বদলে যাওয়া বিশ্বে এগিয়ে থাকার এবং সফল হওয়ার জন্য ক্রমশ তৈরি হচ্ছে মানসিক চাপ। আর এই চাপ অনেকের জন্য অস্বস্তিকর এবং চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। অবশ্য অভিভাবকরা নিশ্চয়ই চাইবেন, তাদের সন্তানরা ভালো করুক এবং সুখী জীবনযাপন করুক। কিন্তু অনেক অভিভবক জানেন না যে, সন্তানের সুস্থ-স্বাভাবিক এবং সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তাদের প্রস্তুত করার সর্বোত্তম উপায়গুলির মধ্যে একটি হল— আত্মবিশ্বাস তৈরিতে সহায়তা করা। কারণ, আত্মবিশ্বাস জীবনের চ্যালেঞ্জগুলিকে ওভারকাম করার মূল চাবিকাঠি। ‘আমি এটি করতে সক্ষম’ এই আত্মবিশ্বাস সন্তানের মনে গেঁথে দিতে হবে ছোটো থেকেই।
মা-বাবার উৎসাহ এবং সাকারাত্মক জীবনবোধ বাচ্চার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। বাচ্চার নিজের উপর এবং অন্যান্য সবকিছুর উপরে একটা ধারণা তৈরি হয়, যেটা ওই ছোটো বয়স থেকেই বাচ্চার কনফিডেন্স বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। বাচ্চার দুর্বল আত্মবিশ্বাস তাদের নিজের মনের মধ্যে গুটিয়ে থাকা মনোভাব তৈরি করে এবং চুপচাপ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। মা-বাবাকে বাচ্চার এই মানসিক পরিস্থিতির সংকেতগুলো বুঝতে হবে এবং সেইমতো পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এভাবে বাচ্চারও আত্মবিশ্বাস বাড়বে এবং সেইমতো সমস্যার মুখোমুখি হয়ে সমাধানের সাহস সে খুঁজে পাবে। মনে রাখবেন, সন্তান আত্মবিশ্বাস অর্জনের শিক্ষা পেয়ে থাকে পরিবারের সদস্যদের থেকে। কিন্তু এক্ষেত্রে বাবা এবং মা-কে কী ভূমিকা পালন করতে হবে, সেই বিষয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট শ্রীতমা ঘোষ-এর গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য এবং পরামর্শ তুলে তুলে ধরা হচ্ছে।
কৌতূহলী হতে দিন
বাচ্চা বারবার প্রশ্ন করলে বিরক্ত হবেন না। বাচ্চার মনে কৌতূহল থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। তাকে প্রশ্ন করতে উৎসাহ দিন। প্রশ্ন করাটা বাচ্চার মানসিক বিকাশের জন্য খুব জরুরি। এতে তার আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায় এবং প্রচেষ্টা বাড়বে।
বাচ্চার সঙ্গে ইন্টার্যাক্ট করুন
বাচ্চাকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ইন্টার্যাক্ট করবার সুযোগ করে দিন যাতে সম্পর্কের ভ্যালু সে ছোটো থেকেই বুঝতে পারে এবং তার সোশ্যাল লাইফ বিকশিত হতে পারে। বাচ্চার সঙ্গে সহানুভূতিপূর্ণ সহৃদয় ব্যবহার করুন। বাচ্চার প্রতি স্নেহশীল হোন। এর ফলে বাচ্চার সম্পর্ক গড়ে তুলতে সুবিধে হবে এবং মনের কথা খুলে বলার মতো কনফিডেন্স বাড়বে।
নিজের পছন্দ বেছে নেওয়ার সুযোগ দিন
অভিভাবকদেরই সুযোগ করে দিতে হবে বাচ্চাকে নিজের পছন্দ বেছে নিতে। বড়োরা বাছাইয়ের সুবিধা করে দিলেও পুরো ব্যাপারটায় ইন্টারফিয়ার না করে বাচ্চাদের উপর ছেড়ে দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। নিজের পছন্দের বিকল্প বেছে নেওয়া এবং নিজের পরিস্থিতি নিজেই সামলে নেওয়ার স্বাধীনতাও বাচ্চার উপর ছেড়ে দেওয়া ভালো। এতে বাচ্চার কনফিডেন্স বাড়বে। ডিসিশন নিতে শিখবে এবং কী বেশি পছন্দ, সেটা ভালো করে বোঝার ক্ষমতা তৈরি হবে।
বাহবা এবং পুরস্কার দিন
প্রতিটি পদক্ষেপে বাচ্চাকে বুঝতে দিন যে, তার মা-বাবা তাকে ভালোবাসে। বাচ্চাকে বলুন, প্রত্যেক বাচ্চার মধ্যেই কোনও না কোনও গুণ অবশ্যই থাকে এবং প্রত্যেক ইনডিভিজুয়ালের মধ্যেই বিশেষ ক্ষমতা ও প্রতিভা থাকে। বাচ্চার সঙ্গে পজিটিভ আলোচনা করুন এবং হাবভাবে অথবা ছোটো ছোটো কথায় বাচ্চার সাফল্যের প্রশংসা করুন। উৎসাহ দেওয়ার জন্য বাচ্চাকে ছোটো ছোটো পুরস্কার দিন, যেটা আপনার বাচ্চা পছন্দ করে। জিনিস দামি হতে হবে এমন কিন্তু নয়। আশা অনুযায়ী ফল না পেলে অযথা বাচ্চাকে বকাবকি করবেন না। পরেরবার ভালো করতে উৎসাহ জোগান।
অন্যের সঙ্গে তুলনা করবেন না
নিজের বাচ্চার ক্ষমতার তুলনা অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে কখনও করবেন না। প্রত্যেক বাচ্চার আলাদা আলাদা গুণ থাকে। মানসিক গঠনও আলাদা হয়। সন্তানের সঙ্গে অন্য বাচ্চাদের তুলনা করা হলে বাচ্চার মনে হীনমন্যতা জন্ম নিতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মনোভাবও তৈরি হয়। ফলে বাচ্চারা ঈর্ষাপরায়ণ এবং বিদ্বেষপ্রবণ হয়ে ওঠে। বাচ্চার শরীরের জন্যও এটি যথেষ্ট ক্ষতিকারক।
দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কাজ করার সাহস জোগান
বাচ্চা যখন কারও দেওয়া কাজ নিজে নিজে শেষ করে তখন বাচ্চার মন আত্মবিশ্বাসে ভরে ওঠে। কাজের প্রতি তার উৎসাহ বেড়ে যায়। রাহুল কিছুতেই নিজের জুতোর ফিতে বাঁধতে পারত না। কিন্তু ওর মা-বাবা সবসময় ওকে বলতেন যে, চেষ্টা করতে করতেই একদিন ওই কাজটা ও নিশ্চয়ই করতে সফল হবে। শেষ পর্যন্ত রাহুল সত্যিই কাজটা করতে সফল হয়। এই ভাবে বাচ্চাকে সব কাজে এনকারেজ করা উচিত, যাতে বাচ্চা নিজের উদ্যমেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।
শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলুন
বাচ্চা নিজের বন্ধু এবং শিক্ষকদের সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করে সেটা অভিভাবকদের খোঁজ রাখা একান্ত কর্তব্য। এতে বাচ্চার সামাজিক জীবন বুঝতে মা-বাবার অনেকটা সুবিধা হবে। অনাত্মীয়দের প্রতিও বাচ্চার কী ব্যবহার সেটা লক্ষ্য রাখা উচিত বড়োদের। এ ছাড়া যদি বাচ্চার কোনও কিছুতে সমস্যা হয় অথবা শেখার পথে কিছু অন্তরায় দেখা দেয়, তাহলে সেটা বুঝতেও অভিভাবকদের অনেকটা সুবিধা হবে। সেইমতো প্রয়োজন অনুযায়ী বাচ্চার খেয়ালও তারা রাখতে পারবেন। সুতরাং বাচ্চার বন্ধু এবং শিক্ষকদের সঙ্গে সময়ে সময়ে কথা বলুন এবং বাচ্চার পছন্দ জানার চেষ্টা করুন।
কাল্পনিক খেলাকে মাধ্যম করুন
সাধারণত বাচ্চারা আশপাশের মানুষদের এবং জিনিসপত্রের সঙ্গে মনে মনে একটা কাল্পনিক খেলার পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে সেই কল্পলোকে বাচ্চা নিজেকে একটা প্রধান ভূমিকায় দেখতে চায়। এই ধরনের কাল্পনিক খেলার মাধ্যমে বাচ্চারা বড়ো কিছু নিয়ে ভাবতে শেখে এবং জীবনে সেটা হয়ে ওঠার স্বপ্নই দেখে। বড়োরাও বাচ্চাদের সঙ্গে এই ধরনের খেলায় যদি অংশগ্রহণ করেন, তাহলে বাচ্চা কী ভাবনাচিন্তা করছে সেটা বুঝতে পারবেন এবং বাচ্চার আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করতে পারবেন।
সম্পর্কের ভিত হচ্ছে ভরসা। বাচ্চাকে ভালোবাসুন, সম্পর্কের ভিত শক্ত করুন। সম্পর্কের ভিত যদি ভরসার হয়, তাহলে সমস্যা এলে স্বাভাবিক ভাবেই বাচ্চা, মা-বাবার কাছেই আগে আসবে। মা-বাবার উপদেশ শুনবে এবং সেই কথার সম্মানও করবে। বাচ্চার নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়লে বাচ্চা অপরের সঙ্গে যেমন সহজে মিশে নিজের মত প্রকাশ করতে পারবে, তেমনি অপরের কথাও মন দিয়ে শুনবে এবং অপরের কথাকেও সম্মান দিতে শিখবে। সহজে সকলের মাঝে নিজের একটা জায়গা তৈরি করে নিতে সক্ষম হবে বাচ্চারা।
বিশেষ পরামর্শ
O শিশুরা তখনই আত্মবিশ্বাস অর্জন করে, যখন তারা অভিভাবকদের বিশ্বস্ত বোধ করে এবং নিজেকে সক্ষম মনে করে। তাদের বয়স অনুযায়ী উপযুক্ত দায়িত্ব দেওয়া, তাদের দক্ষতার অনুভূতি বাড়িয়ে তোলে। যেমন ছোটো থেকেই নিজের জুতো নিজে পরা, বিছানা করা কিংবা গুছিয়ে রাখা, রান্নায় সাহায্য করা ইত্যাদি।
O আপনি আপনার সন্তানকে ছোটো ছোটো কাজ দিয়ে শুরু করতে পারেন, যা তারা পরিচালনা করতে পারে। এমনকী যদি তারা কার্যকর ভাবে প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হয়, তাদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করুন।
O ব্যর্থতা জীবনের একটি অংশ এবং এটি কীভাবে মেনে নিতে হয় এবং এর থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে কীভাবে সফল হওয়ার চেষ্টা করতে হয়, তা শেখাতে হবে। মনে রাখবেন, শুধুমাত্র গ্রেড, ট্রফি বা জয়লাভ করলে যদি প্রশংসা করেন, তাহলে ব্যর্থতার ভয়ে মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে কিংবা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে আপনার সন্তান। বরং যখন আপনার সন্তান একটি কাজ শেষ করে কিংবা আপ্রাণ চেষ্টা করে, তখন তারা যে কঠোর পরিশ্রম করেছে, তা স্বীকার করুন। তাদের জানান যে, আপনি তাদের প্রচেষ্টার জন্য গর্বিত।
O শিশুরা যখন মানসিক এবং শারীরিক ভাবে নিরাপদ বোধ করে, তখন তারা উন্নতি লাভ করে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তাদের ঝুঁকি নিতে, নতুন জিনিস চেষ্টা করতে এবং কঠোর সমালোচনা বা উপহাসের ভয় ছাড়াই বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। আপনি তাদের বুঝিয়ে বলুন যে, তাদের সাফল্য বা ব্যর্থতা নিঃশর্ত ভাবে আপনারা মেনে নেবেন।
O বাচ্চাদের সিদ্ধান্ত নিতে এবং তাদের নিজস্ব সমস্যাগুলি সমাধান করার অনুমতি দিলে, তাদের আত্মবিশ্বাসকে উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে। যখন তারা অনুভব করে যে, তাদের মতামত এবং ধারণাগুলি গুরুত্বপূর্ণ, তখন তারা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তে বিশ্বাস করা শুরু করবে।
O বড়ো লক্ষ্যগুলিকে ছোটো ছোটো ধাপে ভাগ করুন। আপনার সন্তান যদি বাইক চালানো শিখতে চায়, তাহলে প্রথমে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সাইকেল চালানো শিখতে বলুন। আত্মবিশ্বাস সামাজিক সম্পর্ক উন্নত করে। তাই, আপনার সন্তানকে সমবয়সিদের সঙ্গে মিশতে দিন এবং বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে দিন।
O কিন্তু একটা বিষয়ে সতর্ক থাকবেন, এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সন্তানরা সহজেই অন্যের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করার ফাঁদে পড়ে যায়। এই স্বভাব আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিতে পারে। তাই, আপনার সন্তানকে শেখান যে, প্রত্যেকের আলাদা শক্তি এবং প্রতিভা রয়েছে। অতএব, অন্যদের সঙ্গে নিজের তুলনা করে কোনও লাভ নেই। যখন আপনার সন্তান নিজেকে একজন সহপাঠী কিংবা সহকর্মীর সঙ্গে তুলনা করে, তখন তাদের ফোকাসকে ঘুরিয়ে দিন। এর জন্য সন্তানের অন্য গুণগুলি তুলে ধরুন এবং নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করতে বলুন।
O জীবন সবসময় মসৃণ ভাবে চলবে না, তাই দীর্ঘমেয়াদী আত্মবিশ্বাস তৈরির জন্য আপনার সন্তানকে কীভাবে বাধা এবং হতাশা মোকাবিলা করতে হয়, তা শেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বুঝতে সাহায্য করুন যে, চ্যালেঞ্জগুলি জীবনের অংশ এবং তাদের কাটিয়ে ওঠার শক্তি রয়েছে। আর যখন আপনার সন্তান কোনও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়, তখন গভীর শ্বাস নিয়ে কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয়, সেই কৌশলগুলি তাকে শেখান।
O শিশুদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করা একটি বিশেষ প্রক্রিয়া। এর জন্য ধৈর্য লাগে। তাই আপনি আপনার সন্তানকে তার ক্ষমতার উপর আস্থা রাখার পরামর্শ দিন এবং সাহস জোগান। আর এক্ষেত্রে সমস্যা যদি বেড়ে যায় কিংবা জটিল হয়ে ওঠে, তাহলে অবশ্যই একজন মনোবিদের পরামর্শ এবং সাহায্য নিন।
শ্রীতমা ঘোষ, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, মনোশিজ।