোদের দেখেই তো আমার শান্তি।’ নীল দুই হাতে কান বন্ধ করল। আবার আস্তে করে হাত আলগা করতে শুনতে পেল, ‘এত চিন্তা করিস না, চাকরিটা ঠিক পেয়ে যাবি।’

অস্থির দলা পাকানো কষ্টটা তোলপাড় করে দিচ্ছে বুকের ভিতরে। শিরা-উপশিরা পাঁজর ভেঙে যেন রক্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে যন্ত্রণা। হিম হয়ে আসছে শরীর। অথচ এতদিন একবারও এমন ভাবে মাকে মনে পড়েনি তো। আজ যেন পৃথিবীটা বড়ো শূন্য। কোথায় একটা বিশাল বড়ো ক্ষতি হয়ে গেছে। নীল চোখের জল আটকে রাখতে পারল না। মায়ের পা ছুঁয়ে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়ল।

রাজেশ কাছে এসে বলল, ‘নীলদাদা তুই যদি চাস তাহলে তুই জেঠিমার মুখাগ্নি করতে পারিস। আর এই বহুমূল্য হীরের নেকলেসটা তুই রাখ। এটা তোর সম্পত্তি।’

নীল বলল, ‘না ভাই, আমি বেঁচে থাকতে মায়ের জন্য কিছু করিনি। মা যখন এই দায়িত্ব তোকে দিয়ে গেছে তুই কর। আর এই উপহার মা তোকে দিয়েছেন, আমি এর যোগ্য নই। যে-সন্তান বেঁচে থাকতে মায়ের যত্ন নেয় না, সে এক পাপিষ্ঠ। মা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন আমি তার কত বড়ো অপদার্থ ছেলে।’

মল্লিকা সেনের নিথর দেহের সামনে ধূপ জ্বলছে। আশ্রমবাসী একে একে রজনীগন্ধার মালায় শেষ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছেন।

মাস্টারমশাই সামনে আসতেই নীল বলল, ‘আমাকে শাস্তি দিন মাস্টারমশাই। আমি ঘোর অন্যায় করেছি। তাইতো মা আমাকে মুখাগ্নি করতেও বারণ করে গেছেন। বেশ, মা যা বলে গেছেন তাই হবে। মায়ের মুখাগ্নি রাজেশ করবি, আমি পাশে থাকব। এতদিন চরম সংকীর্ণতা ও ততধিক লোভ মনের মধ্যে প্রবেশ করেছিল যে, মায়ের দিকে ফিরেও তাকাইনি। আমি আকাট মূর্খ, আমি শয়তান। আজ নিজেকে ধিক্কার জানাই!’

মাস্টারমশাই বললেন, ‘নীল তুমি বউদির মতো মানুষকে অশ্রদ্ধা করেছ। এটা তোমার ঘোর অন্যায়। এই অন্যায়ের ক্ষমা হয় না। ছেলে হিসেবে কোনও কর্তব্য পালন করোনি। একদিন আমি তোমাকে ক্লাসের ফার্স্ট বয় মনে করতাম। তোমাকে ক্লাসে সামনে বসাতাম, রাজবাড়ির ছেলে বলে নয়, তুমি মেধাবী ছিলে বলে। আমি ভেবেছিলাম তোমার মেধায় তুমি আকাশ জয় করবে। তোমার বুকে অসংখ্য নক্ষত্ররা স্থান পাবে। পৃথিবীর মানুষ তোমাকে মাথা উঁচু করে দেখবে। তোমার আলোয় তুমি সবাইকে ভরিয়ে রাখবে। অথচ আজ চারদিকে চেয়ে দ্যাখো— এতজন মানুষের চোখে তোমার জন্য কত ঘৃণা জন্মেছে। তোমাকে এঁরা কত গালিগালাজ করছে। তাচ্ছিল্য করছে। তুমি কতটা খারাপ হয়ে গেছ! এত পেয়েছ তুমি তাও তোমার মনে শান্তি নেই। তোমার পরিসর তো বেশ ব্যাপ্ত ছিল, তবু তোমার বৃত্ত এত ছোটো ছিল কেন বলতে পারো?’

নীল বাকরুদ্ধ হয়ে মল্লিকা সেনের নিথর দেহের পাশে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। একনাগাড়ে ফোন বেজে চলেছে, তবু কোনওদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে নিজের কৃতকর্মের জন্য কাতর ক্ষমা প্রার্থনা করছে সবার অলক্ষ্যে!

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...