বেশিরভাগ পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই এখন কর্মরত। সুতরাং, তাদের সন্তানের শৈশব চার দেয়ালের মধ্যেই আবদ্ধ। খোলা জায়গায় তারা খেলাধুলোর বদলে বাড়িতে বসেই অভ্যস্ত ভিডিও গেম-এ। বন্ধু বলতে এখন আর সমবয়সি বাচ্চারা নয়, বরং টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল প্রভৃতি গ্যাজেটস। ভার্চুয়াল দুনিয়াকেই সে আঁকড়ে ধরেছে। এর ফলে বাচ্চার ব্যবহার এবং মানসিকতায় খারাপ প্রভাবই বেশি পড়ছে। বাচ্চা সামাজিকতা শিখে বড়ো হয়ে ওঠার গুরুত্ব বুঝতে পারছে না। ফলে, তার ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটছে না। তাই তাকে সামাজিক সম্পর্কগুলোর গুরুত্ব বোঝান শৈশবেই।
সামাজিকতার প্রয়োজনীয়তা
মানুষ হল সামাজিক প্রাণী। সমাজ থেকে আলাদা হয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সফল এবং ভালো ভাবে জীবন কাটাবার জন্য অন্যদের সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে চলাটাও একান্ত জরুরি। সুতরাং সোশ্যাল স্কিল যদি বাচ্চার মধ্যে ডেভেলপ না হয়, তাহলে বড়ো হয়ে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাচ্চার সমস্যা হতে পারে। সোশ্যাল স্কিল বাচ্চাদের মধ্যে মিলেমিশে থাকার ভাবনা বিকশিত করে এবং বাচ্চাকে আত্মকেন্দ্রিক হতে দেয় না। ফলে, ভবিষ্যতে একাকী হয়ে পড়ার ভয় তার মনে স্থায়ী হতে পারে না।
বাচ্চাদের ব্যবহার দিনে দিনে ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছে। কীভাবে লাগাম লাগানো যায় এই ধরনের ব্যবহারে? এই বিষয়ে মনোবিদদের বক্তব্য – বাচ্চাদের মধ্যে এই ধরনের ব্যবহার এখন খুব কমন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একাকিত্ববোধ, টিভি, ইন্টারনেটে হিংসাত্মক ঘটনাভিত্তিক অনুষ্ঠান দেখা, পড়াশোনার চাপ অথবা দূরে পরিবার থেকে আলাদা ভাবে হোস্টেলে মানুষ হলে, বাচ্চার মধ্যে আক্রমণাত্মক ব্যবহার বেশি চোখে পড়ে। সমাজের মূল ধারার থেকে এরা আলাদা হয়ে পড়ে। অন্য বাচ্চারাও এদের এড়িয়ে চলে। ফলে, চেঁচামেচি করে এরা অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করা এমনকী মারামারি করতেও পিছপা হয় না। বেশি রেগে গেলে হিংস্র হয়ে উঠতেও দেখা যায় অনেক সময়।
সুতরাং ছোটো থেকেই যদি বাচ্চাকে সামাজিক হয়ে ওঠার শিক্ষা দেওয়া হয়, তাহলে এই ধরনের প্রবৃত্তি বাচ্চার মধ্যে জন্ম নিতে পারে না। কিন্তু এক দিনে এই পাঠ দেওয়া সম্ভব নয়। ছোটো থেকেই তাই বাচ্চার সামাজিক শিক্ষার উপর জোর দেওয়া একান্ত জরুরি। চাইল্ড সাইকোলজি বোঝা উচিত অভিভাবকদের।
বাচ্চা যখন ছোটো থাকে
নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির বাচ্চারা পাঁচ বছর পর্যন্ত সাধারণত মা-বাবার সঙ্গে অথবা ঠাকুমা-ঠাকুর্দার সঙ্গে খুব ক্লোজ থাকে। সবকিছুতেই তাদের প্রয়োজন পড়ে একজন অভিভাবকের। অথচ উচিত হচ্ছে, ওই বয়স থেকেই তাদের অপরের উপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে এনে, সামাজিক ভাবে অ্যাক্টিভ করে তোলা।
বাচ্চার সঙ্গে কথা বলুন
চাইল্ড সাইকোলজিস্টদের মতে— একদম ছোটো থেকেই বাচ্চার নাম ধরে তাকে সবসময় সম্বোধন করা উচিত এবং অনবরত তার সঙ্গে কথা বলে যাওয়া খুব জরুরি। ওর আশেপাশে যা কিছু রয়েছে, সেই বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলুন। কোনও খেলনা নিয়ে খেলা করলে, খেলনার নাম জিজ্ঞেস করুন। খেলনার কী রং, কেন ওই খেলনাটা আপনার বাচ্চার পছন্দ এই ধরনের প্রশ্ন সমানে করতে থাকুন। বাচ্চার একা একা খেলার অভ্যাস যাতে গড়ে না ওঠে, তার জন্য প্রতিবেশী বাচ্চার সঙ্গেও তাকে খেলার সুযোগ করে দিন। কারণ, বাচ্চারা খেলতে খেলতে একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে থাকে। এতে সম্পর্ক মজবুত হয়, আত্মীয়তা বাড়ে। বাচ্চার দৃষ্টিকোণ বিকশিত হয়, অপরের সমস্যা বুঝতে শেখে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই গুণগুলি একজন মানুষের মধ্যে থেকে যায়।
সকলের সঙ্গে বাচ্চার পরিচয় করান
নতুন বন্ধু, আত্মীয় অথবা প্রতিবেশীদের সঙ্গে বাচ্চাকে পরিচয় করান ছুটির দিনে। পার্টি বা কোনও অনুষ্ঠানে একসঙ্গে অনেক মানুষের ভিড়ে বাচ্চা মাঝেমধ্যে ঘাবড়ে যায়। কিন্তু যদি আগে থেকেই বাচ্চাকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করাতে থাকেন এবং মাঝেমধ্যেই বাচ্চার সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হতে থাকে, তাহলে বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে বাচ্চা নিজেই শিখে যাবে।
লালন-পালনে পরিবর্তন
বাচ্চার লালন-পালনে মাঝেমধ্যে পরিবর্তন আনাটা জরুরি। প্রয়োজনে যেমন বাচ্চাকে মানসিক এবং শারীরিক সাপোর্ট দেওয়া দরকার, তেমনই তাদের স্পেস দেওয়াটাও খুব জরুরি। চব্বিশ ঘণ্টা তাদের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকবেন না। বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার ব্যবহারে নানা পরিবর্তন আসে। ৩ বছরের বাচ্চা এবং ১৩ বছর বয়সি বাচ্চার সঙ্গে একইরকম ব্যবহার করা উচিত নয়। বাচ্চার ব্যবহারে পরিবর্তন অনুযায়ী, তার সঙ্গে আপনার আচরণেও পরিবর্তন আনাটা জরুরি।
সারাক্ষণ গ্যাজেটস নয়
গ্যাজেটস-এর অত্যধিক ব্যবহার বাচ্চাকে বাহ্যিক পরিবেশ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখে। মস্তিষ্কে অবসাদের স্তর বাড়তে থাকে। এর ফলে বাচ্চার ব্যবহার আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। বাচ্চার সামাজিক স্থিতি বিঘ্নিত হয় এবং বাচ্চা কিছুতে মনঃসংযোগ করতে পারে না। এছাড়াও সারাক্ষণ গ্যাজেটস নিয়ে পড়ে থাকলে বাচ্চা নিজের সঙ্গে যেমন যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে না, তেমনই অপরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতেও তার অসুবিধা হয়। দিনে ২ ঘণ্টার বেশি টিভি কখনওই দেখতে দেওয়া উচিত নয়।
খেলার মাধ্যমে সামাজিক করে তুলুন
অভিভাবকরা যদি বাচ্চাদের সময় না দেন, মজার মজার খেলায় তাদের সঙ্গে মেতে না ওঠেন, তাহলে বাচ্চা বোর ফিল করতে থাকবে। নতুন কিছু করার উৎসাহ যদি বাচ্চা হারিয়ে ফেলতে থাকে, তাহলে মোটিভেট করার জন্য নানারকমের খেলায় তাকে শামিল করুন। এতে সে নতুন করে অনুপ্রাণিত হতে পারবে এবং সামাজিকও হবে।
সন্তানকে বন্ধু করে তুলুন
সন্তানের সঙ্গে আপনি যদি বন্ধুর মতো আচরণ করেন, তাহলে আপনার সন্তান যেমন আপনার সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করবে, কোনও কিছু লুকাবে না, ঠিক তেমনই তার জড়তা কাটবে। সেইসঙ্গে সে সামাজিক হয়ে উঠবে। তাই সন্তানকে খোলামেলা আবহে বড়ো করে তুলুন বন্ধুর মতো। আপনার জীবনের সাধারণ মজার ঘটনা শেয়ার করুন তার সঙ্গে। তাকে বলুন, সেই প্রথম ব্যক্তি যার সঙ্গে আপনি এই কথা শেয়ার করছেন। এর ফলে সন্তানের চোখে আপনিই হয়ে উঠবেন সবথেকে ভালো বন্ধু এবং এই সম্পর্কে বিশ্বাস যদি ছোটো থেকে সন্তানের মনের মধ্যে জায়গা তৈরি করে নিতে পারে, তাহলে সে সামাজিক হয়ে উঠবে সহজেই।