আমাদের যাত্রা শুরু হল মাদুরাই থেকে। গন্তব্য দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলবর্তী ভারতের একেবারে শেষ বিন্দু। ভ্রমণপিপাসু আমি যখনই যেখানে যাই, সেই জায়গার ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক— সবটারই গুরুত্ব জানবার চেষ্টা করি। খুঁজে বেড়াই জায়গাটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পৌরাণিক গল্পগাথা। কিংবা অদ্ভুত অলৌকিক কোনও অবাক করা অবিশ্বাস্য ঘটনা। আর চোখ ভরে নিয়ে আসি প্রকৃতির সৌন্দর্য।
এবার চললাম ধনুশকোডি (তামিলনাড়ু)। নামটা শুনে চমকে উঠেছিলাম, এ আবার কী নাম রে বাবা! অদ্ভুত একটি নাম! কী এর অর্থ? কেন এই নাম? কবে কে এই নাম দিল? একে একে আমার সব প্রশ্নের উত্তরই আমি পেলাম সেই জায়গায় গিয়ে। সে কারণে অবশ্য কিছু স্থায়ী বাসিন্দাদের সঙ্গে আমার আলাপচারিতা করতে হয়েছে বৈকি। যদিও বর্তমান সময়ে নেট ঘেঁটে অনেক তথ্য পাওয়া যায়, তবু স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করাতে একটা আলাদা আনন্দ, থ্রিল আছে। দোকানদার কিংবা পথচারী কিংবা বাড়ির গেটে দাঁড়ানো কোনও মহিলাকে জিজ্ঞেস করলে তারাও কিন্তু সোৎসাহে এগিয়ে আসে বলবার জন্য।
মাদুরাই থেকে বেরোতে বেরোতে বেশ বেলা হয়ে গেল। তড়িঘড়ি একটি ট্যাক্সি ধরে আমরা রওনা হলাম ধনুশকোডি-র উদ্দেশে ঠিক বেলা আড়াইটেয়। বাস কিংবা ট্রেন থাকলেও ট্যাক্সি নিলাম। কারণ, সবুজেভরা মাদুরাই-এর দৃশ্যপট নিজের মতো করে দেখতে আর মাঝেমধ্যে একটু বিশ্রাম নিতে নিতে আনন্দ নেব বলে। ধারায় বসে একটু চা, পকোড়া খেয়ে যাওয়া যাবে। ব্যাপারটা বেশ জমে যাবে। ন্যাশনাল হাইওয়ে-৮৭ ধরে আমরা এগোলাম। প্রথমে প্রায় ১০০ কিলোমিটারের একটু বেশি ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে টানা যেতে হবে, তারপর ৬০-৬২ কিলোমিটার স্টেট হাইওয়ে। তারপরেই আমরা পৌঁছে যাব রামেশ্বরম। আর রামেশ্বরমে পৌঁছে গেলে ধনুশকোডি আমাদের হাতের মুঠোয়। সে এক অতি ক্ষুদ্র একটা ভুতুড়ে গ্রাম দেশের একেবারে শেষ বিন্দুতে।
তর সইছে না। শুধু ভাবছি তখন, কখন পৌঁছাব, কখন পৌঁছাব। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর এসে পৌঁছালাম রামেশ্বরমের কাছে। দেশের মূল ভূখন্ড থেকে রামেশ্বরমের মাঝ দিয়ে গড়িয়ে গেছে সমুদ্র। তো যাবার উপায়! আসলে রামেশ্বরম মূলত একটি দ্বীপ, মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন।
বিখ্যাত পম্বন ব্রিজ (১৯১৪) যুক্ত করেছে রামেশ্বরমকে দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে। জানা গেল, মাঝেমধ্যে ব্রিজের মাঝ বরাবর খুলে দেওয়া হয় জাহাজ যাতায়াতের জন্য। গাড়ি থেকে নামলাম, ব্রিজে দাঁড়ালাম। চিরকাল এই পম্বন ব্রিজ পর্যটকদের আকর্ষণ করে। সত্যিই অপূর্ব! চারিদিকে কেবল জল আর জল। আমার ডান হাতের সমুদ্রে অসংখ্য মাছ ধরার নৌকা, ছোটো-বড়ো। দূর থেকে ডিঙি নৌকাগুলো লেডি বার্ডের মতো লাগছে। যেন লেডি বার্ড হেঁটে চলেছে।
স্থির জলের উপর সূর্যের আলো পড়ে কেমন অদ্ভূত রং তৈরি হয়েছে জলের। সেই রঙের নাম আমার জানা নেই। নীল! আকাশি! সবুজ! কমলা! সব মিলেমিশে একাকার মায়াময় এক রং। দূরে বড়ো বড়ো সারিবদ্ধ নারকেল গাছ, কতক গোয়ার বিচের মতো লাগল। কত গাড়ি ছুটে চলেছে ব্রিজের উপর দিয়ে। ট্যুরিস্টদের জন্য ফুটপাত রয়েছে, পুলিশ সর্বদা প্রহরারত।
পম্বন ব্রিজের ঠিক বাঁ-পাশ দিয়ে রেলওয়ে ট্র্যাক। একেবারে নীল জলরাশির উপর। আগে কোনও দিন এমনটা দেখিনি। অবাক হয়ে গেলাম। কেবলমাত্র রেলের লাইন পাতা। ওই ভূখণ্ড থেকে এই ভূখণ্ড পর্যন্ত টানা। কী করে বানাল! যারা বানাল তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা সত্যি প্রশংসনীয়। রেল সেতুর পাশে লোহার গরাদ পর্যন্ত নেই, কেবল সেতুটা জলের উপরে ঠিক যেন ঝুলছে, বলা যায় ভাসছে।
কপাল ভালো সেই সময় একটি যাত্রীবাহী ট্রেন ঝিক ঝিক করে শম্বুক গতিতে সমুদ্র পার হল একেবারে ধীরে ধীরে। এতটুকু এদিক-ওদিক হলেই একেবারে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে। আমরাও যেন দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। এমনটা তো দেখিনি! ট্রেন চলে যাবার পর একটি নিশ্চিন্তের নিঃশ্বাস ফেললাম। আবার হইহই করে গাড়িতে চড়ে বসলাম। নিরাপত্তারক্ষীরা খুব বেশিক্ষণ দাঁড়াতে দেয় না।
উল্লেখ্য, বর্তমানে পুরোনো পম্বন ব্রিজের পাশ দিয়ে নতুন ব্রিজের কাজ চলছে। জানা গেল, খুব শিগগির চালুও হবে।
এবার পম্বন ব্রিজ পেরিয়ে এলাম রামেশ্বরম শহরে। চওড়া রাস্তার দু’ধারে হোটেল। আমাদের আগে থেকে বুকিং করা ছিল। হোটেল পৌঁছাতে পৌঁছাতে ততক্ষণে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। অচেনা জায়গায় রাত-বিরাতে বেরিয়ে লাভ নেই, বরং নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। কাল সকালেই আমরা যাব আমাদের বহু প্রতীক্ষিত গন্তব্য ধনুশকোডি, একটি গা ছমছমে, পাণ্ডববর্জিত, ভূতুড়ে, রহস্যময় জায়গা। কিন্তু কেন? কী রহস্য?
পরদিন চললাম ধনুশকোডি। শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে পম্বন দ্বীপে এই ছোট্ট গ্রাম। শহর থেকে বেরিয়েই একটি নির্জন রাস্তা ধরে এগোলাম আমাদের ভাড়া গাড়ি নিয়ে। বেশ চওড়া সুন্দর রাস্তা। দুইদিকে ঘন সবুজ, যাকে ফরেস্ট বললে ভুল হবে না। আরও কিছু গাড়ির আসা যাওয়া চলছে বটে। চলতে চলতে ড্রাইভার ভাই আমাদের অনেক গল্প শোনাল। লোকাল ড্রাইভার নিলে তারাই কিন্তু গাইডের কাজটা সেরে দেয়। অনেক তথ্য তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়।
(ক্রমশ…)