বাঙালি মাত্রেই পরম্পরায় অভ্যস্ত। আজও তাই বাঙালি চোখ বিয়ের আসরে নববধূকে দেখতে চায় পারস্পরিক পোশাকে। নববধূ নিজে যদি খুব আধুনিক মনস্কও হন, তাহলেও তিনি বিয়ের আসরে পরম্পরার বাইরে বেরোতে চান না। কারণ, তিনিও জানেন, বাঙালি বিয়ে বেনারসি বাদ দিয়ে ভাবাই যায় না। অবশ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবাদে এখন ‘হাফ অ্যান্ড হাফ’ বেনারসি বাজারে এসেছে। এক্ষেত্রে কাতান বেনারসির বেস টা রেখে, কখনও করা হচ্ছে ঘিচা ও চান্দেরির কম্বিনেশন, কখনও ঘিচার সঙ্গে পশমিনার মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ। মেরুন, লাল, ম্যাজেন্টা প্রভৃতি রঙের সঙ্গে হালকা রঙের ঘিচার কন্ট্রাস্টে, শাড়িটি দেখতে হচ্ছে মেখলার মতো।
এছাড়া কাতানে আনা হচ্ছে লেহেঙ্গার অনুকরণে কাজ, জরদৌসির ভারী নকশা, সঙ্গে নকশাদার ব্লাউজ। কখনও সাধারণ ট্র্যাডিশনাল বেনারসির ডিজাইনে আনা হচ্ছে বৈচিত্র্য। আঁচলের নকশায় লতা-পাতা-গুল্ম থাকলেও, বড়িতে থাকছে জ্যামিতিক নকশা। তবে, ‘হাফ অ্যান্ড হাফ’ বেনারসি বাজারে এলেও, পিওর বেনারসির চাহিদা এতটুকুও কমেনি।
বর্ণাঢ্য এই বেনারসি শাড়ির জন্মস্থান ‘বেনারস’। ইতিহাসের পাতায় পাতায় মুদ্রিত আছে বেনারসির ঐতিহ্য। মসৃণ রেশমের শাড়ির গায়ে সোনালি বা রুপোলি জরির বর্ণময় সাবেক শৈলীটি বেনারসের নিজস্ব সম্পদ। গঙ্গার ধারের এই ‘বেনারস’ শহরটির খ্যাতি শুধু বাবা বিশ্বনাথের জন্যই নয়, বিয়ের বর্ণাঢ্য বেনারসি শাড়ি তৈরির জন্যও।
১৭ শতকে বেনারসি শাড়ি তৈরি হওয়া শুরু হলেও, তা উৎকর্ষতার শীর্ষে পৌঁছায় ১৯ শতকে। মোগল আমলে কলকা আর লতাগুল্মের ঠাস বুননে এক একটা শাড়ি নান্দনিকতা এবং শিল্পকর্মের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। তিনজন কারিগরের মিলিত প্রচেষ্টায় ১৪ দিন থেকে ৬ মাস লেগে যায় এক একটি শাড়ি তৈরি করতে। শাড়ির নকশার উপর নির্ভর করে, কতটা সময় লাগবে তৈরি করতে।
শুধুমাত্র কনের সাজই নয়, বিয়ের আসরে সম্ভ্রান্ত রুচির গৃহিণী তথা কমবয়সি আধুনিকাদের অঙ্গেও শোভা পায় চিরকালীন বেনারসি। এককথায় বলা যেতে পারে, বাঙালি বিয়ের ঐতিহ্যকে আজও অক্ষুণ্ণ রেখেছে বেনারসি শাড়ি।
সলাজ নববধূর চেলি ঢাকা আনত মুখ আর অঙ্গের বেনারসি শাড়ি, সার্থক করে তোলে বিয়ের আবহ। প্রত্যেকটি বেনারসি শাড়ি যেন শিল্পকর্মের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জামদানি, তাঞ্চই, জংলা বা কাতান— যে- বেনারসিই হোক, বিয়ের আসরে তা নজর কেড়ে নেবেই। এই বেনারসির ঐতিহ্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে ইতিহাস খুঁড়লেই। মসৃণ রেশমের শাড়ির গায়ে সোনালি বা রুপোলি জরির বর্ণময় নকশার সাবেক শৈলীটি গড়ে ওঠে বেনারসে।
মূলত চার ধরনের বেনারসি শাড়ি প্রস্তুত হয় এই অঞ্চলে। পিওর সিল্কের উপর কাতান বেনারসি, অর্গ্যাঞ্জা বা কোরা বেনারসি, তাঞ্চই এবং টিসু বেনারসি। বর্তমানে রেশমের পরিবর্তে আরও সস্তায় সিন্থেটিক ফ্যাব্রিকে বেনারসির নকশা তোলা শাড়ি প্রস্তুত হচ্ছে সুরাতে। ফলে বেনারসির বাজারে কিছুটা হলেও মন্দা দেখা দিয়েছে।
বাঙালি বিয়েতে বেনারসির বিকল্প প্রায় নেই বললেই চলে। বর্তমানে ট্র্যাডিশনাল নকশার বেনারসির পাশাপাশি, ডিজাইনে নানা হেরফের আনা হচ্ছে বেনারসিতে। চিরকালীন কলকা, বুটি ও ফ্লোরাল প্যাটার্নের নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর এখন বেনারসি শাড়ি। জর্জেট এবং শান্তির এই দুটো ফ্যাব্রিকও এখন বেনারসিতে ব্যবহার করা হচ্ছে, যা নকশা ফুটিয়ে তোলার জন্য অনন্য। মোগল জমানায় মুসলিম কারিগরদের নকশার ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও, পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্বার্থে কাটওয়ার্ক ও বুটিদার নকশার সৃজন করছেন হাল সময়ের তন্তুবায়রা।
মূলত চার ধরনের বেনারসি শাড়ি প্রস্তুত হয়। পিওর সিল্ক কাতান বেনারসি, অর্গাঞ্জা বা কোরা বেনারসি, তাঞ্চই বেনারসি এবং টিস্যু বেনারসি। বর্তমানে ট্র্যাডিশনাল নকশার পাশাপাশি কলকা, বুটি, জংলা, ভাসকাট, কাটওয়ার্ক ডিজাইনের চাহিদা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। মোগল জমানায় মুসলিম কারিগরদের নকশার ধারাবাহিকতা আজও অক্ষুণ্ণ। তবে, নকশায় হেরফের আনতে এই সময়ের তাঁতিরাও বেনারসি নিয়ে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন।
পিওর সিল্ক কাতান বেনারসি
কাতান খুব সাধারণ একটি ফ্যাব্রিক, যা পিওর সিল্ক সুতোর সঙ্গে বুননের ফলে রূপ পায় বেনারসির। একসময় হ্যান্ডলুমে তৈরি হতো এই শাড়ি। পরবর্তীকালে পাওয়ারলুম এসে পড়ায় এই শাড়ির প্রোডাকশন বিপুল পরিমাণে হচ্ছে।
অর্গ্যাঞ্জা বা কোরা বেনারসি
ব্রোকেডের অপরূপ নকশা তোলা এই শাড়ির বর্ণাঢ্যতা বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য আদর্শ হয়ে উঠেছিল। সোনা বা রুপোর জল করা এই সমস্ত শাড়ি পৌঁছেছিল উৎকর্ষতার শীর্ষে। এখনও তা বাঙালিদের অতি প্রিয় পরিধেয়।
তাঞ্চই বেনারসি
জামেওয়ার নকশার সাবেক বর্ণাঢ্যতাই এই শাড়ির বৈশিষ্ট্য। জরির অপরূপ নকশায় নববধূর সাজকে সম্পূর্ণতা দেয় এই শাড়ি। হালফিল নকশায় আঁচলের কাজ আর বর্ডারে তারতম্য রাখা হচ্ছে। অনেকসময়ই আঁচলটিতে বড়ো কলকা আর পাড় আধুনিক জ্যামিতিক প্যাটার্নে সাজানো হচ্ছে।
টিস্যু বেনারসি
সোনালি জরির ঠাসবুনোটে তৈরি এই শাড়ি আক্ষরিক অর্থেই বিয়ের সন্ধেটিকে ঝলমলে করে তোলে। এই শাড়ির নকশার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল জলে ভাসা পদ্ম। জলের বিন্দুগুলি বোঝাতে জামদানি নকশার আশ্রয়ও নেওয়া হয়ে থাকে। আঁচল আর কুচিতে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি হয় এই শাড়ির নকশা। তবে, ডিজাইনের উপর ভিত্তি করে বেনারসি শাড়িগুলিকে আরও কিছু বিভাগে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে জংলা, কাটওয়ার্ক এবং বুটিদার।
জংলা
নকশার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এই শাড়িটিকে জংলা বেনারসি বলা হয়। গোটা শাড়ি জুড়ে লতাপাতার নকশাই হল এই শাড়ির বৈশিষ্ট্য। এই জংলা মোটিফ-ই বেনারসের প্রাচীন মোটিফের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে আজও। বিবাহ অনুষ্ঠানের জন্য বরাবরই আদর্শ এই জংলা নকশার শাড়ি।
কাটওয়ার্ক
এই শাড়িগুলি সস্তার জামদানি হিসাবেই পরিচিত। করাতকাজ নকশার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয় এই শাড়িতে। চিরকালীন নকশার মধ্যে জুঁই ফুল, গাঁদা ফুল, লতাপাতার মোটিফ খুব বেশিমাত্রায় প্রয়োগ করা হয়।
বুটিদার
সোনা-রুপোর জল করা, সুতোর কাজে ঋদ্ধ এই বুটিদার নকশার বেনারসিগুলি। ব্রোকেডের উজ্জ্বলতায় কনের সাজকে উজ্জ্বলতর করে তোলে এই শাড়ি। আঙুরগুচ্ছ, আশরফি বুটি, লতিফা বুটি, রেখা বুটি, ঝুমুর বুটি, জরি বুটি, লতাপাতা বুটি, বালুচরি বুটি প্রভৃতি নকশার আলংকারিক মেলবন্ধন ঘটে এইসব শাড়িতে। বুটিদার বেনারসি বা আদি অকৃত্রিম লতা-পাতার ডিজাইনে মিক্স অ্যান্ড ম্যাচ করেই ভ্যারাইটি তৈরি হচ্ছে। এক্ষেত্রে আঁচল, কোল আঁচল আর কুঁচিতে মোটিফের হেরফের করে তা ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে তিনটি অংশই আলাদা দেখতে লাগে।
আর আছে থ্রি-ডি কাতান বেনারসি। এক রঙা কোল আঁচল আর কুচি, সেইসঙ্গে আঁচলে সুতো আর জরির নকশাই এর অনন্যতা। এছাড়া স্টোন বসানো জারদৌসি কাজের বেনারসি এখনও বেশ জনপ্রিয়। রিসেপশনের দিন পরার জন্য চলছে ডাবল শেডের (হাফ অ্যান্ড হাফ) জামেওয়ার বা তাঞ্চই। রঙের ব্যাপারে চিরাচরিত লালের শেড ও ম্যাজেন্টা রঙের বেনারসি রয়েছে পছন্দের শীর্ষে।