খাড়া বরফের দেয়ালের মাঝখানের সরু গলির কাছ থেকে ডানদিকে বাঁক নিলাম। সামনেই বিস্তৃত তুষারের অনন্ত শয্যা। আশেপাশে বরফের ফাটল আছে। কিছু দেখা যাচ্ছে, বাকিটা বরফের অন্তরালে সন্তর্পণে ক্ষুধার্থ শ্বাপদের মতো অপেক্ষা করে আছে। মূর্খ লোকেদের কিছু সুবিধা আছে। কিছুই জানি না, তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সামনে থাকা নিম্বুর পদচিহ্নতে পা মিলিয়ে এগিয়ে যাও।

গত কয়েকদিন থেকেই মৃন্ময় পিছিয়ে পড়েছিল। আজ আরও বেশি। একঘেয়ে বরফে চলার ক্লান্তি, অক্সিজেনের অভাব, বারবার গলা শুকিয়ে আসছিল। হাঁ করে থাকা বরফের ফাটল এড়িয়ে এগিয়ে চলেছি। স্বরূপ, আজ বেশ কিছুটা এগিয়ে রয়েছে। সঙ্গী কুকুর লালু। ইয়েতির মতো বিশাল দেহটা চলতে চলতে হঠাৎ হারিয়ে গেল বরফের মধ্যে। অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে গেল! বরফের ঢাল বেয়ে দৌড়ে চলেছে রাজা আর নিম্বু। আমরা বেশ কিছুটা দূরে। পায়ের তলা শিরশির করছে, বুকের মধ্যে দামামা।

বারবার বলি এগিয়ে যাস না! একসাথে যাব। এই বিপদজনক পথ একাকী যাওয়া অনুচিত। হঠাৎ দেখি, স্বরূপের মাথা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে পুরো দেহ। দূর থেকে হাত নেড়ে জানাল, সব ঠিক আছে। সবার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। একে একে সবাই পৌঁছে গেলাম ক্রিভাসের ধারে। প্রায় ৫ ফুট চওড়া ও ৫ ফুট গভীর। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর স্বরূপ সাহস করে নেমে পার হতে গিয়ে বরফে গেঁথে গেছে। ফাটল-এর নীচে পায়ের ছাপ দেখে এই দুঃসাহসিক কাজটি করে ফেলেছে। রোপ ও আইস এক্সের সাহায্য নিয়ে আমরা একে একে পেরিয়ে এলাম। আমায় যেন অন্যরকম ভালোলাগায় পেয়ে বসেছিল। চলতে চলতে বারবার থামছিলাম। অসম্ভব চড়াই বেয়ে মনে মনে পৌঁছে যাচ্ছিলাম পাহাড়ের শীর্ষে, যেখানে আকাশ পৃথিবীর শরীর ছুঁয়ে আছে পরম মমতায়, ভালোবাসায়। থামার সময়টুকু পেরোতেই আবার এগিয়ে চলা নিঃশব্দে। শুভ্র বরফের উপর চলার শব্দ। পথ ধীরে ধীরে উঠেছিল মাথার উপর দিগন্তহীন নীল আকাশের দিকে।

বরফের দেয়ালের প্রান্তদেশে কালো সীমারেখা। ওখানেই পৌঁছাতে হবে। গিরিশিরাটি অর্ধচন্দ্রাকারে বেষ্টন করে আছে। বাঁদিকের একটা অংশ কিছুটা চাপা। কিন্তু ওখান দিয়ে অতিক্রম করতে হবে! সাবধানে সেগুলি পেরিয়ে, বাঁদিকের পাহাড়ের ঢাল বেয়ে এক টানা উঠতে থাকলাম। ক্র্যাম্পন না থাকায় বারবার পিছলে যাচ্ছিলাম। শরীরের শেষ শক্তিটুকু উজাড় করে ওই বরফের মসৃণ দেয়াল বেয়েই উঠে এলাম চির কাঙ্ক্ষিত পিন পার্বতী পাসের শীর্ষে।

চোখের সামনে তুষার মৌলি হিমালয়ের গিরিরাজরা। দক্ষিণ পার্বতী, স্নো পিক, কাঙলা টাবো, রিজ পিক, পিরামিড পিক, কুলু মাকালু, বড়া শিগ্রি, ওয়েস্ট হর্ন প্রভৃতি। এছাড়াও কত নাম না-জানা শৃঙ্গ উজ্জ্বল আলোকে উদ্ভাসিত। পায়ের নীচে সাদা মেঘ অঞ্জলি দেওয়া ফুলের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলাম চূড়ায় চূড়ায় আলোর খেলা। চির তুষারাচ্ছন্ন হিমালয়ের অপরূপ সৌন্দর্যের মধ্যে যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেকে!

সবার চোখ-মুখ চুঁইয়ে পড়ছিল বিজয়ের আনন্দ। ভালোলাগা আর ভালোবাসায় বারবার জড়িয়ে ধরেছিলাম পরস্পরকে। আনন্দের এই মুহূর্তগুলোকে সবাই ক্যামেরাবন্দী করতে ভুলল না। পূজা পাঠ, খাওয়া-দাওয়া করতেই এক ঘণ্টা কেটে গেছে। দাঁড়িয়ে আছি ১৭,৩৮৮ ফুট উচ্চতায়। সংকীর্ণ পরিসরের এই বিভাজিকাটির দুই দিকে খাড়া ঢাল অতলে নেমে গেছে। সামান্য এদিক ওদিক হলেই অস্তিত্ব রসাতলে!

দ্রুত গতিতে সবাই নামতে শুরু করল। এক ঘণ্টার মধ্যে এসে পৌঁছে গেলাম পাথরের রাজ্যে। এখান থেকে অনেকটা নীচে বাঁদিকে দেখা গেল একটি হিমবাহ। তার দু-দিক থেকে দুটি ধারা এসে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে পিন নদী। কিছুটা যাওয়ার পর একটা ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড দেখতে পেলাম। সম্ভবত পিন উপত্যকার দিক থেকে অভিযাত্রীদের বেস ক্যাম্প। এখান থেকে ক্রমাগত নেমে চলা। হাঁটু বিদ্রোহ করতে শুরু করেছে। অনেক নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে পিন নদী। বাঁদিকের হিমবাহটি আধ কিমির বেশি চওড়া নয়। গল্প করতে করতেই নেমে এলাম নদী উপত্যকায়। এখানে জল অসংখ্য ধারায় বিভক্ত।

উচ্ছল, উত্তাল স্রোতস্বিনী পাগলা ঝোরা উদ্দাম গতিতে এগিয়ে চলেছে। সবাই জুতো খুলে, প্যান্ট গুটিয়ে প্রস্তুত। ছোটোখাটো চেহারার সুনীত তখনও ভ্যাবলাকান্ত হয়ে পাথরের উপর বসে। যে কুলিরা পেরিয়ে গেল তাদের হাঁটুর উপর জল। সুনীতের তো বিপদসীমা ছুঁয়ে যাবে! অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবাই নেমে পড়ল জলে। মালবাহকেরা ধরে রয়েছে। জলে ডুবে থাকা পাথরগুলি পদতলে অসহনীয় ভাবে বিধছে। নদী পেরিয়ে সমতল পথ ধরে ৪৫ মিনিট হাঁটার পর পাথর ঘেরা একটা সুন্দর জায়গা পাওয়া গেল। নিম্বু বলল জায়গাটার নাম “থিয়া থাচ”। পাশ দিয়েই নাচতে নাচতে বয়ে চলেছে পিন নদী। এখান থেকে দেখা যায় বরফাবৃত শৃঙ্গগুলিকে। কুলু উপত্যকায় মেঘের বসন পিন উপত্যকার শিখরগুলি ত্যাগ করে একসাথে অনাবৃত হয়ে রয়েছে, চোখ ফেরানো দায়।

( 6 )

এবার ঝকঝকে সকাল এল অজস্র রোদ্দুরকে সঙ্গে নিয়ে। অকলংকিত গিরিশীর্ষগুলি ঝলমল করছিল নীল আকাশের পেক্ষাপটে। সামনে জরাগ্রস্ত নারীর বুকের মতো সজীবতাহীন উপত্যকা। ঠান্ডা হাওয়া রুক্ষ উপত্যকার বুক ছুঁয়ে আলতো করে বইছে। আজ আমাদের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। তিয়া থেকে মুদ গ্রামের দূরত্ব ২৫ কিমির বেশি। সহজ পথ হলেও সংকীর্ণ, অসমান পাথুরে। সবার মধ্যেই খুশির ঝলক। দীর্ঘদিন পরে জনজীবনে ফিরে যেতে পারবে! পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগও রয়েছে। প্রাতরাশ খেয়ে বেরোতে বেরোতেই বেশ দেরি হয়ে গেল। পিন উপত্যকার বুকে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে শেষবারের মতো দেখে নিলাম পিন পার্বতী পাসকে।

উপত্যকার মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে চঞ্চলা পিন নদী। নদীপাশের বিভিন্ন আকৃতির পাহাড়গুলিতে যেন টেরাকোটার সূক্ষ্ম কাজ। সকালের নরম রোদ্দুর পড়ে নানা রঙের বদল ঘটছে। লাদাখের পাহাড় ও ধূসর কিন্তু এত রঙের বাহার পাহাড় দেখা যায় না। স্পিতির এই নিভৃত অঞ্চল কত সুন্দর না দেখলে বিশ্বাস হয় না। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। প্রায় ৪ ঘন্টা হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম বাঁধানো রাস্তায়।

এখানে পিন নদীতে মিলিত হয়েছে আরেকটি নদী। বহুক্ষণ চলল আড্ডা। এখনও অনেক পথ। বাকি রাস্তাটুকুর জন্য গাড়ি পাওয়া দুরাশা। পিন নদীকে সঙ্গে নিয়ে চলছি তো চলছি। অনন্ত পথ শেষ আর হয় না! শক্ত পাথরে পথে চলতে গিয়ে পায়ে বেশ ক’টি ফোস্কা পড়েছে। পোড়া পা আর সঙ্গ দিচ্ছে না! দূরে দুর্গের মতো দেখতে পাহাড়ের কোলে একখানি ছোট্ট গ্রাম দেখা যাচ্ছে! পিন নদী এখান থেকে ডানদিকে বাঁক নিয়েছে। হাতের কাছেই লাল, সবুজ, হলুদ ধূসর পাহাড় সারি সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝেই তাদের বুক চিরে নেমে আসা জলধারা ধুইয়ে দিয়ে যাচ্ছে পথ। ভেড়-বকরির দল চরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের গায়ে। ঘাসের বোঝা নিয়ে ঘরমুখো গ্রামের মেয়েরা। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গোলাপি ঠোঁটের নরম হাসির ঢেউ তোলে। হলদে হয়ে আসা বিকেলের আলো, পাহাড়ি মেয়েগুলির মতোই রূপসি। স্বর্গ থেকে বিদায় নেওয়ার দুঃখে মন ভাঙছিল। আবার নতুন করে অপেক্ষা!

এক সময় ক্লান্ত চরণ এসে যায় মুদ গ্রামের প্রাঙ্গণে। পিন উপত্যকার পটভূমিতে দিগন্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অসংখ্য পাহাড়গুলির শরীর থেকে ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছিল অস্তরবির আলো। শুকিয়ে আসা বিবর্ণ কড়াইশুঁটির গাছের উপর দিয়ে হিমেল হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল হু হু করে, বুক ফাটা দীর্ঘশ্বাসের মতো। আমার আত্মা, সত্তা, অস্তিত্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক শুদ্ধ অনাবিল অনুভূতি।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...