সূর্য এখন প্রায় অস্তগামী। এবার জলের মায়া কাটিয়ে ডাঙায় ওঠার পালা। মন না চাইলেও জল থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে স্নান করে আবার তৈরি হয়ে নিলাম। এবার সময় হল ডিনার করতে যাওয়ার। এখানে বিচের ধারে অনেকরকমের বার আর রেস্তোরাঁ রয়েছে। সবরকম বাজেটের খাবার এখানে পাওয়া যাবে। রেস্তোরাঁর বাইরেও বসে খাবার ব্যবস্থা আছে। আমার কাছে খাবারের থেকে বসার জায়গাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সার্ফারস প্যারাডাইস থেকে সূর্যাস্ত দেখার ইচ্ছেপূরণ করার জন্যই একটা রেস্তোরাঁর বাইরে চেয়ার নিয়ে বসলাম। খাবার খেতে খেতে সার্ফারস প্যারাডাইসের সূর্যাস্ত উপভোগ করার বিরল অভিজ্ঞতা হল।
স্বর্ণকুমারীর রূপ যেন আরও সুন্দর হয়ে ওঠে সূর্যাস্তের লাল আভায়। পুরো গোল্ড কোস্ট যেন সোনার আবরণে ঢেকে নিয়েছে নিজেকে। আস্তে আস্তে লাল থেকে সোনালি, তারপর সোনালি থেকে ধূসর হয়ে শেষ পর্যন্ত পশ্চিম দিগন্তে রবির বিদায় দেখে আমরাও আজকের মতো সার্ফারস প্যারাডাইস বিচকে বিদায় জানিয়ে হোটেলে ফিরলাম।
গোল্ড কোস্টকে অস্ট্রেলিয়ার ‘থিম পার্ক ক্যাপিট্যাল’ বলা হয়ে থাকে। এখানেই রয়েছে পৃথিবীর দ্রুততম, দীর্ঘতম, বৃহত্তম এবং ভয়ংকর রাইডের পার্ক। একটা বা দুটো নয়, এখানে রয়েছে ছয়টি পৃথিবী বিখ্যাত থিম পার্ক। সি ওয়ার্ল্ড, ড্রিম ওয়ার্ল্ড, ওয়েট ‘এন’ ওয়াইল্ড, ওয়ার্নারস ব্রাদার্স মুভি ওয়ার্ল্ড, অস্ট্রেলিয়ান আউট ব্যাক স্পেকটাকুলার, আর আছে হোয়াইট ওয়াটার ওয়ার্ল্ড। বিভিন্ন বয়সি মানুষ এবং তাদের ভালোলাগার কথা মাথায় রেখে এইসব থিম পার্ক তৈরি করা হয়েছে।
তাই পরিবারের যে-কোনও বয়সি সদস্যদের কথা মাথায় রেখে ট্যুরিস্টরা ঠিক করে নিতে পারেন কোন কোন থিম পার্কে তারা যেতে চান। হাতে সময় থাকলে সবগুলো পার্কে যাওয়া যেতে পারে। তবে একদিনে সবগুলো পার্কে যাওয়ার পরিকল্পনা না করাই ভালো। হাতে সময় নিয়ে পার্কগুলো ঘুরে দেখতে পারলে সারা জীবনের মতো বিশেষ কিছু স্মৃতি নিয়ে পর্যটকরা বাড়ি ফিরবেন, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
আজ গোল্ড কোস্টে আমাদের দ্বিতীয় দিনের পরিকল্পনায় রয়েছে ড্রিম ওয়ার্ল্ড আর মুভি ওয়ার্ল্ড ঘুরে দেখার। ড্রিম ওয়ার্ল্ড অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড়ো থিম পার্ক। এখানে ৪০টিরও বেশি রাইড এবং অন্যান্য আকর্ষণীয় বিষয় আছে। এখানকার “টাওয়ার অফ টেরর ২’ পৃথিবীর সব থেকে উঁচু এবং দ্রুততম রাইড। একদিকে ভয়, অন্যদিকে রোমাঞ্চ, এই দুইয়ের যুগলবন্দী। এই বিরল অভিজ্ঞতা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মনের মণিকোঠায় থেকে যাবে। এরপর গেলাম টাইগার আইল্যান্ড। এখানে রয়েছে বেঙ্গল আর সুমাত্রা থেকে আনা বাঘ। এরা ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য নানারকম খেলা দেখায়।
এছাড়াও আছে ‘অস্ট্রেলিয়ান ওয়াইল্ডলাইফ এক্সপিরিয়েন্স’। এখানে পাঁচশোর বেশি অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় জীবজন্তু (native animal) রয়েছে। এরপর ছোটো টয় ট্রেন (ড্রিমওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস)-এ করে পার্কের চারিদিকে ঘুরে বেড়ালাম। সেন্ট্রাল পার্ক স্টেশন থেকে প্রতি ২০ মিনিট পর পর এই ট্রেন পাওয়া যাবে। এত বড়ো পার্কের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গেলে ড্রিমওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেসে উঠে বসলে ক্লান্তিও দূর হবে, আর পরের গন্তব্যস্থলেও তাড়াতাড়ি পৌঁছানো যাবে।
ড্রিমওয়ার্ল্ডে অনেকরকমের খাবারের দোকানও রয়েছে। আমরা এখান থেকেই লাঞ্চ করে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল ওয়ার্নারস ব্রাদার্স মুভি ওয়ার্ল্ডের উদ্দেশে। মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরত্ব, দশ মিনিটও লাগল না পৌঁছাতে।
কল্পনার জগতে হারিয়ে যাওয়ার জন্য ওয়ার্নারস ব্রাদার্স মুভি ওয়ার্ল্ডের থেকে ভালো জায়গা হয়তো খুব বেশি পাওয়া যাবে না। এখানেই দেখা হবে আপনাদের প্রিয় সিনেমা জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ নায়ক এবং খল নায়কদের সঙ্গে। এর সঙ্গে উপভোগ করা যাবে পৃথিবী বিখ্যাত ভয়ংকর কিন্তু মজার সব অ্যাডভেঞ্চার রাইড। “ডি সিরাইভাল হাইপার কোস্টার’ এখানকার সব থেকে রোমাঞ্চকর রাইড। এছাড়া মজার রাইডের মধ্যে আছে স্কুবি ডু স্পুকিকোস্টার, ওয়াইল্ড ওয়েস্ট ফল্স অ্যাডভেঞ্চার রাইড, সুপারম্যান এস্কেপ এবং গ্রিন ল্যানটার্ন কোস্টার। ছোটো বাচ্চাদের পছন্দের জায়গা ‘কিডজফান জোন’-এ দেখা হবে বাগস বানি, ড্যাফি ডাক সহ আরও কত সিনেমার চরিত্রের সঙ্গে। বিকেল পাঁচটায় মুভি ওয়ার্ল্ড বন্ধ হয়ে যায়। তাই আগে থেকেই হাতে একটু সময় নিয়ে গেলে এখানে অনেকক্ষণ সুন্দর সময় কাটানো যায়।
মুভি ওয়ার্ল্ড থেকে বেরিয়ে এবার যাত্রা শুরু হল “কিউ ১ টাওয়ার’-এর উদ্দেশে। ‘কিউ ১’ কুইন্সল্যান্ডের নাম্বার ওয়ান টাওয়ার। এটি অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ আবাসিক ভবন। এর উচ্চতা ৩২২ মিটার। এর উপরে ৭৭ এবং ৭৮ তলায় রয়েছে অবজারভেশন ডেক। এটি অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র বিচ সাইড অবজারভেশন ডেক। এখানে একসঙ্গে ৪০০ জন লোক দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে পারে। এখানে দাঁড়িয়ে ৩৬০ ডিগ্রিতে উত্তরে ব্রিসবেন, দক্ষিণে নিউ সাউথ ওয়েলসের বায়রন বে, পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর আর পশ্চিমে গোল্ড কোস্টের আশপাশের জায়গাগুলো পরিষ্কার দেখা যায়। উপরে উঠে দেখলাম এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখার জন্য ইতিমধ্যেই অনেক লোকের ভিড় হয়েছে। সবাই ফটো তুলতে ব্যস্ত। কিউ ১ টাওয়ার-এর উপর থেকে নীচের আলো ঝলমলে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ যেন মুহূর্তে এই ‘স্বর্ণকুমারী’-র আরও এক রূপ নিয়ে হাজির হল। সত্যিই এ এক বিরল অভিজ্ঞতা।
গতকাল ড্রিম ওয়ার্ল্ড আর মুভি ওয়ার্ল্ড ঘুরে দেখেছি। আজকের লিস্টে আছে সি ওয়ার্ল্ড আর ওয়েট‘এন’ওয়াইল্ড। প্রথমেই শুরু করলাম সি ওয়ার্ল্ড দিয়ে। এখানে ট্যুরিস্টরা ডলফিনের সঙ্গে সাঁতার কাটতে পারে। আবার খুব কাছের থেকে সীল, পোলার বিয়ার, স্টিং রে, পেঙ্গুইন এমনকী শার্ক-ও দেখতে পারবে। দিনে বেশ কয়েকবার ডলফিন শো হয় এখানে। এখানকার ডলফিনের খেলাধুলা আর কারসাজি ট্যুরিস্টদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। যে কেউ এখানে ডলফিনের প্রেমে পড়ে যাবে। সবার দেখাদেখি আমরাও এখানে ডলফিনকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুললাম। এখানেও অনেকগুলো রাইড আছে, তার মধ্যে জেট রেসকিউ, সি ভাইপর, আর স্টর্মকোস্টার খুব জনপ্রিয়। সঙ্গে যদি ছোটো বাচ্চা থাকে তাহলে ডোরা আর স্পঞ্জ বব শো অবশ্যই দেখতে হবে। এরপর এখান থেকেই লাঞ্চ করে আবার বেরিয়ে পড়লাম ওয়েট‘এন’ওয়াইল্ড থিম পার্কের উদ্দেশে।
ওয়েট‘এন’ওয়াইল্ড-এর নাম থেকেই বেশ বোঝা যাচ্ছে এখানে গিয়ে অনেকটা সময় জলে কাটাতে হবে। এটি অস্ট্রেলিয়ার সব থেকে বড়ো ওয়াটার থিম পার্ক। এখানে কয়েকটি চূড়ান্ত উত্তেজনা সৃষ্টিকারী ওয়াটার রাইড রয়েছে, তার মধ্যে ব্ল্যাক হোল বিখ্যাত। এখানে কয়েকটি পুল আছে যেখানে কৃত্রিম ভাবে ঢেউ তৈরি করা হয়েছে সার্ফিং করার জন্য। এছাড়াও আছে ছায়াঘেরা নির্জন জায়গা, যেখানে পরিবারের সবাই মিলে বসে বিশ্রাম নেওয়া যায়। গোল্ড কোস্টের গ্রীষ্মের দহন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ওয়েট‘এন’ওয়াইল্ড একদম আদর্শ জায়গা। সারাদিন এখানে কাটিয়ে বিকেলে হোটেলে ফিরে এলাম। শরীরে ক্লান্তি, কিন্তু মনে ভরপুর সতেজতা। গোল্ড কোস্টের এইসব ছেলেমানুষি, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা মনের বয়সকে যেন এক ধাক্কায় কমিয়ে দিয়ে সেই ছোটোবেলায় নিয়ে গেল।
(ক্রমশ…)