সন্তানকে সুশিক্ষিত এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, তাকে যেমন স্বাধীনতা দিতে হবে, ঠিক তেমনই গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে মা-বাবা দু’জনকেই। মনে রাখবেন, সন্তান যেন তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করতে ভুল না করে। কারণ, ওরাই সমাজ, দেশ তথা বিশ্বের ভালোমন্দের ভবিষ্যৎ। আবার প্রতিটি সন্তান মা-বাবার আশা-আকাঙ্ক্ষারও প্রতিফলন। তাই, সন্তানের ভবিষ্যৎ সুন্দর এবং সফল করে তুলতে মা-বাবাকে সবরকম প্রচেষ্টা করতেই হবে।

মা-বাবা সন্তানের প্রথম শিক্ষক এবং আদর্শ পথ-প্রদর্শক। মানুষের জীবনে পড়াশোনার গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। বাড়ির শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানের পুঁথিনির্ভর শিক্ষাদীক্ষা তথা গুড স্কুলিং এবং সম্পূর্ণ ভাবে সন্তানের প্রতি যত্ন নিতে হবে অভিভাবকদের। তবে মেধার নিরিখে সব শিশু সমান হয় না। অনেক শিশুই পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পারে না, কেউ কেউ আবার পরিশ্রম করেও কাঙ্ক্ষিত ফললাভ করতে পারে না। এর ফলে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকদের চিন্তা হয় অনেকসময়।

আজকাল প্রযুক্তির যুগে বাচ্চারা মোবাইল, ল্যাপটপ গেমস ইত্যাদি নিয়েই ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসে। সেই তুলনায় লেখাপড়ায় মনোযোগ দেওয়া, কিছু মুখস্থ করা ইত্যাদির ক্ষেত্রে অমনোযোগী হতে দেখা যায়। অনেক বাচ্চা একটানা বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ায় মনোযোগ রাখাটায় একঘেয়েমি অনুভব করে। তাই, বাচ্চাদের মনোযোগ বাড়াতে মা-বাবাকে সাহায্য করতে হবে। কীভাবে সহজ উপায়ে বাচ্চার মনোযোগ বাড়ানো যেতে পারে, তা জানা জরুরি।

লক্ষ্য ঠিক করুন

লক্ষ্য স্থির করে চললে সঠিক পথে চলতে সুবিধা হবে। পড়াশোনার জন্য সময় বরাদ্দ করুন, এতে বাচ্চা পড়ার সময় নিয়ে নিশ্চিত হতে পারবে। ‘পড়াশোনা শেষ করে কখন উঠতে পারব’ —এই দুশ্চিন্তা হবে না আপনার সন্তানের। পড়ার মাঝে ৪৫ মিনিট বা ১ ঘণ্টা পরপর একটা ব্রেক-এর ব্যবস্থা থাকলে পড়ায় একঘেয়েমি আসবে না।

পড়ার জায়গা নির্দিষ্ট করুন

খুব বেশি কোলাহলের মধ্যে বাচ্চার পড়ার জায়গা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কোলাহলমুক্ত, শান্ত, আরামদায়ক হওয়া উচিত বাচ্চার পড়ার জায়গাটি। সকলের যাতায়াতের পথে যেন পড়ার জায়গা না হয়। বাচ্চার পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু যাতে একজায়গায় রাখা যেতে পারে, তারজন্য পড়ার টেবিল একটু বড়ো রাখুন। বসার চেয়ারটিও আরামদায়ক হওয়াটা একান্তই জরুরি। পড়াশোনার সময় বাচ্চার যাতে খিদে না পায়, তাই হালকা কিছু জলখাবার খাইয়ে বাচ্চাকে পড়াতে বসান।

মনোযোগ আকর্ষণের বিষয়ে গুরুত্ব

গল্পের মাধ্যমে বা ছবি এঁকে পড়া বোঝাতে পারেন, বিশেষকরে ছোটো বাচ্চাদের ক্ষেত্রে। এর ফলে লেখাপড়ায় তাদের আগ্রহ বাড়বে। বাচ্চাকে লেখার অভ্যাস করান। কী পড়ছে তার একটা নোট ডায়ারিতে রাখতে বলুন। বিভিন্ন রঙের পেনসিল ব্যবহার করে লিখলে দেখতেও আকর্ষণীয় হবে, চোখেও চট করে পড়বে। যা পড়ছে সেটা সঙ্গে সঙ্গে খাতায় লিখে ফেলতেও অভ্যাস করান বাচ্চাকে। যা লিখছে বাচ্চা, যেন মুখে সেটা জোরে জোরে বলারও অভ্যাস করে।

বাচ্চার পড়াশোনার সময় হাতের কাছে মোবাইল, ভিডিও গেমস কিছুই রাখবেন না যেগুলো তার মনোযোগ নষ্ট করতে পারে। ঘরে টিভি বন্ধ রেখে বাচ্চাকে পড়াতে বসান কিংবা দরজা বন্ধ রাখুন, যাতে অন্য ঘরে আওয়াজ হলেও তার শব্দ বাচ্চার কানে না পৌঁছায়।

উপহার

বাচ্চারা সহজে পড়তে বসতে চায় না। তাই মাঝেমধ্যে পড়ার চাপ বেশি থাকলে, বাচ্চাকে বলতে পারেন, সেদিন তিরিশ মিনিট একটু বেশি পড়াশোনা করতে, তার বদলে পরের দিন তিরিশ মিনিট বেশি খেলার স্বাধীনতা দিন। অথবা কোনও দিন আপনার কথা শুনে বাচ্চা বেশি পড়াশোনা করলে, উপহার হিসাবে তার পছন্দের খেলনা কিংবা খাবার তাকে দেবেন। এতে বাচ্চাকেও মানসিক ভাবে আনন্দে রাখা সম্ভব।

প্রশংসা

বাচ্চা পড়াশোনা পারুক বা না পারুক, মাঝেমধ্যে হালকা প্রশংসা করুন। বাচ্চা এতে উৎসাহ পাবে। শিশুরা প্রশংসা বা উৎসাহ পেতে দারুণ ভালোবাসে। তাই পড়াশোনার কারণে এই প্রশংসা যদি পায় ওরা, তাহলে লেখাপড়ায় আগ্রহ বাড়বে ওদের।

গেমস

এখন প্রচুর ইন্ডোর গেমস, বই ইত্যাদি পাওয়া যায়, যা বাচ্চার কগনিটিভ স্কিল বাড়াতে সাহায্য করে। যেমন নানা ধরনের অ্যাক্টিভিটি বুক, বিল্ডিং ব্লকস, পাজলস ইত্যাদি। স্মার্টফোন, কম্পিউটারের বদলে এই ধরনের খেলা বা বই বাচ্চাকে দিলে, তাদের মনোযোগের সমস্যা অনেকটাই কমানো যাবে। এছাড়াও মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্টেও তালিম দেওয়াতে পারেন। কারণ, সুর তোলার মধ্যে দিয়ে, কনসেনট্রেশন লেভেল বাড়ানো যেতে পারে।

এগুলো ছাড়াও বাচ্চার সঙ্গে নানারকম শিক্ষামূলক বিষয় নিয়ে কথা বলুন। বাচ্চার কথাও মনোযোগ দিয়ে শুনুন। অভিভাবকেরা মনোযোগ সহকারে বাচ্চার কথা শুনলে, বাচ্চার ছটফটে ভাব অনেকটা কমে যাবে। কিন্তু স্কুলের হোমওয়ার্ক করে দেবেন না, বাচ্চাকে নিজেকেই করতে দিন। স্কুলে যদি বাচ্চা বকুনি খায়ও, তাতে মনখারাপ করবেন না, এতে বাচ্চা পড়ার গুরুত্ব বুঝবে।

গুরুদায়িত্ব পালন

বাড়ির পরিবেশ শান্ত, স্বচ্ছন্দ থাকলে বাচ্চার স্বভাবেও তার প্রভাব পড়বে। তাই নিজেদেরও টেনশনমুক্ত রাখার চেষ্টা করুন অন্তত বাচ্চাদের সামনে। আর বাচ্চাকে সবসময় পজিটিভ থাকতে শেখান। ছোটোখাটো কোনও সমস্যা এলে, তা কীভাবে ধৈর্য নিয়ে এবং বুদ্ধি দিয়ে সমাধান করতে হবে, সেই বিষয়ে সঠিক ভাবে পথ দেখান আপনার সন্তানকে। সেইসঙ্গে, বাচ্চা যাতে মিশুকে, সামাজিক হয়ে ওঠে, সেই শিক্ষাও দিন ওদেরকে। কারওর ভালো করতে না পারুক, কিন্তু কারওর যাতে ক্ষতি করার ইচ্ছে তৈরি না হয় আপনার সন্তানের, সেই মানসিকতা তৈরি করিয়ে দিন অভিভাবক হিসাবে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...