মোনা শোওয়ার ঘরে খাটের উপর পা ছড়িয়ে বসেছিল। কাপড় চোপড় ঈষৎ অবিন্যস্ত। শরীরে তার যৌবনের ঢেউ। তাকে দেখে সুখেনের শরীরে উত্তেজনা খেলা করে উঠল। কিন্তু তার দুঃখের পারদ সমস্ত সীমা ছাপিয়ে গেল, যখন ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই মোনা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে টাকলু কোথায় গেছিলি?’

মোনার কথায় সে কোনও উত্তর দিতে পারল না। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে এল ছাদে। সময়ে অসময়ে আর কেউ তার পাশে না থাকলেও এই ছাদ সবসময় তার পাশে থেকেছে। এই ছাদে দাঁড়িয়েই সে আকাশ চিনেছে। জীবনের প্রথম প্রেম ভেঙে যাওয়ার কষ্ট ভুলেছে। দেবিকা যেদিন তাকে ছেড়ে, সৌম্যকে বিয়ে করে মুম্বই নিবাসী হয়েছিল, সেদিনও সুখেন এই ছাদে এসে কেঁদেছিল। এই ছাদ তাকে সেদিনও ফেরায়নি। এর বুকে বসেই ধীরে ধীরে সুখেন জীবনের লড়াইয়ে ফিরেছে। সরকারি চাকরি জোগাড় করেছে। মোনাকে দেখে সে আবার ভালোবাসতে শুরু করেছে। কিন্তু তার ভালোবাসার পথে যে তার টাক আর নাম বাধা হয়ে দাঁড়াবে তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি।

সেদিন অনেক রাতে সুখেন ছাদ থেকে নামল এবং বাড়িতে জানিয়ে দিল এখন ক’টা দিন সে মোনার সঙ্গে এক ঘরে থাকবে না। পাশের ঘরে থাকবে। সুখেনের মা একটু আপত্তি করেছিলেন। তবে মোনার আচরণের কথা চিন্তা করে নিজেই চুপ করে গেলেন।

কয়েকদিনের মধ্যেই সুখেনের বাড়িশুদ্ধ সকলে মোনার পাগলামিতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ল। অষ্টমঙ্গলায় যাওয়া আর হল না। দিনকে দিন মোনালিসার দৌরাত্ম্য বেড়েই চলল। সে কখনও বাড়ির পেয়ারা গাছে উঠে বসে থাকে, কখনও রান্নাঘরে ঢুকে জিনিসপত্র বাসনকোসন ছুঁড়ে ফেলে, কখনও বা যাকে তাকে যা তা বলে। যুবতী মেয়ে, তার গায়ে হাত দিতে ছেলেরা ভয় পায়। আর বাড়ির মেয়েরা তার সঙ্গে গায়ের জোরে পারে না। থাকার মধ্যে সুখেন। কিন্তু সে বেচারা এমন ভালো মানুষ যে, সে বউকে কিছুই বলতে পারে না। ফলে মোনালিসাকে থামানো অসম্ভব হয়ে পড়ল।

শেষে একদিন বাড়িতে মোনালিসাকে দেখতে সাইকিয়াট্রিস্ট এলেন। মোনাকে অনেকক্ষণ পরীক্ষা করে খসখস করে গোটা তিনেক ওষুধ লিখে দিলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, “ও কিছু নয়। ক’দিন ওষুধ খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

বাপেরবাড়িতে মাধবী বলে একটি মেয়ে মোনার দেখাশোনা করত। তাকে ডেকে আনা হল। তার উপর ভার পড়ল মোনাকে ওষুধ খাওয়ানোর। এভাবে আরও কয়েকদিন কেটে গেল। কিন্তু মোনালিসার উপদ্রব কিছুমাত্র কমল না। তার শোওয়ার ঘরের পিছনের আগাছা ভরা মাঠ না-খাওয়া ওষুধের মোড়কে ভরে গেল। সমস্যা কমা দূরে থাক আরও বেড়ে চলল। কয়েকদিন পর সুখেনের মা তাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠাল। ‘বাবা আর তো পারি না। ওই মেয়ে কাল আমাকে এমন ধাক্কা দিয়েছে যে, আরেকটু হলেই আমি পড়ে যাচ্ছিলাম। এই বয়সে পড়ে গেলে কি আর আমার শরীর থাকবে? তুই বাবা এবার কিছু কর।’

অবশেষে একদিন মোনালিসা মাধবীকে নিয়ে বাপেরবাড়ি চলে গেল। বুকে পাথর রেখে, সুখেন বাধ্য হল তার পছন্দ করে বিয়ে করা সুন্দরী বউকে বাপেরবাড়ি রেখে আসতে।

প্রথম প্রেমের পর তার দ্বিতীয় প্রেমও আকাশের গায়ে বিলীয়মান হতে চলল। সুখেনের ভালোবাসা মোনালিসার পাগলামির নীচে চাপা পড়ল।

মোনা যেদিন বাপেরবাড়ি ফিরে এল তার বাবা সেদিন মুখে ভাত তুললেন না। বউদি দেখে ঠোঁট বেঁকাল। মা দু-একবার ফুঁপিয়ে চুপ করে গেলেন। কিন্তু মোনালিসা যেন এই সবকিছুর থেকে বহুদূরে। কোনওদিকেই তার ভ্রূক্ষেপ নেই। সে জানলা দিয়ে গাছের পাতার নাচ দেখে। পাখির ডাক শোনে। পূর্ণিমার রাতে আকাশের গোল থালার মতো চাঁদ দেখে ফিকফিক করে হাসে। কেউ তাকে কিছু বলতে গেলে তেড়ে মারতে যায়। ননদের রকমসকম দ্যাখে তার বউদি। তারপর রাতে বর বাড়ি এলে বরের কাছে ফিসফিস করে অনুযোগ করে।

—তোমার বোন তো পুরো পাগল হয়ে গেছে গো। এই পাগলামি তোমাদের বংশগত নয় তো? তুমি আবার কোনওদিন এমন হয়ে যাবে না তো? ও মাগো! তখন আমি কোথায় যাব?

তার কথায় তার স্বামী চিন্তিত হয়। তবে মুখে হো হো করে হেসে উঠে, বউকে জোর করে কাছে টেনে নেয়। দিন গড়িয়ে চলে।

ওদিকে হীরক এতদিন সবকিছু থেকে মুখ লুকিয়ে ছিল। তার শুধু ভয় এই বুঝি সুখেন এসে ঘটকালির টাকা ফেরত চায়। কয়েকদিন বাদে তার কানে দুটো খবর এল। এক, মোনালিসা বাপের বাড়ি ফিরে এসেছে। দুই, সুখেন ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়েছে। খবরটা তাকে দিল তার এক বন্ধু তোতন। তোতন হীরকের বহুদিনের সাথী। সে হীরককে আশ্বস্ত করল, সুখেনকে সে যেটুকু চিনেছে তাতে তার মনে হয়েছে যে, সুখেন ঘটকালির টাকা আর ফেরত চাইবে না।

এর কয়েকদিন পর হীরক মনে একটু সাহস সঞ্চয় করল। মোনাকে একটু দেখে আসা দরকার। সে পায়ে পায়ে মোনালিসার বাড়িতে হাজির হল। গোটা বাড়ি থমথম করছে। হীরককে দেখে কেউ কথা বলল না। তাদের ভাব এমন যে, মোনার পাগলামির জন্য যেন হীরক দায়ী। বেগতিক বুঝে হীরক চলে আসছিল। ঠিক তখনই মোনালিসার মুখোমুখি। মোনালিসা যেন সেই একই আছে। হীরককে দেখেই সে একটা চ্যালাকাঠ হাতে তাড়া করে এল।

—এই শয়তানটাই আমাকে ওই টাকলু সুখেনের সঙ্গে ভিড়িয়েছিল।

তাকে আটকায় কার সাধ্যি।

তার তাড়া খেয়ে হীরক আর দাঁড়াল না। সোজা পিছন ঘুরে দৌড়ল। দৌড়তে দৌড়তে দু’বার আছাড় খেল। উঠল আবার দৌড়ল৷ মোনালিসা তখন সমানে পিছনে তাড়া করে আসছে।

দৌড়তে দৌড়তে হীরক একটা মজে যাওয়া পুকুরের সামনে এসে পড়ল। এরপর যাওয়ার রাস্তা নেই। যেতে গেলে পুকুর পার হতে হবে। হীরক সাঁতার জানে না। অতএব তার সে ক্ষমতা নেই। সে পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল। মোনালিসা ততক্ষণে কাছে এসে পড়েছে। এই পুকুরের পাড়ে তাদের অনেক স্মৃতি। সে হীরকের কলার চেপে ধরল।

—তোমার জন্য পাগল সেজে বিয়ে ভাঙতে গিয়ে কী কাণ্ডটা করতে হল। এবার কবে বিয়ে করবে বলো?

—পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হোক তারপর।

হীরক আলতো করে ছোটোবেলার প্রেমিকার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।

(সমাপ্ত)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...