জানলার কার্নিশে চুপটি করে বসে আছে দিতি। ও বাড়ির ছাদে মিনু বউদির চার বছরের ছেলেটি খেলছে। অন্যদিন দিতি ডেকে ডেকে ওর সাথে কথা বলে। কিরে শুটকি কী করিস, কী খেলিস? ভারি মিষ্টি লাগে শুনতে আধো আধো কথা। আজ দিতি চুপ করেই রইল। ওর মনে আজ অন্য সুর।

কত কী ভেবেছিল! আজকের দিনটি স্পেশাল হবে সবার জন্য! বিশেষ করে কাকাই-এর জন্য একটা সারপ্রাইজ থাকবে, সারপ্রাইজটা পেয়ে কাকাই ওকে জিজ্ঞেস করবে, ‘কী খাবি বল তো দিতি মা!’ দিতি ফস করে বলবে, “আম সন্দেশ, নলেন গুড়ের রসগোল্লা, ফুচকা, আইসক্রিম।’ খুব মজা হবে হই-হুল্লোড় হবে। কিন্তু হিসেব গরমিল হয়ে গেল। কাকাই যে ওর উৎসাহে এমন ভাবে… কাকাই ওর রোল মডেল, অথচ…!

বাবা, মা বাড়িতে কেউ নেই, থাকলেই বা কী হতো! আকাশ পাতাল কত কী ভাবছে দিতি। হঠাৎ হাওয়ায় সরসর করে টেবিলের উপর থেকে পেনটা ঠকাস করে মেঝেতে পড়ল। বড্ড বিরক্ত দিতি। এক লাফে মেঝেতে নেমে কলমটা তুলে প্রায় ছুঁড়ে ড্রয়ারে রেখে দিল। খাতাটাও ড্রয়ারে রেখে দিল। যাহ! সব বাদ, সব বন্ধ! এখন ওর একটাই চিন্তা হবে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কোনওরকমে ঢুকে, ডিগ্রি নিয়ে চাকরি জোগাড় করা। দেয়ালে ওর হাতে আঁকা রোনাল্ডিনহোর মুখ। পেনসিল স্কেচ আঁকা রোনাল্ডিনহোর মুখে মিষ্টি একটা হাসি, একেবারে যেন জীবন্ত। ও এঁকেছিল। কাকাই দেখে অবাক, খুব খুশি হয়ে কাকাই ছবিটাকে বাঁধিয়ে রেখেছে। আরিব্বাস এ মেয়ে তো ভার্সেটাইল জিনিয়াস।

মাকে বলেছিল, ‘বউদি, আমি ওকে গড়েপিটে তুলব। দেখবে দারুণ হবে তোমার মেয়ে, দশের মধ্যে এক।”

অথচ সেই কাকাই! মানুষের কত রূপ, কত পরিবর্তন। মানুষও যেন ক্যামিলিয়ানের মতো রং বদলায়।

ক’দিন ধরেই দিতির মনে খুশির হিল্লোল ছিল তবে কাউকে বুঝতে দেয়নি, জানতে দেয়নি। সারপ্রাইজটা সেইদিনই দেবে ঠিক করে রেখেছিল। ওর লেখা একটি গল্প এক জনপ্রিয় পত্রিকায় ছাপা হবে। সম্পাদকমশাই নিজে ফোন করে জানিয়েছেন, শুনেই খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠেছে দিতি।

ওহ, এত আনন্দ! এত আনন্দ! এমন একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত পত্রিকা! কাকাইও লিখত। খুব শখ ছিল ওই পত্রিকা কাকা-র লেখা নেবে, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। দিতির এই গল্পটা কাকাই এডিট করেছিল। পড়ে বলেছিল ভারি মিষ্টি গল্পটি। দিতি গল্পটির নাম দে, ‘মিষ্টি গল্প’। সেই মিষ্টি গল্পটিই ছেপে বেরোচ্ছে। কাকাই খুব খুব খুশি হবে।

গতরাতে তো ঘুমই হয়নি দিতির। কখন যে সকাল হবে! একটু চোখ লাগতে না লাগতেই ঘুম ভেঙে যায়। বারান্দায় যাচ্ছে আর আসছে। ঘর বার করছে, কখন পেপার দাদু আসবে! সাত সকালে টিং টিং বেল বাজতেই ছুটে এসেছে,

—বইটা এনেছ পেপার দাদু?

—হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার জিনিস ভুলি কী করে দিদি? সেই হিম্মত কি আমার আছে!

পেপারের সাথে পত্রিকাটি হাতে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে ময়ূরের মতো কিছুক্ষণ নেচে নিল। খুলে নিজের লেখাটির উপর হাত বোলাল। দুই পাতার ‘মিষ্টি গল্প’। বাহ, কেমন সুন্দর ছবি দিয়েছে। মন ভরে গেল। আনন্দে উত্তেজনায় বুকের ভিতর ধুকপুকুনিটা বেড়েই চলছে। বই বুকে জড়িয়ে দে ছুট দোতলায় কাকাইয়ের ঘরে। ঘরের সামনে এসে থমকে গেল, দরজা বন্ধ। ঘুমোচ্ছে? ডেকে তোলা ঠিক হবে না। কাল অনেক রাত পর্যন্ত এই ঘরে লাইট জ্বালানো ছিল। কাকাই অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে, কাম্মা অবশ্য ঘুমিয়ে পড়ে। থাকুক ডেকে কাজ নেই, বরং ঘরে গিয়ে অন্য লেখাগুলো দেখা যাক৷ ভালো করে পড়া যাক।

ঘরে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে বইয়ের মধ্যে ডুবে গেল দিতি। অনেকগুলো গল্প প্রবন্ধ কবিতা! হঠাৎ কান্নার ডাকে হুশ ফিরল,

—কিরে ন’টা যে বেজে গেল কখন উঠবি? আজ এত দেরি কেন রে? কলেজ ছুটি তাই?

হুড়মুড় করে উঠে বসল দিতি। সত্যি অনেক বেলা হয়ে গেল। বইটা দেখতে দেখতে ঘুমিয়েই পড়েছিল।

–কাম্মা, কাকাই উঠেছে?

—উঠেছে মানে! বাজার করে পর্যন্ত ফিরে এসেছে। একটু আগে তোর মায়ের ফোন এসেছিল, ওরা খুব ভালো আছে আর খুব ঘুরছে।

বইটা বুকে চেপে ছুট লাগাল। কাম্মা চিৎকার করে উঠল, “ওরে পাগলি ধীরে ধীরে, পড়বি তো! দেখিস যেন হাত পা না ভাঙে।’ একদমে ছুটে এসে কাকাই-এর সামনে দাঁড়াল। দুই হাতে বুকের উপর বইটা পরম সোহাগে জড়ানো। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ কাকাইয়ের দিকে। চোখে পলক পড়ে না। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে। কাকাই কী বলবে এবার! দারুণ সারপ্রাইজ! ফিস ফিস করে বলল, “কাকাই সেই, মিষ্টি গল্প দেখো পত্রিকায়…।’ কাকাই কেমন যেন ভাবলেশহীন।

—কিছু বলবি? কী হয়েছে?

—সেই মিষ্টি গল্প। তুমি এডিট করেছিলে। দেখো ছবিটাও কেমন মিষ্টি। তোমার প্রিয় পত্রিকায় আজ বেরিয়েছে।

—তাই নাকি। আচ্ছা। বেশ।

—কখন পড়বে কাকাই?

—আজ খুব ব্যস্ত আছি রে মা। রেখে দে টেবিলে, পরে দেখব।

—তোমার সবচাইতে প্রিয় পত্রিকা কাকাই।

—হ্যাঁ আগে খুব পড়তাম, এখন আর সে মান নেই। এখন লেখাগুলো আগের মতো ধারালো নয়, শাঁসালো নয়। যা পায় তাই ছাপে। রেখে দে, রেখে দে, পরে দেখব।

দিতির দুই চোখের উজ্জ্বল দ্যুতি হঠাৎ নিভে গেল। একেবারে কেমন পালটি খেল কাকাই! ওর উৎসাহে এমন ভাবে জল ঢেলে দিল! ওর লেখার মান নেই! যেই না ওর লেখা বেরোল সেই সঙ্গে পত্রিকার মান নেমে গেল! ধোপা যেমন পাথরে কাপড় বাড়ি মারে ঠিক তেমনই ওর বুকে কেউ যেন ঠাস ঠাস করে মারল। এত কান্না পাচ্ছে, পা আর সরছে না।

নিজের ঘরে এসে বসল, খুব কান্না পাচ্ছে। দু’ফোঁটা জল গড়িয়েই পড়ল, আটকাতে পারল না দিতি। এত আনন্দ, উত্তেজনা, এক ফুৎকারে একেবারে নিভে গেল। অথচ কাকাই …! বাবা-মাকে জানায়নি এখনও দিতি। আর জানাবেও না। কী হবে! মা তো বলেই বসবে, “লিখে কি আর তোমার পেট ভরবে? মন দিয়ে পড়াশোনা করো। ভালো নম্বরে ভালো চাকরি। এখন এসব শখ ছাড়ো। লিখে পেট ভরবে না।’

মা একেবারে মিছে অবশ্য বলে না। ঠিকই, রোজগার তো করতেই হবে নইলে উদরপূর্তি হবে কী করে? সবাই কেবল উদরপূর্তির কথাই ভাবে। মনের ফুর্তির কথা কেউ ভাবে না। একজন লেখকই জানে লিখে তার কতটা মনের ফুর্তি হয়। সেটির কি কোনও দাম নেই! ঠিকই, লেখক-এর যেন কোনও পাত্তাই নেই! এক একটি লেখার পিছনে এত এত পরিশ্রম থাকে অথচ কারও হুঁশ নেই, সবার-ই টাকার চিন্তা। কত পেলে? যখন শোনে খুবই সামান্য কিংবা কিছুই হয়তো পায় না, তখন বলতে তাদের মুখে এতটুকু বাধে না— তবে তো এ সবই ভুতের বেগার খাটা, নাই কাজ তো খই ভাজ। লেখা যেন সহজলভ্য জল-ভাতের মতো হয়ে দাঁড়ায়।

আজ মনে অনেক উথাল-পাথাল হচ্ছে। ভাবছে লেখাটা ছেড়েই দেবে। কিন্তু ছেড়ে দিতে চাইলেই কি আর ছেড়ে দেওয়া যায়? এ তো দমকা হওয়ার মতো মনের ভিতর থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ছুটে আসে। কেউ কি আটকাতে পারে নাকি আটকানো যায়? না আটকানো উচিত? জোর করে বন্ধ করা মানে, লেখক সত্তাকে গলা টিপে হত্যা করা। একটি সুস্থ মানুষের সুচিন্তিত সুস্থ ভাবুক মন পঙ্গু করে দেওয়া।

সারাটা দিন বড়ো ম্যাড়মেড়ে কাটল। সন্ধের আগে একটু বেরোল দিতি। একাই চক্কর কেটে এল খানিকক্ষণ। বাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসছে। মণিদা আর লিনি পিসির সাথে দেখা হল। কাউকেই ওর লেখার কথা কিছু বলল না। কাকাই-এর কাছ থেকে এত বড়ো আঘাত পাওয়ার পর আর ওর মুখে রা-টি নেই। মন ভেঙে গেছে, বড়ো হতাশ লাগছে। সন্ধের পর ছাদে মাধবীলতার পাশটিতে গিয়ে দাঁড়াল। চারিদিকে গভীর অন্ধকার। মাধবীলতার দিকে খানিক তাকিয়ে রইল, একটু হাত বুলিয়ে দিল সোহাগে। আহারে এই মাধবীলতা ওর গল্পে বেশ কয়েকবার উঠে এসেছে, কত ভাবে বর্ণনা করেছে। ওরও কপাল মন্দ। ভেবেছিল মাধবীলতাকে গল্পে বাঁচিয়ে রাখবে, ওর প্রিয় গাছ।

দুই চোখে জল টলটল করছে এমন সময় কান্নার কথা কানে এল। পাশেই কাকাই-এর ঘর। দিতি মোটেই আড়ি পাতেনি, আড়ি পাতা ওর স্বভাব নয়। তবে কথাগুলো স্পষ্ট ওর কানে বাতাসের সাথে ভেসে এল।

কাম্মা বলছে, “কী গো তুমি মেয়েটাকে অমন আঘাত দিলে কেন? সারাদিন মনমরা হয়েছিল? ঠিক যেন চাবুকের বাড়ি মেরেছ। এত আনন্দ নিয়ে এসেছিল! মনটাই খারাপ করিয়ে দিলে।’

—গিন্নি, জানো তো ঘোড়াকে চাবুক মারতে হয়। শুধু চাবুক নয়, যোদ্ধাদের পায়ের জুতোর সামনে লোহার একটা ভোঁতা পেরেক থাকে। দরকারে ওটা দিয়ে মারে।

—সেই তো! কেন যে এত নিষ্ঠুরতা!

—গিন্নি, ঘোড়াকে যত চাবুক মারবে, যত আঘাত করবে, তত ছুটবে। তত সে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছোবে এবং পৌঁছোতে পারে। নইলে ঘোড়া বিন্দাস হাওয়া খেতে খেতে এলোমেলো ঘুরতে থাকে।

—তার সাথে এর কী সম্পর্ক?

—আরে বাবা তুমি উকিলের বউ হয়েও কিছুই বুঝলে না। এখনই যদি দিতি-কে অনেক বাহবা দিই, “দারুণ’, ‘দারুণ’ বলি, ওর লেখার মান একই জায়গায় থেমে থাকবে। ও বেশি দূর এগোতে পারবে না। ও অতটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকবে।

—তাই বলে…!

—হ্যাঁ, তাই এমন আঘাত দিলাম। দেখবে ওর জেদ আরও বাড়বে, এই আঘাতই ওকে তাড়িয়ে নিয়ে যাবে। তুমি কী ভেবেছ? গতকাল রাতেই আমি পত্রিকাটি কিনে এনে বারে বারে পড়েছি। চমৎকার লিখেছে আমার দিতি। যেমন শব্দ চয়ন, তেমনই সহজ সরল, তেমনই আবেগ। দারুণ দারুণ দারুণ, অফিসে সবাইকে দেখালাম। গর্বে আমার বুক ভরে উঠেছে। ওর গল্পগুলো যেন নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, সহজ সরল মিষ্টি গল্প।

—কিন্তু ও কি বুঝবে! দিতি কিন্তু ভারী অভিমানী। পরে যদি সেই অভিমানটাই মনে ধরে বসে থাকে!

—আরে দাঁড়াও না, দু’দিন দেখি। পরে ঠিক আমি ওকে বুঝিয়ে বলব। তুমি চিন্তা কোরো না। দিতি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে।

মাধবীলতার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিতির হঠাৎ আকাশ সমান আনন্দ হল। মনটা ভালো হয়ে গেল। উফ দারুণ খুশি। মাধবীলতাকে আরেকবার ছুঁয়ে নিল। ছুটে নিজের ঘরে পা বাড়াতেই, উহ মাগো। ওর লম্বা একগুচ্ছ কালো চুল মাধবীলতায় পেঁচিয়ে গেছে। দিতির লেখক মন বুঝে নিল মাধবীলতাও মনের আনন্দে ওকে পেঁচিয়ে ধরেছে। কোনওরকমে চুল ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের ঘরে এল। উত্তেজনায় থরথর! কী করবে! কাকাই-কে আজ আরেকবার নতুন করে জানল, নতুন করে চিনল, আরও যেন শ্রদ্ধা বেড়ে গেল।

টেবিলের ড্রয়ারের ফাঁক দিয়ে কলমটা উঁকি দিচ্ছে, ওর প্রিয় অস্ত্র। হাতে চেপে ধরল, কলমটায় চুমু খেল। লিখবে ও আবার লিখবে, অনেক অনেক লিখবে। নিজের মনকে উজাড় করে দেবে। ভরে উঠবে সাদা কাগজ একের পর এক। কিন্তু কী লিখবে! আচ্ছা আজকের এই হাসি-কান্না ভরা খুশির দিনটাই না হয় লেখা যাক, মিষ্টি একটা গল্প হবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...