গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহের পর বর্ষা এলে সমগ্র প্রাণীজগত যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বর্ষাকাল খুবই মনোরম। তবে এই ঋতুতে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেরই স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। আসলে বৃষ্টিতে মশার উপদ্রব যেমন বাড়ে, তেমনই নোংরা বা জমা জলের কারণে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এমনিতে শিশুরা বর্ষাকাল খুব ভালো ভাবে উপভোগ করে। কিন্তু বর্ষাকালে ওদের ত্বকের বিশেষ যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন। কারণ ওদের ত্বক খুবই কোমল ও নরম প্রকৃতির।

সামান্য অসাবধানতায় অনেক সমস্যা হতে পারে। বর্ষা ঋতুতে অনেক সময় শিশুরা বৃষ্টিতে ভিজে যায়। যার ফলে ত্বকে চুলকানি, ফুসকুড়ির মতো সমস্যা হতে পারে। সেজন্য শিশুর ত্বকের বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।

ময়েশ্চারাইজিং লোশন ব্যবহার করুন

শিশুদের ত্বক খুব নরম এবং সংবেদনশীল। বর্ষা ঋতুতে আর্দ্রতা বাড়লে শিশুর চুলকানি ও ফুসকুড়ির সমস্যা দেখা দিতে পারে। এজন্য ভালো মানের ময়েশ্চারাইজিং লোশন ব্যবহার করতে পারেন, যা আপনার শিশুর ত্বককে ফুসকুড়ি এবং শুষ্কতা থেকে রক্ষা করতে পারে।

ডায়াপার ভেজা রাখবেন না

আপনার শিশুকে ডায়াপার পরাতে পারেন। তবে মাঝে মাঝে পরীক্ষা করে দেখবেন যে, সেটি অতিরিক্ত মাত্রায় ভিজে গেছে কিনা। ওরা যদি দীর্ঘসময় ভিজে ডায়াপারে শুয়ে থাকে, তাহলে ওদের ত্বকে র‍্যাশ বেরোনোর ঝুঁকি থাকে। তাই নিয়মিত ব্যবধানে শিশুর ডায়াপার পরিবর্তন করুন। এছাড়া কিছু সময়ের জন্য তাকে ডায়াপার-মুক্ত রাখুন এবং সুতির ডায়াপার ব্যবহার করুন। এতে বায়ু সঞ্চালন ভালো মাত্রায় হয়।

ব্যবহার্য পণ্যগুলি পরীক্ষা করুন

বাচ্চাদের জন্য বাজার থেকে কোনও পণ্য সাবধানে কিনুন। পণ্য কেনার আগে সেগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখে নিন। সাধারণত শিশুর প্রসাধনীজাতীয় পণ্যগুলিতে ফেনোক্সিথেনল থাকে, যা শিশুর ত্বকে অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। সেজন্য কোনও পণ্য কেনার আগে প্যাকেটের গায়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যটির উপাদানগুলি পড়ুন এবং শুধুমাত্র নিরাপদ পণ্যই কিনুন। প্যারাবেন, অ্যালকোহল, কৃত্রিম রং, সুগন্ধি এবং রঞ্জকযুক্ত পণ্যগুলি এড়িয়ে চলুন।

মশার কামড় থেকে রক্ষা করুন

সাধারণত বর্ষাকালে মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। তাই বর্ষাকালে মশার কামড় থেকে শিশুদের রক্ষা করুন। নরম ত্বকে মশা কামড়ালে ওরা প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করে। ত্বকে লাল দাগ হতে পারে বা ফুলেও যেতে পারে।

এই সময়ে ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ ছড়ায়। এগুলো থেকে রক্ষা পেতে হলে আপনার বাচ্চাকে মশা থেকে দূরে রাখতে হবে। যখনই শিশুকে ঘুম পাড়াবেন মশারি টাঙাতে ভুলবেন না।

বর্তমানে বাজারে শিশুদের ত্বকে লাগানোর উপযোগী কিছু সূক্ষ্ম বিষমুক্ত এবং ডিইইটি-মুক্ত মশা প্রতিরোধী ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে আপনার শিশুর ত্বকে তা লাগাতে পারেন। এছাড়া ঘরদোর সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবেন, যাতে মশারা বংশবৃদ্ধি না করতে পারে। সন্ধের পরে বাচ্চাকে বাড়ির বাইরে বের না করাই ভালো। আর যদি বাইরে বের করতেই হয়, তাহলে আপাদমস্তক পোশাক পরিয়ে নিয়ে যাবেন, যাতে ওরা মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে পারে।

শরীরে মালিশ-এর প্রয়োজন

বর্ষাকালে শিশুকে স্নানের আগে ভালো ভাবে মালিশ করুন। অলিভ অয়েল বা বাদাম তেল দিয়ে মালিশ ত্বকের জন্য খুবই উপকারী। বিশেষকরে অলিভ অয়েল একটি ভালো ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে।

এছাড়াও ভার্জিন নারকেল তেলের মতো ভালো মানের প্রাকৃতিক তেল দিয়ে শিশুর ত্বক মালিশ করতে পারেন। এতে অনেক উপাদান আছে, যা আপনার শিশুর ত্বকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি প্রদান করে।

হাত পরিষ্কার রাখাও গুরুত্বপূর্ণ

আপনার শিশুর নখ সবসময় ছোটো রাখুন। হাতের ময়লা শিশুদের স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলতে পারে। অভিভাবকদেরও উচিত ভালো হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে নিজেদের হাত ধোয়া। সন্তানদেরও একই শিক্ষা দিন। বিশেষ করে খাওয়ার আগে তাদের হাত অবশ্যই ধুতে বলুন।

ত্বক শুষ্ক রাখুন

বর্ষাকালে আবহাওয়ায় বেশি আর্দ্রতা থাকে। যার ফলে প্রচণ্ড ঘাম হয়। কখনও কখনও বৃষ্টিতে ত্বকও ভিজে যায়। এমন পরিস্থিতিতে প্রথমে পরিষ্কার জল দিয়ে শিশুর ত্বক ধুয়ে নিন। তারপর শুকনো তোয়ালে দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করুন। সবসময় চেষ্টা করবেন ওদের ত্বক শুষ্ক রাখার।

শিশুকে সুতির পোশাক পরান

বর্ষাকালে শিশুকে শুধুমাত্র সুতির কাপড় পরানো উচিত। কারণ এই ধরনের কাপড় সহজেই ঘাম শুষে নেয় এবং ত্বকও শ্বাস নিতে সক্ষম হয়। এই সময়ে শিশুদের আঁটোসাঁটো পোশাক পরানো থেকে বিরত থাকুন। কারণ আঁটোসাঁটো পোশাক পরলে ত্বকে ফুসকুড়ি হতে পারে।

শিশুর জিনিসপত্র শেয়ার করবেন না

এই আবহাওয়ায় একটু অসাবধানতার কারণে শিশুর ত্বকে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুকে পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও নিয়মিত পরিষ্কার করুন। শিশুর তোয়ালে, জামাকাপড় এবং চিরুনি কাউকে দেবেন না ।

অ্যান্টি-ফাংগাল পাউডার ব্যবহার করুন

শিশুদের ত্বকের যত্ন নিতে অ্যান্টি-ফাংগাল পাউডার ব্যবহার করা যেতে পারে। এই পাউডার লাগালে ত্বকে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি রোধ হবে। এছাড়া স্নানের সময় জলে অ্যান্টিসেপটিক লিকুইড ব্যবহার করতে পারেন। এতে শিশুর ত্বক ব্যাকটেরিয়া-মুক্ত থাকবে।

ক্লিনজার ব্যবহার করুন

আর্দ্রতার কারণে শিশুদের ত্বক শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। এমন অবস্থায় ত্বকে সাবান ব্যবহার করবেন না। কারণ এতে ত্বক আরও শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। শিশুদের ত্বকের পিএইচ ব্যালান্স বজায় রাখতে তেল-মুক্ত ক্লিনজার ব্যবহার করুন।

কাপড় শুকনো রাখুন

বর্ষাকালে যদি বাচ্চার জামাকাপড় ভিজে যায় বা ধোয়ার পরও তা ঠিকমতো না শুকোয়, তাহলে ওই অবস্থায় আলমারিতে রাখবেন না। বাচ্চাদের জামাকাপড় ভালো করে শুকিয়ে নিন। যদি সূর্যের আলোয় না শুকোয় তাহলে ইস্ত্রি করে তা শুকোতে হবে। কিন্তু কোনওভাবেই বাচ্চাকে সামান্যতম ভিজে জামাকাপড়ও পরানো চলবে না। কারণ ভেজা পোশাক পরলে ওদের শরীরে চুলকানি, ফুসকুড়ি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।

স্বাস্থ্যকর খাবার

বর্ষাকালে শিশুদের স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাবার দেওয়া খুবই জরুরি। এই ঋতুতে সর্দি-কাশি ও জ্বর হতে পারে। তাই এই সময় শিশুদের ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার ও ব্যাকটেরিয়ারোধক খাবার যেমন— পেয়ারা, আমলা, কমলালেবু, পেঁপে প্রভৃতি খাওয়ানো উচিত। এছাড়া গরম স্যুপ-ও দিতে পারেন। এই সময় জল ফুটিয়ে বাচ্চাকে খাওয়াবেন। জল ফোটালে জলের মধ্যে থাকা জীবাণুগুলো মরে যায়।

বিশেষজ্ঞের পরামর্শ

বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মনজিন্দর সিং রান্ধাওয়া জানিয়েছেন, বর্ষাকালে শিশুদের ত্বকের যত্ন নিতে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। কারণ পরিবেশে আর্দ্রতা বৃদ্ধির কারণে ওদের ত্বককে নানাবিধ সমস্যার সঙ্গে লড়াই করতে হয়। বর্ষাকালে সাধারণত ছত্রাকের সংক্রমণ দেখা যায়। তা থেকে রক্ষা পেতে শিশুর ত্বক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি, শুকনো রাখারও প্রয়োজন। পিএইচ-যুক্ত সাবান দিয়ে নিয়মিত স্নান করাবেন। এরফলে শিশু ঘাম ও ঘামের দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে পারে।

এই সময় অতিরিক্ত স্নান না করানোই উচিত। এরফলে ত্বকের প্রাকৃতিক তেল দূর হবে না। ত্বকও রুক্ষ হয়ে উঠবে না। শিশুদের ত্বক প্রচণ্ড সংবেদনশীল। স্নানের পর হালকা ময়েশ্চারাইজার লাগালে ত্বকের কোমলতা বজায় থাকে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...