দিয়া সকালে উঠেই মানবের জন্য আগে গ্রিন-টি বানিয়ে রাখে। ঘুম থেকে উঠে মেয়ে শ্রেয়াকে কোলে বসিয়ে গ্রিন-টির স্বাদ নেয় মানব। বাবা-মেয়ের সারাদিনের নিবিড় মুহূর্ত বলতে সকালটুকুই। তারপর বস্তাবন্দী কাজ আর কাগজ নিয়ে, কোনওমতে ব্রেকফাস্ট করে, দু-চাকায় শরীর চাপিয়ে দৌড়োয় অফিস। দিয়া তারপর শ্রেয়াকে খাইয়ে পরিয়ে স্কুলবাসে তুলে দেয়। সারাদিনের জন্য এবার ঘর ফাঁকা হয়ে যায়। এই অবসরের শূন্যতা মেটাতে দিয়া একটা সেলাইয়ের ক্লাস খুলেছে।
গরিব অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মেয়েদের স্বনির্ভর হওয়ার জন্য শিক্ষা দেয় এখানে। বেতন বলতে সামান্যটুকু। কেউ কাজ শিখে গেলে, নিজেদের মতো অর্ডার নিয়ে এসে দিয়ার ঘরেই তৈরি করে। তার জন্য অবশ্য দিয়া ওদের কাছে থেকে কিছুই নেয় না। বিকেলের পর একটু জিরিয়ে নেয় সে। তারপরই তো শ্রেয়া চলে আসে। হাতমুখ ধুয়ে, হেল্থ ড্রিংক খেয়ে বেরিয়ে পড়ে খেলতে। সন্ধে নামতেই ওর দিদিমণি পড়াতে আসে। তারপরই ঢোকে মানব। সোফায় খানিক আরাম করে বেরিয়ে যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। ফেরে রাত করে। খাওয়ার টেবিলে দিয়ার সঙ্গে কয়েকটা কেজো কথা বলে শুয়ে পড়ে। দিয়াও অভ্যস্ত হয়ে গেছে গত দশ বছরের এই সাংসারিক অভিজ্ঞতায়।
বেশ কদিন যাবৎ দিয়া রাতের দিকে বিছানায় শুতে এলে ওর কেমন শীত শীত করে। ফ্যানটা কমাতে বললে শ্রেয়া ঘেমে ওঠে, বিরক্ত হয় মানবও। বলে, “তুমি কী যে বলো দিয়া! এত গরমে তোমার শীত করে? রক্ত কমেছে নাকি?” ডাক্তার দেখিয়েছে মানব। সেরম কিছু ধরা পড়েনি। শীতে কুঁকড়ে যায় দিয়া। কম্বলও নিয়েছিল। তাও সুরাহা হয়নি।
নিত্য রাতের মতো আজও শীত করছে ওর। জানলা দিয়ে বরফের মতো ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে মনে হচ্ছে দিয়ার। অথচ বাবা আর মেয়ে দিব্যি শুয়ে হাত পা ছড়িয়ে! ঘড়ির কাঁটা টিক টিক শব্দে এগিয়ে যাচ্ছে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসে দিয়া। হাতের তালু ঘষে গরম করে। নিঝুম রাত! চারদিক অন্ধকার। অমাবস্যার রাত বলে কথা। রাস্তার কয়েকটা কুকুর চিৎকার করছে। আর কোনও শব্দ নেই সমস্ত পাড়াজুড়ে।
দিয়া কম্বলটা কাঁধ অবধি তুলে নিতে গেল৷ সেইসময়ই সদর দরজা থেকে কড়া নাড়ার শব্দ এল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকাল দিয়া। রাত আড়াইটে! এত রাতে কে? ধাক্কা দিয়ে মানবকে ডাকল দিয়া, ‘অ্যাই শুনছ? দেখো না কে এল এত রাতে? ওঠো না! আমার ভয় করে।’ মানব ঘুমের ঘোর ভেঙে বলল, ‘কেউ আসেনি। ঘুমাও তো। জ্বালিও না।”
দিয়া আর ডাকেনি। মানব অল্পতেই বিরক্ত হয় ও জানে। কিছুক্ষণ বসে রইল… আবার কড়া কেউ নাড়ে কিনা শোনার জন্য। ঠিক তাই! আবার কেউ কড়া নাড়ছে। উঠে গেল এবার দিয়া। প্রচণ্ড শীত করছে ওর। কাঁপতে কাঁপতে গিয়েই দরজার ভিতর থেকে হাঁক দিল, কে? কড়া নাড়ার আর কোনও শব্দ নেই। তার কিছুক্ষণ পরই রান্নাঘরের জানলাতে আওয়াজ পেল দিয়া। মনে মনে ভাবল, বিড়াল বোধ হয়। আপন মনে, নিজের ঘরে চলে গেল দিয়া। বিছানার কাছে মেয়েটাকে বসে থাকতে দেখে আঁতকে উঠল ও। গলা একপ্রকার শুকিয়ে গেল। খ্যাসখ্যাসে গলায় বলে উঠল দিয়া, ‘কে তুমি? কীভাবে ঢুকলে ঘরে?”
মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যায় না। মাছি উড়ছে ভনভন করে… পচে গেছে মুখের অর্ধেকটা! গায়ে পোকা ধরেছে! চোখগুলো নেই কেবল কোটর দুটো পড়ে আছে। একটা দুটো মাছি ঘরময় উড়ছে। আতঙ্কে জ্ঞান হারাল মুহূর্তেই দিয়া। জ্ঞান আসার পর, মানবকে দেখে ভয়ে কেঁদে ফেলল।
—তোমার কী হয়েছে বলো তো? রাতে বিছানায় না শুয়ে ঘরের দুয়ারে কেন?
—মেয়েটা কীভাবে ঢুকল আমাদের ঘরে?
—মানে? কোন মেয়ে?
—মাছি উড়ছিল, সারা শরীরে পোকা…।
—হ্যাট…ট! যত রকমের ফালতু কথা। শরীর কেমন বলো।
—ভালো। কথা এগোয় না আর দিয়া। মানব কোনওদিন ভালোবেসে বুঝতেই চায়নি ওকে। বিয়ের পর একটু একটু করে বুঝেছে দিয়া। কোনও কমতি সে দেয়নি। খাওয়া পরা আর্থিক স্বাধীনতা সব দিয়েছে। দেয়নি শুধু সময়, ভালোবাসা আর সান্নিধ্য।
মানব ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলল, ‘শ্রেয়াকে ওর ঠাকুমা ক’দিনের জন্য নিয়ে যেতে বলছে, যাবে? ওর স্কুলে তো পরীক্ষা নেই এই মাসে।’
দিয়া বলল, “ঠিক আছে যাক। তুমি তাহলে আজ আসবে না তো?”
মানব বলল, “আজ না এলেও, কাল অফিস করে একবারে চলে আসব। আজকে না হয়, মিনুকে বোলো তোমার সঙ্গে থাকতে! টাকা চাইলে বোলো, দাদা এসে দেবে।’ ঘাড় নাড়ায় দিয়া।
বেরোবার আগে মানব বলে, ‘এরকম কোরো না। সুস্থ রাখো নিজেকে। আমি সকালের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিয়েছি। দু’জনে খেয়েও নিয়েছি। তুমি খেয়ে নিও। শ্রেয়াকে স্কুলের বাসে তুলে দিয়েছি। তুমি রেস্ট নিতে পারো আজ।”
হাসে দিয়া। ভালো লাগে মানবের এই মানবিকতা বোধটাকে। এই কারণেই হয়তো ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি দিয়া। মানব চলে যাওয়ার পর দরজা দিয়ে এসে আবার একই জায়গায় দাঁড়ায় সে। কালকেরটা এতটা ভুল হবে? নিছক ভ্রম? অস্থির মানসিকতা দায়ী এর জন্য? নিজের মনে প্রশ্নের ভিড় জমিয়েই বাথরুম ঢোকে দিয়া। দাঁত মাজে। মুখ ধোয়। বেরিয়ে এসে ডিমটোস্ট খায়। খেতে খেতে ঘরের চারদিকে চোখ বোলায়। পর্দা, টিভি, শোকেশ, সোফা— সব কী শৌখিন! কী ম্যাচিং করা সবকিছু। চাকরি পাওয়ার পর একটা ছেলে একা এতকিছু এত নিখুঁত ভাবে গুছিয়েছে যেন সংসারী! এগুলোই ধুয়ে মুছে সাফ করে চলেছে দিয়া। পালটাতে বলেনি কিছুই।
চোখ নামাতেই দেখে পাশের চেয়ারে মেয়েটা বসে আছে। আঁতকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় দিয়া। আবারও গলা খ্যাসখ্যাসে হয়ে আসে!
—কে তুমি? কী করছ এই ঘরে? কী চাইছ?
মেয়েটা কাঁদে। খুব কাঁদে। প্রচণ্ড আওয়াজ করে চিৎকার করে। কী বিশ্রী সে চিৎকার। কান চেপে ধরে দিয়া। ছুটে বেরিয়ে যেতে চায় ঘর ছেড়ে! কিন্তু দরজা কই? চারদিক তো দেয়াল… শুধুই দেয়াল ! মুখ গুঁজে বসে পড়ে দিয়া। চিৎকার ওর বেরোয় না। মেয়েটাও ওর সামনে বসে কাঁদে। এত বিশ্রী আওয়াজ কান্নার রোল যে কানে তালা ধরে যাওয়ার উপক্রম।
—দিদি? ও দিদি? কী হল গো? কথা বলো। মিনুর আওয়াজ পেয়ে স্বস্তি পায় দিয়া।
—মেয়েটা এই ঘরেই আছে রে মিনু। তোর দাদা বিশ্বাস করেনি। আমি মিথ্যে বলিনি। আমি ওকে দেখেছি। সত্যি রে মিনু।
—কোন মেয়ে দিদি? কেউ নেই দ্যাখো তুমি। এই নাও, জল খাও তো দেখি৷
(ক্রমশ…)