ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?’

অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছি শুনে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি সেলিব্রিটি?’

ও ঠিক কী বলতে চাইছে বুঝতে না পেরে আমি ওকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেলিব্রিটি মানে ?’ আমি মনে মনে ভাবলাম হয়তো ওদের ভাষায় কিছু বলতে চাইছে।

ড্রাইভারটি বেশ ভালো করেই আবার বলল, ‘আপনি কি কোনও ফেমাস কেউ, মানে কোনও সেলিব্রিটি?’

এবার আমার হাসার পালা। আমাকে এভাবে হাসতে দেখে ও কী ভাবল কে জানে। তবে চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ পর হাসি থামিয়ে ওকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে দেখে ওর সেলিব্রিটি মনে হল কেন?’ তার উত্তরে খুব সহজ ভাবে ও বলল, ‘এই মলে সেলিব্রিটি ছাড়া কেউ আসে না। দোকানে জিনিসপত্রের দাম দেখেছেন?’

আমার আবার হাসি পেল। হাসি থামিয়ে বললাম, ‘আমি তো এখানে কিছু কিনতে আসিনি। শুধু ডিনার করতে এসেছিলাম।’

এবার যেন আমাদের ড্রাইভার আরও বেশি চমকে উঠল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখানে খাবারের দাম তো আকাশ ছোঁয়া। এখানে একবার ডিনার করলে যা খরচ হবে, সেই টাকায় আমার এক মাস চলে যাবে।’

এর কোনও উত্তর আমার কাছে ছিল না। তবে আমার ডিনারের বিল মোটেও অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। অন্য অনেক দেশের তুলনায় হয়তো বেশ সস্তাই বলা চলে। তবুও আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে বসে রইলাম। হোটেলে নেমে ওকে টাকা দেবার সময় ওর হাতে কিছু টাকা বেশিই দিলাম। অনেকবার আপত্তি করল। তবুও আমার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত হাসিমুখে টাকাটা নিল। লিফট দিয়ে ওঠার সময় মনে হল জীবনের সব কিছুই কত আপেক্ষিক! তবে সারারাত ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথাটা মনের মধ্যে কীরকম যেন কাঁটার মতো বিঁধে রইল।

আজ সকালে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। আজকের প্রথম গন্তব্যস্থল ন্যাশনাল মিউজিয়াম। ইন্দোনেশিয়ার সব থেকে পুরোনো আর বড়ো মিউজিয়াম। ১৭৭৮ সালে ডাচ ঔপনিবেশিকরা এই মিউজিয়ামটি তৈরি করেছিল। সেই সময় এর নাম ছিল ‘বাটাভিয়ান সোসাইটি ফর আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস’। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকবার এর নাম পরিবর্তন হয়ে শেষ পর্যন্ত এটি ইন্দোনেশিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়াম নামে এখন পরিচিত। এই মিউজিয়ামের আরেক নাম ‘গেদুং গাজাহ’, যার অর্থ ‘দ্য হাউজ অফ এলিফ্যান্ট’। ১৮৭১ সালে থাইল্যান্ডের রাজার উপহারস্বরূপ দেওয়া ব্রোঞ্জ নির্মিত একটি হাতির মূর্তি এই মিউজিয়ামের সামনে রাখা আছে, আর সেই থেকে স্থানীয় লোকেরা একে হাতির বাসস্থান বলেই জানে।

ন্যাশনাল মিউজিয়ামে ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক এবং প্রাকৃতিক ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত নিদর্শন এবং প্রদর্শনীর এক বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন, প্রাচীন শিলালিপি, ঐতিহ্যবাহী টেক্সটাইল, সেরামিক এবং বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক জিনিসপত্র। তবে সব থেকে ভালো লাগল এখানকার প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের দেব-দেবীদের এক বিশাল সংগ্রহ দেখে। একদিকে রয়েছে হাজার বছরের পুরোনো পার্বতী, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের মূর্তি, আবার তার পাশেই রয়েছে বুদ্ধ মূর্তি। এখানে ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহ্যবাহী বাটিক বস্ত্র শিল্পেরও রয়েছে এক বিপুল সমাহার। এছাড়াও রয়েছে ডাচ এবং ইন্দোনেশিয়ার রাজা ও সুলতানদের সংগ্রহের নানা জিনিসপত্র, সোনা রুপোর অলংকার, রাজ পরিবারের ব্যবহৃত বাসনপত্র। ঠিক মতো সব কিছু ঘুরে দেখতে হলে একটা সম্পূর্ণ দিন হাতে রাখতে হতো। কিন্তু আমার এই ছোট্ট সফরে সে আশা নেই, তাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে হল।

সূর্য এতক্ষণে মাথার উপরে উঠে এসেছে। বাইরে বেশ গরম। এদিকে খিদেও পেয়েছে বেশ। কাছেই একটা রেস্তরাঁতে লাঞ্চ সেরে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেওয়ার জন্য ড্রাইভারকে বললাম, তামান সুরোপতি পার্কে নিয়ে চলো। দশ মিনিট লাগল পার্কে পৌঁছোতে।

এই পার্কটি জাকার্তার একটি আইকনিক ল্যান্ডমার্ক। ১৯১৯ সালে বাটাভিয়ার তৎকালীন মেয়র জি জে বিসচপ এই পাবলিক পার্কটি তৈরি করেছিলেন। তার নাম থেকেই এই পার্কের নাম হয়েছিল বার্গেমিস্টার (যার অর্থ মেয়র) বিসশোপলিন। স্বাধীনতার পর ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামী উন্টুং সুরোপতির স্মরণে পার্কটির নতুন নামকরণ করা হয় ‘তামান সুরোপতি’। জাকার্তার বায়ু দূষণের মাঝখানে প্রকৃতির কোলে এরকম একটা সবুজে ঘেরা, শান্ত পরিবেশ যেন “পাঁকের পদ্ম ফুল’। পার্কের চারদিকে উঁচু গাছ আর মাঝখানে একটা ফোয়ারা। পার্কের ভিতর রয়েছে বসার ব্যবস্থা। বেশ কিছু লোকজন চেয়ারে বসে আছে। কেউ লাঞ্চ করছে, আবার কেউ পরিবারের লোকজনের সঙ্গে বসে গল্প করছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা জাকার্তার লোকেদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে হোটেলে ফিরে যাব বলে ঠিক করলাম।

ফেরার পথে পার্ক থেকে বেরিয়ে চোখে পড়ল মেন্টেং অ্যান্টিক মার্কেট। এই অ্যান্টিক মার্কেটের নাম আমি আগেও শুনেছি, তবে এভাবে খুঁজে পাব সেটা ভাবিনি। অ্যান্টিক জিনিসের প্রতি আমার একটু দুর্বলতা আছে। তবুও এখানে সময় নষ্ট করব কিনা ভাবছি, এমন সময় আমার হাজব্যান্ড ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল। আমিও হয়তো মনে মনে এটাই চাইছিলাম। এত দূর এসে এই অ্যান্টিক মার্কেট একটু ঘুরে দেখতে না পারলে খারাপ লাগত।

রাস্তার দুই ধারে অনেক জায়গা নিয়ে তৈরি হয়েছে এই অ্যান্টিক মার্কেট। বিদেশি পর্যটকদের কাছে যে এই মার্কেট বেশ জনপ্রিয় সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। বাজারে বিদেশি পর্যটকই বেশি চোখে পড়ল। এখানে আসবাবপত্র, সেরামিক, নানা রকমের গয়না, টেক্সটাইল, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য সংগ্রহযোগ্য বিভিন্ন পুরোনো জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। শুনেছি অনেক ইউরোপীয় ট্যুরিস্ট এখানে আসে ডাচ ঔপনিবেশিক যুগের জিনিসপত্র সংগ্রহ করার জন্য। একটা পাথরের বুদ্ধ মূর্তি খুব পছন্দ হয়েছিল, তবে ওজনের কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত তাকে স্বস্থানে রেখে ফিরে আসতে হল।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...