প্রায় দু-ঘণ্টা হাঁটার পর সামনে দেখা গেল সম্মুখ গ্রাবরেখা খাড়া স্তুপকে। নিন্নু জানাল, এই উঁচু পাথরের স্তূপের পিছনেই রয়েছে পার্বতী নদীর উৎস ‘মানতালাই’ লেক। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের ঝুলন্ত হিমবাহের পাথর গড়িয়ে এসে পার্বতীর গতিপথকে আটকে তৈরি হয়েছে বিশাল এক সরোবর।

বাঁদিক থেকে নেমে আসা কয়েকটি জলধারা অতিক্রম করে খাড়া চড়াই ভেঙে উঠতে শুরু করলাম। সাদা মেঘ দেখতে দেখতেই ঢেকে দিল চরাচর। সঙ্গে সাবু দানার মতো বরফ কুচির উপহার। সবাই পলিথিন শিট ঢেকে নিলেও এতটা ঠান্ডার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছি। ঝুরো পাথরের পথ ভয়ংকর পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে। পায়ের চাপে খসে যাচ্ছে পায়ের তলার আলগা পাথর। অক্সিজেনের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। বুক হাপরের মতো উঠানামা করছে। জিভ শুকিয়ে কাঠ। বোতলের ঠান্ডা জলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে চড়াই ভেঙে উপরে উঠে এলাম। পিঠটা ঠেকিয়ে দিলাম পাথরের দেয়ালে, কিছুটা বিশ্রামের তাগিদে।

এখান থেকে সামনে অনেকটা নীচে মানতালাই সরোবরকে দেখা গেল। চড়াই ভাঙা শেষ হলেও বিপদমুক্ত নই আমরা! সরু খাড়া ঢালের পিচ্ছিল উতরাই পথ অনেক বেশি বিপদসংকুল। ধীর পায়ে সাবধানে একে একে নেমে এলাম সরোবরের ধারে। নীচে পাথর সাজিয়ে তিন- চারটি বেদি তৈরি করা হয়েছে। তিনটি সিঁদুর মাখা ত্রিশূল পোঁতা রয়েছে। কাপড়ের টুকরো হাওয়ায় উড়ছে পতপত করে। সবাই পবিত্র সরোবরের জল মাথায় ছিটিয়ে বসে গেলাম উপাসনার কাজে। ধূপ জ্বালিয়ে প্রসাদ অর্পণ করা হল দেবতার পায়ে। কথিত আছে দেবী পার্বতী ও অন্যান্য দেব-দেবীরা বছরে কোনও এক বিশেষ দিনে এখানে স্নান করতে নামেন। ছবি তুলে ও প্রসাদ খেয়ে এগিয়ে চললাম গন্তব্যে। আকাশ এখন অনেকটা পরিষ্কার। আধ ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছে গেলাম আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে।

(8)

এত কিছু শব্দ কানের মধ্যে ঢুকলেও মাথা পর্যন্ত যাচ্ছিল না। ভালো লাগার রেশে সারা মন প্রাণ ডুবে ছিল। তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে মন ভরে গেল। মানতালাই লেকের উপর দাঁড়িয়ে থাকা ত্রিভুজ আকৃতির শৃঙ্গটি সোনালি টোপর পরে ফেলেছে। চারিদিকে সুউচ্চ পর্বতে ঘেরা বিশাল আয়তনের সরোবরটির জল যেন কাকচক্ষুর মতো, দেখে মনে হয় যেন একখণ্ড সুবিশাল নীলকান্তমণি। তুষারাবৃত পর্বত থেকে নেমে আসা বরফ গলা জলে এই হ্রদ সর্বদা পূর্ণ থাকে। পিরামিড শৃঙ্গের প্রতিকৃতি সুস্পষ্ট ভাবে ফুটে থাকে সরোবরের জলে।

তাঁবুর গায়ে জমাট বাঁধা বরফ। কালকের জলতরঙ্গ খেলে যাওয়া লেকটি জমে স্তব্ধ হয়ে গেছে। আজ সারাদিন বিশ্রাম। লেকের চারপাশ ঘুরে ছবি তোলা আর গল্পে কেটে যায়।

পরের দিনের গন্তব্য মানতালাই থেকে উচ্চ পার্বতী বেস ক্যাম্প। আজ আমাদের চড়াই পথে ১৩ কিমি পথ অতিক্রম করতে হবে। অধিক উচ্চতার কারণে বাতাসে অক্সিজেনের অভাব রয়েছে। গতকাল রাতে রাঁধুনি দীপকের জন্মদিন পালন করেছি। পোলাও ছিল অপূর্ব স্বাদের। টিনের বাক্সে থাকা গোলাপ জামুনের সদগতি করেছি সবাই। আজ সকাল সকাল রওনা হওয়ার কথা থাকলেও ভিজে তাঁবু শুকিয়ে বের হতে দেরি হবে। ঠিক হল রাজা আর নিন্ধু আমাদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাবে। রাঁধুনি দীপক তাঁবু শুকিয়ে, গুছিয়ে আসবে পিছনে।

তাঁবু খুলতে গিয়ে পার্থ আবিষ্কার করল গন্ধের উৎস। আমাদের প্রিয় কুকুর লালুর গা থেকেই আসছে বিটকেল পচা গন্ধ। গতকাল রাতে মাঝে মাঝেই পেয়েছি আর পরস্পর ভুল কথা ভাবছিলাম। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় আমাদের তাঁবুর আউটারের নীচে আশ্রয় নিয়েছিল লালু।

সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে রওনা হলাম পিন পার্বতী বেস ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে। গতকাল নিম্বু বলছিল, আগে এই পার্বতী হিমবাহ ধরে কয়েক কিমি যাওয়ার পর পার্বতী নদীকে অনুসরণ করে বাঁদিকের গিরিশিরার উপর চড়তে হতো। ১০ কিমি দীর্ঘ পার্বতী হিমবাহ অসংখ্য ক্রিভাস সমৃদ্ধ ও বিপদজনক বলে এই পথে আর কেউ যায় না। পরিবর্তে বাঁদিকের ছোট্ট একটা নদী অতিক্রম করে ৬০-৭০ ডিগ্রি খাড়া চড়াই ভেঙে পৌঁছাতে হবে গিরিশিরার মাথায়।

বাঁদিকের খাড়া পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। একদিনের বিশ্রামে সবাই তরতাজা হয়ে উঠেছে। গল্প মজা করতে করতেই পৌঁছে গেলাম একটি বড়ো ঝোরার কাছে। পাহাড়ের মাথা থেকে পাথরের খাঁজে খাঁজে উদ্দাম নৃত্য করতে করতে নেমে আসছে জলধারা। দূর থেকে শব্দ শুনেই ধারণা করেছিলাম আকৃতির। পথ অতিক্রমে বাধা হয়ে দাঁড়াল। কোমরে দড়ি আর হাত ধরাধরি করে সবাই পেরিয়ে এলাম। তীব্র ঠান্ডা বরফ গলা জলে নিম্নাঙ্গ অবশ হয়ে গেল। আদুরে হাতে ঘষে ঘষে ওম দেওয়ার চেষ্টা চলল কিছু সময়।

আরও কুড়ি মিনিট হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম খাড়া পথের নীচে। নিন্ধু আঙুল দিয়ে দেখাল ওই পথেই যেতে হবে আমাদের। খাড়া পাথরের দেয়ালের গায়ে সংকীর্ণ পথরেখা।

মানসিক ভাবে প্রস্তুত হলাম, এ যাত্রার সব থেকে কঠিন পথ অতিক্রম করার লক্ষ্যে। বলা হল প্রত্যেকের সঙ্গে ১৫ থেকে ২০ ফুট ব্যবধান রেখে ধীরে ধীরে চলতে। পাথর না পড়ে সে ব্যাপারে বিশেষ ভাবে সতর্ক করা হল। ঠিক হল সামনের জন যতক্ষণ চড়াই ভাঙবে নীচের ব্যক্তি অপেক্ষা করবে। ভুলবশত পাথর খসে পড়লে নীচের সবাইকে সাবধান করে দেবে।

শুরুটা হল চমৎকার। সিঁড়ি ভাঙার মতো চড়তে শুরু করলাম। আস্তে আস্তে দেহভার অসহ্য হয়ে উঠল। বুকের ভিতরে থাকা হৃদযন্ত্রটি ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। উপর দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছিলাম চড়াইয়ের ভয়ংকরতা। টানা আকাশমুখী পথ। নাগালের মধ্যেই ফুটে রয়েছে সূর্যমুখীর মতো দেখতে ফুল। খাড়া ঢালে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার মতো অবস্থাতেও নেই। দুয়েকবার ছোটো পাথর খসে পড়লেও কারও বিপদ ঘটেনি। প্রায় দু’ঘণ্টার প্রাণান্তকর চড়াই ভেঙে পৌঁছে গেলাম উপরে।

বরফের ঘোমটা টেনে পিরামিড আকৃতির ‘দক্ষিণ পার্বতী’ শিখর লাজুক চোখে তাকিয়ে রয়েছে। নীল আকাশের গায়ে অপরূপা হয়ে দাঁড়িয়ে। আকাশের দিক থেকে চোখ নামিয়ে আনলাম নীচের পৃথিবীতে। U-আকৃতির বিস্তৃত ধূসর হিমউপত্যকা। মাঝে মাঝেই হিমবাহের দেহপটে সবুজাভ জলরাশি (Tarn Lake) দৃশ্যমান। পার্বতী উপত্যকার দুই পাশে খাড়া পর্বত শ্রেণি। অধিকাংশের মাথা বরফের টোপর পরা। এখনও অনেক পথ বাকি! অধিকাংশই বোতলের জল প্রায় শেষ করে ফেলেছে। নিন্ধু জানাল— ‘পানি আভি নেহি মিলেগা। অউর ১ ঘণ্টা চলনেসে মিল জায়েগা।’

তুলনামূলক সহজ পথে এগিয়ে চললাম। পরপর গিরিশিরাগুলি অতিক্রম করে পৌঁছে গেলাম পার্বতী নদীর পার্শ্বে। অনেক নীচ দিয়ে প্রবল গর্জনে বয়ে চলেছে। নদীকে ডানদিকে রেখে এগিয়ে চললাম উৎসমুখের দিকে। স্যাঁতস্যাঁতে জোলো বাতাস বুকভরে টেনে নিয়েও জলের পিপাসা মিটল না। বুকের মধ্যে রুক্ষ মরুভূমির পিপাসা। আরও মিনিট পনেরো হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম আদিগন্ত বোল্ডারের সাম্রাজ্যে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে তির তির করে বয়ে আসা জল সবার তৃষ্ণা নিবারণ করল।

বারবার চোখ আকাশ ছুঁলেও মন ভাবছিল অন্য কথা। হিমালয়প্রেমী কত মানুষের স্মৃতি বুকে নিয়ে আছে এই পাহাড়, এই পথ। এই ছড়ানো পাথরেরা কত অভিযাত্রীদের দেখেছে। তাদের কত কথা, কত গল্পের এরা সাক্ষী! ভাবতে ভাবতে কখন দু’চোখ জুড়ে এসেছিল মনে নেই, এমন সময় নিম্বুর গলা— ‘চলিয়ে সাব! কাফি দূর জানা হোগা। মৌসম ঠিক নেহি লাগ রাহা হ্যায়।’

নিম্বুর ডাকে ধড়মড় করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চোখ মেলে দেখি পশ্চিম আকাশে রূপসি মৌসমের এ কী রূপ! পিঠ বেয়ে নামা একঢাল এলো চুলের মতো কালো মেঘ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামছিল। অবাধ্য পদযুগলকে যত দ্রুত গতিতে সম্ভব এগিয়ে নিয়ে চললাম। নড়বড়ে পাথরের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলাম। খাড়া অনন্ত পাথুরে পথ। টলমল করতে করতে এক সময় পৌঁছে গেলাম প্রশস্ত তুষার খেতের সন্নিকটে। স্থাপিত হল আজকের শিবির পার্বতী বেস ক্যাম্প। উচ্চতা ১৬,২০৭ ফুট অর্থাৎ তিন হাজার ফুট উচ্চতা চড়তে হয়েছে। চড়াই ভেঙে সবাই ক্লান্ত। বাইরে ঝোড়ো হাওয়া ঠান্ডার তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সন্ধ্যা হতেই স্লিপিং ব্যাগের উষ্ণতায় আশ্রয় নিলাম। দূর থেকে অনবরত ভেসে আসা ভয়াল বুমবুম বরফ ভাঙার শব্দ শুনতে শুনতেই ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলাম।

( 5 )

ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। তাঁবুর বাইরে গিয়ে দেখি নীল আকাশের কণ্ঠলগ্ন হয়ে আছে হিমগ্ন শিখর। প্রথম সকালের নরম আলোয় ফুলশয্যার রাতের মতো সোহাগে যেন ভাসছিল। এই দিনটি আমাদের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ। বহু অক্ষাঙ্খিত পিন-পার্বতী গিরিবর্তে পৌঁছাতে চলেছি। সামনে শেষ পথটুকু, ইতি টানলেই পৌঁছে যাব স্বর্গের ঠিকানায়। শেষবারের মতো তাই তাগিদটাকে উসকে দিলাম।

প্রাতরাশ খেয়েই সারিবদ্ধ উটের মতো এগিয়ে চললাম কচ্ছপের পিঠের মতো আকৃতি এবং কঠিন বরফের ঢাল বেয়ে। শুভ্র বিপুলাকার উত্তাল ময়দানটির শেষ প্রান্তে কালো পাথরের খাঁজ দেখা যাচ্ছে। যত উপরে উঠছি ঢাল অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে আসছে। একে একে সবাই উপরে উঠে এল। উপরের ক্ষেত্রটি প্রায় সমতল তবে নরম বরফে ঢাকা।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...