ভালো ভাবে খোঁজখবর নিলে জানতে পারবেন যে, গরমকালের তুলনায় শীতকালে নানারকম স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন অনেকেই। শুধু তাই নয়, শীতকালে হার্ট অ্যাটাকও বেশি ঘটে। আসলে, শীতে অসুস্থ হয়ে পড়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই সময় বেশিরভাগ মানুষ ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা কিংবা স্পাইসি খাবার খাওয়া নিয়ে যতটা ব্যস্ত থাকেন, স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ততটা নজর রাখেন না। কিন্তু কষ্ট করে হলেও কিছু খাদ্য এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নিয়ম মেনে, লাইফস্টাইল-এ কিছু পরিবর্তন আনতে পারলেই এই শীতেও থাকতে পারবেন সুস্থ, স্বাভাবিক। রইল পরামর্শ।
সামগ্রিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন ডা. এম এস পুরকাইত (মেডিকেল সুপারিনটেনডেন্ট, টেকনো ইন্ডিয়া ডামা হসপিটাল) —
শীতের ঋতু সাধারণত অক্টোবরের শেষ থেকে শুরু হয় এবং হোলির আগে অর্থাৎ মার্চ মাসে শেষ হয়। আর শীত মানেই অলসতা এবং আরামের অনুভূতি এই সময়ে যে-কোনও মানুষের মন এবং শরীরে বিরাজ করে। যা আমাদের জীবনধারার মান বদলে দেয়। দেখা যায়, এই বাড়তি আরাম কিংবা আলস্যের ফলে, শারীরিক মুভমেন্ট অনেকটাই কমে যায়, যা আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। শীতকালে তেল-মশলাযুক্ত খাবার বেশি খাওয়ার ফলেও হজমের সমস্যা তৈরি হয় এবং রোগভোগ বাড়ে। তাই, শরীরের উপর কোনও নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে, কিছু অপরিহার্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে রুটিন ব্যায়াম, যা একজন মানুষকে ফিট এবং সতেজ রাখতে সাহায্য করে।
মনে রাখবেন, শরীরকে ঠিক রাখতে গেলে, শীতকালে দ্রুত হাঁটার অভ্যাস জারি রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, শীতকালে বেড়ানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করেও শরীর-মনকে ঠিক রাখতে পারি আমরা। যাদের ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন এবং সিওপিডি কিংবা হার্টের সমস্যা আছে, শীতকালে চিকিৎসকের পরমর্শ নিয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত সেইসব রোগীদের। এর ফলে বড়ো ধরনের বিপদ এড়াতে পারবেন। আর শীতকালে যাদের অতিরিক্ত ধূমপান কিংবা মদ্যপানের অভ্যাস রয়েছে, তাদের তা বর্জন করা উচিত এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো লাইফস্টাইল চেঞ্জ করা উচিত।
শীতে শরীরকে গরম রাখতে প্রয়োজনীয় ক্যালোরির প্রয়োজন হয়। তাই শরীরকে স্বাস্থ্যকর উপকরণ জোগান দেওয়ার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চলা উচিত। এই সময়ে পালংশাক, মেথিশাক, সরষেশাক ইত্যাদি সবুজ পাতা-যুক্ত সবজি রাখুন খাদ্য- তালিকায়। এগুলি আয়রন, অ্যান্টি অক্সিড্যান্টস, ফলিক অ্যাসিড, ম্যাগ্নেশিয়াম, কপার, ফসফেট ইত্যাদি উপকরণে ভরপুর। এই উপাদান ইমিউনিটি বাড়িয়ে স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
এছাড়া ভিটামিন “সি”-র জোগান দেবে কমলালেবু, আমলকী, পাতিলেবু, কিউয়ি, পেয়ারা, ব্রোকোলি, পালংশাক ইত্যাদি ফল ও সবজি। ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যাবে কমলা বা লাল রঙের ফল আর সবজি থেকে। যেমন পেঁপে, গাজর, রাঙাআলু, তরমুজ, লাল আঙুর, আম ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ থাকে। ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত করতেই যে শুধু দরকার এমন নয়, শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও সাহায্য করে। দুধ, দই, ঘি, ছানা, চিজ, ঢ্যাঁড়শ, পালং, ব্রোকোলি, বিনস এবং ফলের মধ্যে কমলালেবু, কিউয়ি, ব্ল্যাকবেরি, পেঁপে ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম থাকে।
শীতে ভারী খাবার খেয়ে হজম করা একটু মুশকিল। ফাইবার-যুক্ত আহার আমাদের হজম প্রক্রিয়া মজবুত করতে সাহায্য করে। ফাইবার-যুক্ত সবজি, ফল, ব্রাউন ব্রেড, ডাল, গমের আটা, ড্রাইফ্রুটস, ওটস, কড়াইশুঁটি, ভুট্টা ইত্যাদি ইমিউনিটি শক্তি বাড়াতেও খুবই কার্যকরী।
প্রচুর পরিমাণে পানীয় জল গ্রহণ করা প্রয়োজন শীতকালে। জল শুধু তেষ্টা মেটায় না, শরীরে ওষুধের মতো কাজ করে। শরীরের বিষাক্ত বর্জ্য তত্ত্ব বাইরে বার করে দিতেও সাহায্য করে। সারাদিনে অন্ততপক্ষে তিন লিটার জলপান করা অত্যন্ত জরুরি। তুলসী অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করে। মধুর সঙ্গে তুলসীপাতা সেবন করলে শীতকালে সর্দি, কাশির হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। শরীর ফিট রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম প্রয়োজন। যোগব্যায়াম, এক্সারসাইজের সঙ্গে সিঁড়িতে ওঠানামা, ডান্স, হাঁটাচলা করা, খেলাধুলা সবকিছুই জীবনশৈলীর অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্ছনীয়। শরীরে রোদ লাগানোও দরকার। সকালের নরম রোদের এমন অনেক গুণ রয়েছে, যা নানারকম সংক্রমণ দূরে রাখতে শরীরকে সাহায্য করে। হাড় শক্ত করে। তাই, রোজ সকালে ৮টার মধ্যে অন্তত দশ মিনিট সূর্যের আলোয় থাকুন।

চোখ সুরক্ষিত রাখার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন ডা. অনন্যা গঙ্গোপাধ্যায় ( চক্ষু রোগ বিশেষজ্ঞ, দিশা আই হসপিটাল) —
অনেকেই শুধু গ্রীষ্মকালে চোখের বিশেষ যত্ন নেন। কিন্তু শীতকালে চোখের যত্নের ব্যাপারে প্রায় উদাসীন থাকেন বলা যায়। কিন্তু চিকিৎসক হিসাবে আমার পরামর্শ— গরমকালের থেকে শীতকালে বেশি যত্ন নেওয়া উচিত চোখের। কারণ, শীতকালে চোখ আরও বেশি সেনসেটিভ এবং দুর্বল থাকে। এর প্রাথমিক কারণ হল— শীতকালে সূর্য পৃথিবীর থেকে ভিন্ন কোণে অবস্থান করে এবং সূর্যের এই ভিন্ন অবস্থানের ফলে এই সময় চোখ বেশি UV রশ্মি বা অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে আসে। সেইসঙ্গে, শীতকালে আমরা বাইরে বেশি সময় কাটাই। তাই বিষাক্ত ধোঁয়া, ধুলোময়লা এবং সূর্যের প্রখর তাপ আমাদের চোখকে আরও সমস্যায় ফেলে।
মনে রাখবেন, অতিবেগুনি রশ্মি ত্বকের চেয়ে চোখের টিস্যুর বেশি ক্ষতি করে। ছানি, ম্যাকুলার সমস্যা, ফ্ল্যাশ বার্ন, এমনকী চোখের পাতার ক্যান্সার এবং চোখের চারপাশের মুখের ত্বক সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে এসে চোখের ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে শীতকালে। আর যদি আকাশের অবস্থা হালকা মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তাহলেও চোখের ঝুঁকি বাড়তে পারে নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক কারণে। যাদের চোখের সমস্যা আছে, তাদের শীতকালে পাহাড়ে বেড়াতে না যাওয়াই ভালো। কারণ, অতি উচ্চতায় অবকাশ যাপন করলে, নানারকম কারণে চোখ আরও দুর্বল এবং ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এক্ষেত্রে বড়োদের থেকে বাচ্চাদের চোখে বেশি কুপ্রভাব পড়তে পারে। কারণ, বাচ্চাদের চোখের লেন্স বেশি পরিষ্কার হয়। তাই এই সময় যতটা সম্ভব তীব্র রোদে বাচ্চাদের নিয়ে বেরোনো উচিত নয় এবং ভালোমানের রোদচশমা পরা উচিত বড়োদের। এমনকী, যারা কনট্যাক্ট লেন্স পরেন, তাদেরও সানগ্লাস পরা উচিত। এছাড়া, চোখের কিছু ওষুধ সূর্যের আলোয় এলে চোখের সংবেদনশীলতা বাড়ায়। তাই যারা চোখের চিকিৎসায় আছেন, তারা রোদে যত কম বেরোবেন, ততই ভালো। শীতকালে সরাসরি সূর্যের দিকে তাকানো কিংবা জলে সূর্যের প্রতিফলনের দিকেও সরাসরি তাকানো উচিত নয়। এর ফলে রেটিনার ক্ষতি হতে পারে। ছানি অস্ত্রোপচারের পরে যদিও ইন্ট্রা-ওকুলার লেন্স ইমপ্লান্টে অতিবেগুনি রশ্মির ফিল্টার থাকে, তবুও সানগ্লাস দিয়ে চোখকে আরও সুরক্ষা দেওয়া উচিত।
আমেরিকান আকাদেমি অফ অপথালমোলজি শীতকালীন চোখের যত্নের বিষয়ে বিশেষ কিছু পরামর্শ দিয়েছে। যেমন— আপনি যদি দীর্ঘক্ষণ ইনডোর হিটারের সংস্পর্শে থাকেন, তাহলে আপনার চোখের হিউমিডিফায়ার দিয়ে চিকিৎসা করা দরকার। কারণ এই হিটারগুলি বায়ুকে শুষ্ক করে তোলে, ফলে চোখের ক্ষতি হয়। বিশেষকরে যদি আপনি কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করেন, তাহলে রুম হিটার এড়িয়ে চলা উচিত। আর খুব ঠান্ডা আবহাওয়ায় চোখের চারপাশের নরম অঞ্চলকে সুস্থ রাখার জন্য ভালো মানের আই ক্রিম লাগানো উচিত চোখের চারপাশে।
শীতকালে অনেকে কম জলপান করেন ঠান্ডার কারণে। কিন্তু এই অভ্যাস পরিবর্তন করে প্রতিদিন অন্তত তিন থেকে চার লিটার জলপান করা উচিত শরীরে জলের চাহিদা এবং ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য। কারণ, শরীরে জলের ঘাটতি হলে চোখেরও ক্ষতি হতে পারে।
শীতকালে টাটকা শাকসবজি সঠিক পরিমাণে খাওয়া উচিত। এর ফলে চোখ ভালো থাকবে। গাজরে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ থাকে, যা রেটিনার জন্য ভালো। শীতকালে ফল খাওয়াও চোখের জন্য ভালো। মাছের তেল, কড লিভার অয়েল এবং উদ্ভিজ তেলের মতো খাবারেও ওমেগা থ্রি এবং ওমেগা সিক্স ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা চোখের জন্য উপকারী। এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি চোখকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। সবুজ শাক-সবজি যেমন পালংশাক, ধনেপাতা, সরষেশাক প্রভৃতিতে লুটেইন থাকে, যা ম্যাকুলার-কে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচায়।
ধূমপান এবং মদ্যপান বর্জন করা উচিত শীতকালে। কারণ, এই সময় জল কম পান করার ফলে শরীরে জলের চাহিদা বাড়ে এবং ধূমপান কিংবা মদ্যপানের ফলে শরীরে জলের ভারসাম্যের সমস্যা হয়। ফলে চোখেরও ভীষণ ক্ষতি হয়। এছাড়া, ধূমপানের ফলে ছানি, ম্যাকুলার ডিজেনারেশন এবং অপটিক নার্ভের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। চোখের স্ট্রেন একটি অত্যন্ত সাধারণ সমস্যা হলেও, এই বিষয়ে অবহেলা করা উচিত নয়। তাই শীতকালের শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে, কম্পিউটার স্ক্রিন অবিরাম দেখা বিপজ্জনক হতে পারে। নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে সামান্য বিরতি নেওয়া দীর্ঘমেয়াদে চোখের জন্য উপকারী।





