সপরিবারে আমরা তিনজন ২২ জুলাই, ২০২২ রাত ৯টা ৩৫ মিনিটের উড়ান ধরেছিলাম দিল্লি হয়ে লে-র উদ্দেশ্যে। মোবাইলের একটা করে সিমকার্ডকে পোস্টপেইড করানো ছিল যাত্রারম্ভের কিছুদিন আগে থাকতেই। আমাদের ‘ইনারলাইন পারমিট’ও ছিল, যা লে পৌঁছে হাতে পেয়ে গিয়েছিলাম। আর এই পারমিট-এর জন্য দিতে হয়েছিল (২০২২ সাল-এ) ১৬৮০ টাকা।

রাত পৌনে বারোটায় দিল্লি বিমানবন্দরের টার্মিনাল দুই থেকে লে-র উড়ান ধরতে যেতে হল ৮.৫ কিলোমিটার দূরে টার্মিনাল-এ এবং যেতে গিয়ে মালপত্রের জন্য দুশ্চিন্তাটা বেশ ভোগাচ্ছিল। সকাল ৬:৩০ নাগাদ লে বিমানবন্দরের পুঁচকি কনভেয়ার বেল্টে মাল উদ্ধার করে আর দুটি গাড়ি হাজির দেখে হাঁফ ছাড়লাম। কিন্তু অতখানি উচ্চতায় সকাল ৬:৩০ নাগাদ তেমন শীত নেই, গায়ে মামুলি গরম জামা-ই যথেষ্ট দেখে বিস্মিত হলেও ঠিক প্রসন্ন হতে পারিনি। চেনা ভূগোল-বিজ্ঞান না মেলার অস্বস্তি। যাইহোক, লে-তে আমরা গেস্টহাউসে ছিলাম।

সচরাচর সমতল থেকে একলাফে ১১,৪৮০ ফুট উচ্চতায় উঠে এলে সমতলবাসীর শরীর বিদ্রোহ করে। প্রায় সব ভ্রমণসূচি ও সরকারি নির্দেশিকাতেই অন্তত ২৪ ঘণ্টা বিশ্রামের পরামর্শ দেওয়া আছে। কিন্তু মাসখানেক ধরে বিস্তর গবেষণা করে ৮ দিনের মধ্যে নিজেদের শখ-সামর্থ্য-স্বাস্থ্যে কুলোনোর মতো যে-ভ্রমণসূচি বানিয়েছি, সেটা প্রথম দুই দিনে মানে ২৩ ও ২৪ জুলাই তারিখেই পরিবেশের সঙ্গে খাপ-খাওয়ানোর বিধি কিছুটা ভঙ্গ করেই লে শহরের বেশকিছু গন্তব্য ঘুরে নিয়েছি।

২৫ জুলাই ২০২২ আমাদের যাত্রা খারদুংলা পাস হয়ে নুব্রা উপত্যকার পথে। উচ্চতার কারণে ও অক্সিজেনের অভাবে শরীর কাহিল হলে আর রক্ষা থাকে না। তাই নুব্রার দিকে যাত্রা করার আগে পর্যটকদের অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখতে বলা হয়। চালকের নাম রিগজিন। তিব্বতী ভাষায় Rigzin শব্দের অর্থ জ্ঞানী। কিঞ্চিত দরাদরির পর ৪৫ হাজার টাকায় ২৫-৩০ জুলাই আমাদের গন্তব্যগুলো ঘুরিয়ে ৩১-এ লে ফিরিয়ে আনবে চুক্তি হয়েছে। ৬ জন বসার মাহিন্দ্রা বোলেরো গাড়িতে তিনজন যাচ্ছি। আরেকটি পরিবার সঙ্গে থাকলে টাকাটা ভাগাভাগি হয়ে যেত। খাতির যত্নেরও ভাগ পেত বলা বাহুল্য।

প্রথমে বাজারে গিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার ভাড়া নিলাম ২৫০০ টাকা দিয়ে। তারপর ‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’। সুনীল আকাশ ছাড়া চতুর্দিকে সব পাথুরে মেটেরঙা, বর্ণচ্ছটা নেই। কিন্তু সেই প্রাকৃতিক ভাস্কর্য ও কারুকার্য দেখেও মোহিত হতে হয়। পথে মাঝেমাঝেই বাইক বাহিনী চোখে পড়ে। অবশ্য যারা এমন উচ্চতায় টানা মোটরবাইক চালিয়ে যেতে পারে, তাদের রক্ত এমনিতেই অক্সিজেনের গোডাউন। অধিকাংশ বাইকে দুজন করে আরোহী; হয়তো পালা করে চালাবে। কিন্তু অনেকেই একা। কয়েকটি মেয়েও আছে।

খারদুংলা পাসে গাড়ি দাঁড়াল। ১৭,৫৮২ ফুটের মান রেখে খানিকটা ঠান্ডা ছিল। একটা টিলার মাথায়, সম্ভবত ‘খারদুংলা টপ’-এ চড়ে সবাই ছবি তুলছে দেখে আমরাও উঠেছিলাম। আমার মাথা টলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল, সঙ্গে হাঁফ। নতুন কিছু নয়। ভার্টিগো ও স্পন্ডেলিসিসের জন্য মাথা ঘোরা আমার সঙ্গী, আর সিঁড়ি চড়লে সমতলেও হাঁপাই। কিন্তু বিশ্বের দ্বিতীয় উচ্চতম মোটরযোগ্য সড়কপাসের উচ্চতাকে সম্মান জানিয়ে একটা টিলায় সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করে আমি বাস্তবিকই খানিকটা টলমলে আর খিটখিটে হয়ে গেলাম।

যতটা না কাবু হয়েছিলাম, তার চেয়ে বেশি অভিনয় করতে হল অক্সিজেন সিলিন্ডারের ভাড়া উসুল করার জন্য। নতুবা ড্রাইভারের অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পেরেছিল, বিশ্রাম ও খানিকটা নীচে অবতরণের পর নিজে থেকে ঠিক হয়ে যাবে আমার কষ্ট। সত্যিই মোমো ও কফি খাওয়ার পর খারদুংলাতেই চাঙ্গা হয়ে গেলাম। গাড়ি ছাড়ার আগে একটা ফলক থেকে টুকে নিলাম — খারদুংলা (টপ) ১৭,৭৬০ ফুট, খারদুংলা গ্রাম ১৪,৭৬৩ ফুট। এটাই বিশ্বাসযোগ্য লাগল। খারদুংলা টপের বিজ্ঞাপিত উচ্চতা ১৮,৩৮০ ফুট ও তার বিশ্বের উচ্চতম বা দ্বিতীয় উচ্চতম হওয়ার দাবিটি যথার্থ নয়। উচ্চতম সড়কপথগুলোর মধ্যে এর অবস্থান ১১তম।

ডিসকিট মঠ

খারদুংলার পর নামার পালা। মাঝে মাঝে সমতল রাস্তা। স্থানে স্থানে ছোটোবড়ো স্তূপ দেখতে এই দু’দিনে অভ্যস্থ হয়ে গেছি। দুপুরে নুব্রা উপত্যকার খালসারে একটা ছোটো রেস্তোরাঁয় খেলাম। জায়গাটা বেশ সুন্দর। রেস্তোরাঁর উলটোদিকে এক সারি সাদা ঝকঝকে অলংকৃত স্তূপ। আমাদের দিনশেষের গন্তব্য হুন্দর।

পথে চোখে পড়ল প্রকাণ্ড দুটি অট্টালিকা— একটি পাহাড়ের মাথায় আর অন্যটি তার পাদদেশে। দ্বিতীয়টিই বেশি সুন্দর লাগল। গাড়ি থামতে জনপ্রতি ৩০ টাকার টিকিট কেটে সেটাই ঘুরেফিরে দেখে নিলাম। প্রকাণ্ড বুদ্ধমূর্তির নীচে বসে, বৃত্তাকার দেওয়ালে “ওঁ মণিপদ্ম হুং’ লেখা চোঙাকৃতি অসংখ্য ঘণ্টার বেষ্টনীর বেশ কয়েকটা ঘুরিয়ে, লম্বা বারান্দা বেয়ে মন্দির প্রদক্ষিণ করে বেশ খানিকক্ষণ কাটালাম। এককথায় অপূর্ব নিসর্গ ।

গাড়িতে ফিরতে রিগজিন বলল, ‘ওয়াহা জানা হ্যায়?’

—ও কেয়া হ্যায়?

—ডিসকিট মনেস্ট্রি।

—তো ইয়ে কেয়া থা?

—ইয়ে ভি ডিসকিট মনেস্ট্রি। নয়া বনা।

আমরা নতুন অংশটি দেখেছি, পুরোনো মূল মনেস্ট্রি হল চূড়ায় অবস্থানকারী অট্টালিকাটি। ঘড়ি অনুযায়ী বিকেল গড়াতে চলেছে। হুন্দর পৌঁছানো নিয়ে চিন্তা নেই কিন্তু তক্ষুণি যাত্রারম্ভ না করলে বালিয়াড়িতে উটের সাফারি ওইদিন আর সম্ভব নয়। পরেরদিন তুরতুক থেকে ফিরে কি সাফারির সময় থাকবে? দোনোমনো করতে করতে গাড়ি কিছুটা গড়িয়ে গেছে। রিগজিন হঠাৎ গাড়ি ঘোরাল, ‘ক্যামেল সাফারি আজ নহী হো পায়েগা। আপ মনেস্ট্রি দেখ লো। সাফারি কল তুরতুক সে ওয়াপস আকে কর লেনা।’

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...