ঘন জঙ্গল শেষ হয়ে গেলেও রডোডেনড্রন, ফার, সিলভার বার্চ গাছের বিচ্ছিন্ন জঙ্গল এখনও দেখা যাচ্ছে। ক্রমে ক্রমে বৃক্ষরাজি শেষ হয়ে দেখা যেতে শুরু করল জুনিপারের ঝোপ। পার্বতী উপত্যকা ধীরে ধীরে প্রশস্ত হয়ে এল। বৃষ্টি থেমে গেছে। আমাদের আনন্দ উচ্ছ্বাস, কলধ্বনি পার্বতী নদীর জলশব্দের সঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছে। এ পথের খুঁটিনাটি সর্দার নিষ্ঠুর নখদর্পণে। এই পথের আমাদের প্রকৃত গাইড। পার্বতীর বাম তীর ধরে এতক্ষণ হাঁটছিলাম আমরা। নিম্বু বলল কিছু সময় পরে ডান তীরে চলে যাব। সামনেই একটা কাঠের ব্রিজ রয়েছে।
কিছু সময় পর দূর থেকে কাঠের ব্রিজটি দৃশ্যমান হল। ব্রিজের কাছে যত যাচ্ছি মাথার চুল খাড়া হয়ে যাচ্ছে! লোহার তারে বাঁধা কাঠের সেতু একদিকে হেলে বিপজ্জনক ভাবে ঝুলছে। এখান দিয়ে নাকি পেরোতে হবে! আরে, এখানে উঠলেই তো ভেঙে পড়বে! যাব কেমন করে?
নিম্বুর অভয় বাণী— ‘কুছ নেহি হোগা, আপলোগ চলিয়ে।’
সবাই বসে রইলাম হতভম্ব হয়ে। এই নদীর স্রোত পেরিয়ে অপর পাড়ে যাওয়া অসম্ভব! অল্প সময় পরে হঠাৎ দেখি, এক মেষপালক হাজির ভেড়ার পাল নিয়ে। দলবেঁধে ভেড়া গুলি চলে এল, চলে এল মেষপালক।
—দাদা আপলোগ আরামসে যাইয়ে, এ ব্রিজ টুটেগি নেহি। মেষপালকের অভয় বাণী।
সমস্ত পোর্টার আরামসে পেরিয়ে গেল। নিন্ধু পেরিয়ে গেল তড়িৎ গতিতে। পিছনে এক এক করে আমরা বিপজ্জনক সেতু পেরিয়ে এলাম। আমাদের সঙ্গে আরও এক পথপ্রদর্শক রয়েছে গত দু’দিন ধরে। সবসময় আগে আগে চলছে, তাই পথ চিনতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। লাল রঙের একটি কুকুর অর্থাৎ লালু।
ব্রিজ পেরিয়ে পাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে উপরে উঠে এলাম। সামনেই বিস্তৃত প্রায় সমতল প্রান্তর। তার মধ্যে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে পার্বতী নদী। ফুটবল মাঠের মতো এই থাচগুলিতে (বুগিয়াল) মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে পেরিয়ে চলেছি। মাড়িয়ে চলেছি নানা অজানা ফুলের ডালি। ফুল গাছের জঙ্গল ভেদ করে পৌঁছে গেলাম পুলি ব্রিজের ধারে।
একটা লোহার খাঁচা ঝোলানো আছে মোটা তারের সঙ্গে। খাঁচার দুই পাশে লাগানো দড়ির সাহায্যে একে একে সবাই পেরিয়ে এলাম। লালু চিৎকার জুড়ে দিল, অসহায় ভাবে এদিক ওদিক দৌড়াতে শুরু করল নদী পেরিয়ে আসার অভিপ্রায়ে। এক মালবাহক অনুমতি নিয়ে লালুকে আনতে গেল। পুলি ব্রিজ পেরিয়ে অল্পসময়ে পৌঁছে গেলাম আজকের গন্তব্য ঠাকুরকুঁয়া। সময় দুপুর আড়াইটে। এখানে নাকি একটা গুহা আছে, প্রয়োজনে বেশ কয়েকজন আরামে রাত্রিবাস করতে পারে। বৃষ্টি না হলেও সাদা মেঘ এখনও আকাশ ঢেকে রেখেছে।
পরেরদিন চললাম ঠাকুরকুয়া থেকে ওডিথাচ। উচ্চতা ১২,৫১৭ ফিট, দূরত্ব ১২ কিমি। সকাল থেকেই দেখলাম বন্ধুরা হাসিখুশি, উচ্ছল। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। দীপকের তৈরি রুটি-সবজি খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পার্বতী নদীকে বাঁদিকে রেখে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছি, সামান্য উতরাই সহজতম পথ। আজ আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ রয়েছে, সূর্যদেব লুকোচুরি খেলছে মেঘবালিকাদের সাথে। অদূরেই বাঁদিক থেকে আসা ডিবি বকরি নালাকে দেখা গেল। উত্তর-পূর্বদিক থেকে এসে দুটো বিশাল পাথরের মাঝখান দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পার্বতীর বুকে। দেখলে রোমাঞ্চ লাগে।
ডিবি বকরি নালার সঙ্গমকে বাঁদিকে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম। সোজা সরল পথ, সামনের দিকে দৃষ্টি আর বাধা পেয়ে ফিরে আসছে না। দিগন্ত রেখায় কয়েকটি ঝুলন্ত হিমবাহ দেখা যাচ্ছে। ডানদিকে একটা বরফের শৃঙ্গ উঁকি মারছে। বিস্তৃত সবুজের ময়দান। নিম্বু বলল, জায়গাটার নাম গদ্দি থাচ। সকাল দশটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম পান্ডুপুলের ধারে। ডানদিক থেকে একটা নালা এসে পার্বতীতে মিশেছে। একটা বড়ো গোলাকার পাথর রয়েছে পারাপারের জন্য। অনভিজ্ঞদের এই পাথর, সাহায্য ছাড়া অতিক্রম করা বিপদজনক।
দ্বিতীয়দিন সত্যিই আমরা একসাথে চলতে পারিনি। গোল পাথরের সামনে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। পাথরের মাথার উপর উঠে দেখলাম, পার হওয়া রিস্কি। গোল বিপুল আকৃতির পাথরটির গায়ে হালকা খাঁজ। ঠিকমতো একটা পা রাখাও মুশকিল। নীচ দিয়ে ভয়ংকর গতিতে বয়ে চলেছে এক নালা। প্রথমে পার্বতী নদীর দিকে পাথরের গায়ে নেমে ডানদিকে পাথরের খাঁজে পা রেখে পেরিয়ে যেতে হবে। পাথরটিতে ধরার মতো কিছুই নেই।
পাথরের গা ঘেঁষে দড়ি ধরে পাথরের খাঁজে নেমে এলাম। কিন্তু পা এগোনোর মতো জায়গা পাচ্ছি না। নীচে মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। পাথরের গায়ে শুয়ে পড়ে ধীরে ধীরে পেরিয়ে এলাম। সবারই একই অবস্থা। পাথরের গায়ে নামতেই দেখি পা কাঁপছে, দড়ি ছেড়ে পাথর ধরে এগিয়ে আসছে। সবাই চিৎকার করে উৎসাহ দিতে লাগল আর আমি দড়ি ধরে থাকতে বললাম।
গোলাকার গণ্ডশিলা পেরিয়ে নেমে এলাম পার্বতী নদীর কূলে। সামনে আবার বিপুল আকৃতির পাথর। তার নীচ দিয়ে পার্বতী নদী বয়ে চলেছে। আকৃতির কারণে মধ্যম পাণ্ডবের নামে নামকরণ ‘পাণ্ডুপুল’। বিশাল আকৃতির পাথরের গায়ে নুড়িপাথর সাজিয়ে সিঁড়ি করে দেওয়া আছে। নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে দড়ি ধরে অতিক্রম করলাম পাণ্ডুপুল। সদস্যরা সবাই এপারে চলে এলে মালবাহকদের সাহায্য করলাম বোঝাগুলি এপারে নিয়ে আসতে।
এখন পার্বতী নদীকে ডান দিকে রেখে এগিয়ে গেলাম। আমাদের বাঁদিকের গিরিশিরা থেকে একের পর এক জলধারা নেমে এসেছে। সেগুলি অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছি। পাণ্ডুপুল থেকে প্রায় এক ঘণ্টা পরে বিশাল এক সবুজ ময়দানে নেমে এলাম। দক্ষিণ-পশ্চিম (আমাদের ডানদিক) দিক থেকে একটি খরস্রোতা নালা এসে মিশেছে পার্বতী নদীর অপর পাশে। সেদিকে তাকালে চোখে পড়বে কুলু আইগার কে শৃঙ্গ (১৮,৫০০ ফিট )। এখানে পার্বতী নদী অসংখ্য ধারায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। স্বর্গীয় স্থান। ভেলভেটের মতো নরম প্রান্তরে গড়াগড়ি খেল সবাই। লম্বা বিশ্রাম নিলাম। গন্তব্য খুব সামনেই। মালবাহকদের নিয়ে রাজা, নিম্বু সবাই চলে গেল। কারও তেমন হেলদোল নেই সামনে এগিয়ে যাওয়ার। আমাদের গন্তব্যস্থলের কাছেই রয়েছে একটা বড়ো গুহা। অভিযাত্রী দল চাইলে সেখানে রাত্রিবাস করতে পারে, কিন্তু জল বেশ কিছুটা দূরে!
আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পরই পৌঁছে গেলাম গন্তব্য ওডি থাচে। দূর থেকেই দেখলাম কয়েকজন ক্রিকেট খেলছে। কয়েকটি রঙিন তাঁবু লাগানো রয়েছে নদীর ধারে। দেখলাম আমার পূর্ব পরিচিত বেহালার কয়েকজন অভিযাত্রী। আমাদের একদিন আগেই যাত্রা শুরু করেছিল। আজ ওনাদের বিশ্রামের দিন। লেগে পড়লাম ক্রিকেট খেলায়। কাপড়-কাগজে তৈরি বল এবং ভাঙা গাছের ডাল দিয়ে তৈরি ব্যাট। সাড়ে ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় ক্রিকেট খেলছি ভাবা যায়! চারিদিকে কালো পাথর দিয়ে ঘেরা উঁচু স্টেডিয়াম। নাহ, বেশিক্ষণ খেলতে পারলাম না, হাঁপিয়ে উঠছি। চলে এলাম নিজেদের তাঁবু টাঙাতে। নদীর ধারে বাতাস প্রচণ্ড জোরে বইছে। একটু পিছিয়ে এমন ভাবে তাঁবু লাগানো হল, যাতে হাওয়ার দাপট কিছুটা কম লাগে। এরই মধ্যে ম্যানেজার প্রণব ও স্বরূপ “বিখ্যাত’ মশলা মুড়ি তৈরি করে ফেলেছে। সবাই বেশ জমিয়ে খেলাম।
দেখতে চললাম মানতালাই লেক। উচ্চতা ১৩,৩৬৭ ফিট, দূরত্ব ১০ কিমি। সকালে খেয়ে বেরোতে বেরোতেই আটটা বেজে গেল। সবাই মোটামুটি ধীরে সুস্থে এগিয়ে চলেছি। উচ্চতাও বাড়ছে ধীরে ধীরে। পার্বতী নদী উপত্যকার কাদাজল, নুড়িপাথর মাড়িয়ে এগিয়ে চললাম। দুই পাশের গিরিশিরাগুলি থেকে অগণিত ছোটো ছোটো জলধারা এসে মিশেছে পার্বতী নদীর সঙ্গে। আজও আকাশের মুখ ভার হয়ে রয়েছে। সবুজ বিস্তৃত প্রান্তরের মাঝে মাঝেই বিপুল আকৃতির পাথর স্তুপ বেমানান ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে একাকী। যেন গৃহচ্যুত উপল রাজ।