সকালের খবর কাগজে চোখ বোলাতেই মাধবীলতার চোখ আটকে গেল শিল্প ও সাহিত্যের পাতায়। মাধবীলতা অল্পবিস্তর সাহিত্যচর্চার সঙ্গে জড়িত। রাজনীতি, খেলা, আবহাওয়ার খবর বাদ দিয়ে শিল্প ও সাহিত্যের পাতায় তার ঝোঁক এবং আকর্ষণ দুইই বেশি। সিনেমার কেচ্ছা কেলেঙ্কারি তার আজকাল ভালো লাগে না। যখন তার বয়স অল্প ছিল, তখন ওসবে মন বসত। তার কাছে সংবাদপত্রে আজকের হট খবর এই যে, কলকাতার প্রেস ক্লাবে এ যুগের সেলিব্রেটি ঔপন্যাসিক পরাগ অধিকারীর প্রথম ইংরেজি উপন্যাস ‘আ সানডে নাইট’-এর আনুষ্ঠানিক প্রকাশ সকাল এগারোটায়। অনুষ্ঠানে পাঠক এবং লেখকদের সাদর আমন্ত্রণ।
পরাগ অধিকারী অল্প বয়সে বাংলা সাহিত্যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করার পর সদ্য ইংরেজি সাহিত্যে পা রেখেছেন। তাকে নির্বাচিত কয়েকটি সাহিত্যানুষ্ঠান ছাড়া পাওয়া দুষ্কর। তাছাড়া তাকে নিয়ে অনুষ্ঠান হলেও সকলের সেখানে প্রবেশাধিকার থাকে না। সাংবাদিকরা তার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক ঘোরেন। পৃথিবীতে যে জিনিস দুর্লভ, তার প্রতি আকর্ষণ সবসময় বেশি থাকে। এক্ষেত্রেও পরাগ অধিকারীকে নিয়ে সেই ক্রেজ তৈরি হয়েছিল। শোনা যায় বেশ কয়েক বছর তিনি আমেরিকাতে ছিলেন। মাধবীলতার বহুদিনের সুপ্ত ইচ্ছা পরাগ অধিকারীর সঙ্গে পরিচয় করার।
মাধবীলতা ড্রাইভারকে সকাল এগারোটায় গাড়ি রেডি রাখতে বললেন। সকাল এগারোটা পনেরোয় তিনি প্রেস ক্লাবে পৌঁছালেন। গাড়ি পার্কিং-এর জায়গায় লম্বা লাইন। প্রচুর সাংবাদিক এদিক ওদিক ঘুরছে। মাধবীলতা সানগ্লাসটা চোখ থেকে মাথায় তুলে ড্রাইভারকে নির্দিষ্ট জায়গায় থাকতে বলে ভিতরে ঢুকে গেলেন। হলের ভিতর চারিদিকে আলোর মোহময় পরিবেশ। পরাগ অধিকারী অনুষ্ঠানের মধ্যমণি। তাঁকে সামনাসামনি চোখের দেখা দেখতে প্রচুর লোকজনের সমাগম হয়েছে। শাড়ির আঁচল ঠিক করে মাধবীলতা দর্শকাসনে বসলেন।
পরাগ অধিকারীকে বিভিন্ন খবরের কাগজ অথবা বইয়ের ছবিতে যা দেখতে লাগে, তার থেকে তিনি হাজার গুনে সুন্দর। বয়স প্রায় সাঁইত্রিশের ঘরে। ফর্সা দীর্ঘকায় সুঠাম শরীর। ধারালো নাক। শ্রাবণের মেঘের মতো কালো মাথাভর্তি ঢেউ খেলানো চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। চোখ দুটোতে শান্ত সমুদ্রের গভীরতা। ঈষৎ লালচে পুরু ঠোঁট। মুখে ক্লিন সেভ না করা দু-দিনের দাড়ি। চেহারায় একটা অদ্ভুত আভিজাত্য। সবমিলিয়ে পরাগ অধিকারীর নায়কোচিত চেহারা বললেও ভুল হয় না। তার রূপ এবং গুণের সমন্বয় সোশ্যাল মিডিয়ায় মহিলা ভক্ত সংখ্যার পারদকে দিন দিন চড়িয়েছে।
মাধবীলতা পরাগ অধিকারীর উপন্যাসের একজন বড়ো ভক্ত। সামনে থেকে সুদর্শন সুপুরুষ পরাগ অধিকারীকে দেখে তার মন ব্যাগ্র হয়ে উঠল আলাপ পরিচয় করার জন্য। এক ঘণ্টা পর পরাগ অধিকারীর ইন্টারভিউ এবং বই প্রকাশের অনুষ্ঠান শেষ হল। প্রচুর ভক্ত পরাগ অধিকারীকে মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরল অটোগ্রাফ আর সেলফির আশায়। মাধবীলতার ওই ভিড়ের মধ্যে যেতে ইচ্ছে করল না। সে পরাগ অধিকারীর জন্য প্রেস ক্লাবের বাইরের লনে পায়চারি করতে লাগল। বাঘ শিকারের সময় স্থির দৃষ্টিতে যেমন ওঁত পেতে শিকার ধরে, মাধবীলতার চোখের চাহনিও ছিল ঠিক সেইরকম। পরাগ অধিকারী দ্রুত পায়ে মিডিয়ার লোকজন ও ভক্তদের এড়িয়ে বড়ো ফ্রেমের সানগ্লাসে চোখ ঢেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি বাইরের লন পেরোতেই তার ড্রাইভার বলল, ‘স্যার, গাড়ির স্টার্ট নিচ্ছে না বলে আমি দশ মিনিট আগে গ্যারেজে পাঠিয়েছি। এক ঘণ্টা লাগবে। আপনি একটু অপেক্ষা করুন।’
—রাবিশ। গাড়ি বার করার আগে কি চেক করোনি? সময় নষ্ট করে আমি এক ঘণ্টা ওয়েট করব? দেখেছ চারিদিকে মিডিয়ার লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি কোনওরকমে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছি।
—স্যার, আমি যখন আপনাকে নিয়ে এলাম তখন তো গাড়ি ঠিকই ছিল। গ্যারেজে আমি ফোন করে দেখছি আর কতক্ষণ লাগবে।
—হারি আপ। ফোন করো।
মাধবীলতা পরাগ অধিকারীর কাছে আসার সুযোগ পেলেন। সে পরাগ অধিকারীর কাছে এসে বলল, ‘এসকিউজ মি।”
—ইয়েস। বলুন।
—আমি মাধবীলতা গোস্বামী। আপনার লেখার একজন গুণগ্রাহী। আমিও একটু-আধটু লেখালিখি করি। আপনার আর আপনার ড্রাইভারের কথাগুলো আমি শুনেছি। এখানেই দাঁড়িয়েছিলাম বলে কানে এল। যদি কিছু না মনে করেন আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। আমি লিফট দিতে পারি।
—নো, নো… ইটস ওকে। আমার গাড়ি চলে আসবে। তাছাড়া আপনার আমার ডেস্টিনেশন এক নাও হতে পারে। আমি যাব সল্টলেক। এনিওয়ে, থ্যাঙ্ক ইউ।
—ধন্যবাদ কী জন্য! আমার বাড়ি লেক গার্ডেনস। ডেস্টিনেশন নিয়ে আমার কোনও প্রবলেম হবে না। আপনার ড্রাইভারের মুখে শুনলাম যে, এক ঘণ্টার আগে গাড়ি আসবে না। আপনাকে পৌঁছে দিতে পারলে ভালো লাগবে। আপনার আপত্তি থাকলে অবশ্য জোর করার কিছু নেই।
—না তা নয়। আপনি বলেছেন এটাই যথেষ্ট।
পরাগ অধিকারীর ড্রাইভার কিছুক্ষণ পর এসে বলল, ‘স্যার, গাড়ি সারাতে দেরি লাগবে গ্যারেজে ফোন করে জানলাম। বড়োসড়ো বিগড়েছে। আপনি বরং ওনার সঙ্গেই চলে যান। উনি যখন বলছেন।’
পরাগ অধিকারী হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি ওনার সঙ্গে চলে যাচ্ছি। তুমি গাড়ি সারানো হলে নিয়ে যেও। আর বাড়িতে বলে দিও যে, আমি লাঞ্চ করে ফিরব।’
পরাগ মাধবীলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলুন। কোথায় আপনার গাড়ি?’ মাধবীলতা অদূরে ডান হাত বাড়িয়ে তার গাড়িটাকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই তো ওখানে। আসুন।’ দু’জনে গাড়ির কাছে যেতেই ড্রাইভার দরজা খুলে দিল।
(ক্রমশ…)