বীর বাহাদুর রাণা

‘নমস্কার। পর্বতারোহী সংঘের বার্ষিক সভা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে। আপনারা একটু  ধৈর্য ধরুন। আমাদের আজকের সভার প্রধান অতিথি বিখ্যাত পর্বতারোহী অমৃতেন্দু মিত্র অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছোবেন। তার পরই আমরা সভার কাজ শুরু করব।’

সুন্দরী অল্পবয়সি ঘোষিকাটি মঞ্চের ডানদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। হলের মধ্যে পিন পতনের শব্দ হলেও বুঝি শোনা যাবে। এয়ার কন্ডিশনারের কৃত্রিম ঠান্ডা আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বেশ খানিকক্ষণ আগেই হলে পৌঁছে, নিজের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসে পড়েছিল রিনা। রিনা মল্লিক, কামেট শিখরে অভিযানকারী দলের সদস্য।

হলটা এখনও মোটামুটি ফাঁকাই। চেনাশোনা দু-চারজন রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। ঘাড় ঘুরিয়ে এসবই দেখছিল রিনা। হলে ঢোকার দরজাটা অল্প ফাঁক করে ঢুকে এল মন্দিরা যোশী। অতীতে বহু স্মরণীয় অভিযানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই সাহসী মহিলার নাম। এখন একটু বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু চলাফেরায় তেজ দেখলে সেকথা কে বলবে?

রিনাকে দেখেই উল্লসিত হয়ে উঠলেন মন্দিরা। একগাল হেসে সৗজন্যের হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি কেবল তোমাকে জয়ী হতে দেখতে এসেছি রিনা। ওরা যখন বলল, পর্বতারোহণের ইতিহাস থেকে কলঙ্কজনক অধ্যায়টাকে ওরা মুছে ফেলতে চায়, তখনই আসতে রাজি হয়ে গেলাম। খানিকটা দেরি হয়তো হল, কিন্তু তোমার প্রাপ্য সম্মানটা তো ওরা দিতে চাইছে! ভুল তো মানুষ মাত্রেই হয়!’

মন্দিরা যোশীর আন্তরিক হাসিমুখটা দেখে মন ভরে গেল রিনার। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই, রিনা যেন এক বছর আগের এক অপ্রিয় অতীতে ফিরে গেল। পাহাড়ে তখন সন্ধ্যা নামছে। হাড়ের মধ্য দিয়ে ঢুকছে কনকনে ঠান্ডা। পোশাকের পর পোশাক চাপিয়েও সামলানো যাচ্ছে না শৈত্যের আগ্রাসন।

বিকেল পাঁচটা। কামেট শিখরে বেস ক্যাম্প ফেলেছে দশ সদস্যের পর্বতারোহী দল। একটু আগেই ডাক পড়েছে পাশের রান্নাঘরের টেন্টে। খাবার রান্না মোটামুটি শেষ। আড়ম্বর তো নেই কিছু। অতএব সেখানে বসে খেতে খেতেই পরের দিনের অভিযানের রূপরেখা তৈরি করে ফেলা হবে। এটাই নিয়ম। কেউ স্পষ্ট করে না বললেও সকলেই জানে। পর্বতে সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি। এমন নিরালা, নির্বান্ধব পরিবেশে বেশিক্ষণ জেগে থাকার প্রশ্ন নেই। চারদিকে কেবলই ধু-ধু বরফ। তার আড়ালে দিগন্তও ঢাকা পড়ে গেছে। আলো যত পড়ে আসে, ততই রহস্যময় হয়ে পড়ে সেই বরফের ময়দান। যেমন রহস্যময়, তেমনই ভীতিপ্রদ। দেখতে দেখতে ক্রমে সেই ভয়ও একঘেয়ে হয়ে যায়।

বরফের চাদর পেরিয়ে সকলেই কিচেন টেন্টে গিয়ে হাজির হল। টিমটিমে আলোর খুব সামনে দুটি মাথা ঝুঁকে রয়েছে। তাদের একজন নগেন্দ্র রাই। তার হাতে টোপো শিট। সেটিকেই বারবার তিনি খুঁটিয়ে দেখছেন। কারণ, খাওয়াদাওয়ার পর তাকেই অভিযাত্রীদের চূড়ান্ত নাম ঘোষণা করতে হবে।

রিনা টেন্টের পর্দা সরিয়ে ঢুকে চারদিকে চোখ ফিরিয়ে অন্যান্য সদস্যদের দেখল একবার। কিচেন টেন্টের একেবারে কোণে শেরপা তামাং, বনরোত, লুসাইরা রাতের খাবারদাবার তৈরি করছে। বিউটেন গ্যাসের বার্নার জ্বলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অত উপরে অন্য কোনও গ্যাস, জ্বালানি হিসাবে কাজ করে না। বরফকে গরম করে তবে জল পাওয়া যায়। টেন্টের পর্দাটা টানটান করে আটকে দিল রিনা। বাইরে থেকে কনকনে বাতাস ঢুকে আসবে না হলে। টেন্টের বাইরে এখন মাইনাস আঠারো ডিগ্রি। ইতিমধ্যেই বরফের কামড়ে সদস্যদের কারও কারও আঙুলের ডগা বিশ্রীভাবে ফাটতে শুরু করেছে। রিনা গ্লাভস-এর মধ্যে হাতটা মুঠো করল।

নগেন্দ্র রাই কথা বললেন।

‘আপনারা জানেন, ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত, কামেটের শৃঙ্গে পৌঁছোনোর জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ের অভিযান কালই শুরু করতে হবে আমাদের। ওই উচ্চতায় পৌঁছোতে হলে, আমাদের কাল শেষরাত ৩টের সময় এই বেস ক্যাম্প ছাড়তে হবে।’

নগেন্দ্র রাই তীক্ষ্ণ চোখে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন। হাতে ধরা কাগজটি সামান্য তুলে ধরে বললেন, ‘কালকের অভিযাত্রী দলে যারা থাকবেন, তাদের নাম নিয়েই আমরা এতক্ষণ আলোচনা করছিলাম। সর্বসম্মতিক্রমে, এবং অবশ্যই ডা. যোশীর পরামর্শ নিয়ে আমরা সাতজন সদস্যের নাম চূড়ান্ত করেছি!’

টেন্টের মধ্যে এখন বুঝি পিন পতনের শব্দও শোনা যাবে। বাইরে শুধু হিম-বাতাসের কোলাহল। সকলেই নিশ্বাস বন্ধ করে সেই চূড়ান্ত ঘোষণার প্রহর গুনতে থাকল। এমন ঐতিহাসিক অভিযানে, অভিযাত্রী দলের সদস্য হতে চায় সকলেই।

নগেন্দ্র রাই তার অসম্ভব ব্যারিটোন গলায় বলতে থাকেন নামগুলো। একটি করে নাম উচ্চারিত হয় আর রিনা কড় গুনে হিসাব রাখে। এই বুঝি তার নামটিও ভেসে আসবে। সেই চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে সে। একসময় নগেন্দ্র রাই নাম পড়া শেষ করে চোখ তুলে তাকান। বলেন, ‘এই সাতজনকেই বেছেছি আমরা। বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মানসিক জোর এবং তারপরই স্বাস্থ্য।’

রিনা আর না বলে পারল না। এই হিমবাতাসেও তার কপালে যেন ঘাম জমার মতো অনুভব হচ্ছে। জয়ের এত কাছে এসেও জয় অধরাই থেকে যাবে তার কাছে? এই ভাবনা তাকে পীড়িত করল।

‘স্যার আমার নাম কেন নেই এই তালিকায়?’ কথাগুলো যেন ছিটকে বের হল তার মুখ থেকে। বরফ ঝড়ের তীব্রতার মতোই।

নগেন্দ্র রাই সেই ক্ষুরধার দৃষ্টিতে তাকালেন রিনার দিকে। তার ঠোঁটের কোণে এক ঝলক হাসি খেলে গেল। শেষে অত্যন্ত সুভদ্র গলায় বললেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড়ো অসুবিধার জায়গা আপনার বয়স, ম্যাডাম। আপনাকে নির্বাচিত না করার মুখ্য কারণও এটাই। রাস্তাটা অত্যন্ত দুর্গম, আপনি জানেন। তা ছাড়া ডা. যোশী জানালেন, আপনার ব্লাডপ্রেশারও ফ্লাকচুয়েট করে ঘনঘন আর পায়েও একটা পুরোনো চোট আছে। ফলে, এই শারীরিক অবস্থায় আপনাকে এত উঁচুতে যাওয়ার অনুমতি আমি দিতে পারি না। এটা আমাদের অন্যান্য সদস্যদের উপরেও একটা খারাপ প্রভাব ফেলবে।’

রিনা বেশ অবাক-ই হয়ে গেল। বয়সটা তার পক্ষে একটা বাধা, সন্দেহ নেই। কিন্তু, শারীরিক কোনও অসুস্থতা এখানে আসা ইস্তক ভোগায়নি তাকে। ডা. যোশীও তাকে একরকম অভয় দিয়েই এসেছেন এতদিন। সেই তিনিই নগেন্দ্র রাইকে তার সম্পর্কে অন্যরকম রিপোর্ট দিয়েছেন দেখে ভারি অবাক হল রিনা। ডা. যোশী মাথা নীচু করে বসে রয়েছেন।

রিনা বলল, ‘কিন্তু স্যার, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। অভিযানের জন্য মানসিকভাবেও আমি প্রস্তুত। আপনি প্লিজ আমায় কালকের টিমে শামিল করে নিন।’

শেষদিকে রিনার কথাগুলো অনুনয়ের মতো শোনাল। কিন্তু নগেন্দ্র রাই নরম হওয়ার লোক নন। ততটাই কঠোর গলায় বললেন, ‘আমি আপনার ব্যাপারে কোনও ঝুঁকি নেব না ম্যাডাম!’

এক বাক্যে গোটা টেন্টে গভীর নীরবতা নেমে এল।

‘এটাই তাহলে আপনার শেষ সিদ্ধান্ত?’ রিনা প্রশ্ন করে।

‘সিদ্ধান্ত একবারই নেওয়া হয়,’ নগেন্দ্র রাই বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘এই সিদ্ধান্ত দলের ক্যাপ্টেনের। এরপর আপনি যদি কিছু করেন, সেটা আপনার দায়!’

নগেন্দ্র রাই উঠে পড়লেন। ডা. যোশীও। ফের রিনার দৃঢ় গলা চমকে দিল তাদের, ‘স্যার, আমি হেরে যেতে আসিনি। আপনি এবং দলের বাকি সদস্যরা শুনে রাখুন, কাল অবশ্যই আমি অভিযানে যাব। নিজের ট্রেকিং আমি নিজেই করবঃ!’

‘আপনি কিন্তু দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন ম্যাডাম,’ নগেন্দ্র রাই ফুঁসে উঠলেন রাগে, ‘এমন হলে ভবিষ্যতে আপনার ট্রেকিংয়ের কেরিয়ার সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকী আপনার অতীতের কৃতিত্বগুলিও কেড়ে নেওয়া হতে পারে। সেটা মাথায় রাখলে আপনি ভালো করবেন বোধহয়!’

‘ডা. যোশী, আপনি কী মনে করছেন?’ ক্যাপ্টেনের কথার কোনও জবাব না দিয়ে রিনা সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দেয় দলের চিকিৎসকের দিকে।

ডা. যোশী না তাকিয়েই মৃদু গলায় বলে ওঠেন, ‘আপনার ব্লাডপ্রেশার আর স্বাস্থ্যের সার্বিক অবস্থা দেখার পরও ঝুঁকিটা নেওয়া উচিত হবে না ম্যাডাম!’

ডা. যোশীর দিক থেকে যে কোনও সাহায্যই পাওয়া যাবে না, সেকথা বিলক্ষণ বুঝে গেছিল রিনা। তাই বলল, ‘রাজ্যস্তরে আমাকে যখন নির্বাচন করা হয়, সেখানেও চিকিৎসকরা আমার শারীরিক অবস্থার পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। আমি ঘুষ দিয়ে পাশ করিনি।’

প্রতিদ্বন্দ্বী আরও অনেকে ছিল। কিন্তু তারা আমাকেই যোগ্য বলে মেনে নিয়েছিলেন। এখন আপনারা অন্যরকম কথা বলছেন। তাহলে কি তারা ভুল ছিলেন?’

উত্তর এল না। উত্তরের প্রত্যাশাও করেনি রিনা। নিজের রাস্তা তাকে নিজেকেই তৈরি করে নিতে হবে, এ কথা সে বুঝে গেছে। রিনা অপেক্ষা করল না আর। টেন্টের পর্দা সরিয়ে বাইরে বরফের আস্তরণে পা রাখার আগে শেরপাদের বলে গেল, তার খাবারটা তার টেন্টে দিয়ে আসতে। এদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে লোকদেখানো টিমস্পিরিট দেখাতেও তার বিবমিষা এল।

টেন্টে ফিরে এসে সে পরের দিনের ইতিকর্তব্য ঠিক করতে বসল। একাএকা ট্রেকিংয়ের কথা বলে এলেও, বিষয়টা সহজ নয় মোটেই। যথেষ্ট ঝুঁকিও রয়েছে। ঠিক তখনই শেরপা রাজু টেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরে আসার অনুমতি চাইল। ঘড়িতে সময় দেখল  রিনা। ঠিক সাতটা বাজে। তার মানে, শেরপা রাজু রাতের খাবার নিয়ে এসেছে তার নির্দেশমতো। এ সময় মনে মনে সে যেন শেরপা রাজুকেই খুঁজছিল। উৎসাহভরে বলল, ‘ভিতরে এসো শেরপাঃ!’

খাটো চেহারার ভারি হাসিখুশি মানুষ শেরপা রাজু। বেশ করিতকর্মা অভিযাত্রী, আবার রাঁধুনিও বেশ ভালো। ধোঁয়া ওঠা গরম খাবার সামনের টেবিলে রেখে শেরপা রাজু হেসে বলল, ‘খেয়ে নিন ম্যাডাম!’

নগেন্দ্র রাইয়ের সঙ্গে তর্কবিতর্কের সময় শেরপা রাজু কাছাকাছিই ছিল। বোঝা যায়, সমস্ত আলোচনাটাই সে শুনেছে। তার দেহভঙ্গিমার মধ্যে, কেমন যেন তার প্রতি একটু হলেও সমবেদনার আভাস খুঁজে পেল রিনা। দলের বাকিদের বেশিরভাগই যে ক্যাপ্টেন রাইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবে না, তা হলফ করেই বলা যায়। প্রত্যেকের কাছেই কেরিয়ারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়ার মতো অবিমৃশ্যকারিতা দেখাতে প্রস্তুত নয় কেউ।

শেরপা রাজুকে দেখে একটু হলেও মনে বল পেল রিনা। জিজ্ঞেস করল, ‘শেরপা রাজু, এর আগে কতবার কামেট শৃঙ্গে উঠেছ তুমি?’

মুখে হাসি ধরে রেখে তিনটে আঙুল তুলে ‘তিনবার দেখাল শেরপা রাজু।

রিনা মুখ কালো করে বলল, ‘আমি যেতে পারব না ওখানে, শেরপা?’

শেরপা রাজু সহসা চোখ নামিয়ে নিল। তারপর হঠাৎ-ই রিনার চোখে চোখ রেখে খুব দৃঢ় গলায় বলে উঠল, ‘আমার মন বলছে, আপনি পারবেন ম্যাডাম। এত দূর যখন পৌঁছোতে পেরেছেন, তখন আর ওইটুকু উঁচুতে যেতে পারবেন না?’

তারপর একটু থেমে থেকে বলল, ‘কালকে আমাদের দলের গাইড তামাং শেরপা। আপনি ওর সঙ্গে চলে যাবেনঃ!’ সারারাত রিনার মাথার মধ্যে শেরপা রাজুর কথাটাই যেন গেঁথে রইল। তাকে ঘুমোতে দিল না। থেকে থেকে এপাশ-ওপাশ করতে থাকল রিনা। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, কামেট শিখরে যে করে হোক পৌঁছোতেই হবে তাকে। পরদিন শেষ রাত দুটোর সময় দলের অন্যরা যখন প্রস্তুত হতে থাকল, রিনাও তৈরি হয়ে নিল।

নগেন্দ্র রাই এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বোঝানোর মতো করে বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনাকে আমি শেষবারের জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। দয়া করে ঝুঁকি নেবেন না। এই দেখুন না কেন, আমার শরীরটা ঠিক নেই বলে আমিও যাচ্ছি না। সাতজনের দল গঠন করা হয়েছিল, এখন ছজন যাবে!’

নগেন্দ্র রাই উৎসুক চোখে রিনার দিকে চেয়ে রইলেন। চোয়াল শক্ত হয়ে রইল রিনার। কঠোর গলায় জবাব দিল, ‘আমি যাব। আপনি বেস ক্যাম্পে বসে থাকুন আর ক্যারম খেলুন!’

‘শাট আপ!’ রীতিমতো চেঁচিয়ে উঠলেন নগেন্দ্র রাই, ‘আমার সঙ্গে তর্ক করবেন না–!’

চেঁচামেচি শুনে মুহূর্তে অন্য সদস্যরাও এগিয়ে এসেছিল। নগেন্দ্র রাইকে তারাই কোনওরকমে শান্ত করে অন্যধারে সরিয়ে নিয়ে গেল। নগেন্দ্র রাই তখনও গরগর করছিলেন ভয়ানক রাগে।

কিন্তু এসবের ফলে অভিযান শুরু করতে দেরি হয়ে যেতে পারে ভেবে, দলের সদস্যরা তড়িঘড়ি ধামাচাপা দিয়ে দিল বিষয়টাকে। চারদিকে এখনও বরফের মতো শীতল শক্ত অন্ধকার। অভিযাত্রীদের তীব্র টর্চের আলো ধীরে ধীরে সেই অন্ধকারকে কেটে এগোতে থাকল। গাইড তামাংয়ের পিছন পিছন বরফের ঘন আস্তরণে পা রাখল রিনা। ভারী জুতো পরে থাকায় বরফের মধ্যে পা বসে যাচ্ছিল। এক জায়গা থেকে পা তুলে অন্য জায়াগায় রাখতে অনেকটা সময় যাচ্ছিল। অভিযাত্রীদের গতি স্বভাবতই হয়ে পড়ছিল অত্যন্ত ধীর।

কত সময় গেল তার হিসাব কে রাখে। ধীরে ধীরে দিগন্তের অন্ধকারও যেন হালকা হচ্ছে।

ক্যাপ্টেন ডোগরা কখন পাশে চলে এসেছেন, খেয়াল করেনি রিনা। চমক ভাঙল কাঁধের কাছে তার কণ্ঠস্বর শুনে।

‘ম্যাডাম, আপনি ঠিক কাজ করলেন না। টিম লিডারের নির্দেশকে অমান্য করা তো দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের সমান!’ ক্যাপ্টেন ডোগরা ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে রীতিমতো যুঝছেন, সেটা তার হাঁফিয়ে কথা বলার ভঙ্গি থেকেই পরিষ্কার।

রিনা চলতে চলতেই বলল ‘ক্যাপ্টেন, সেনাবাহিনিতে এমন অনুশাসন চলে, কিন্তু আমাদের সিভিলে চলে না। আমার অতীতের রেকর্ড দেখেই আমাকে নির্বাচন করা হয়েছিল। আমি তো কলকাতায় ফিরেই নগেন্দ্র রাইয়ের নামে নালিশ জানাব!’

সূর্যোদয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল আকাশ। ঘড়ির কাঁটা ভোর পাঁচটার দাঁড়িতে স্থির হয়ে পেরিয়েও গেল। সূর্যের হালকা লাল আভা কামেটশৃঙ্গের উপর ছড়িয়ে পড়ে আশ্চর্য প্রাকৃতিক সুষমা সৃষ্টি করেছে।

সাধারণভাবে কোনও পর্বতশৃঙ্গে ওঠার জন্য ভোরের সময়টাকেই বেছে নেন পর্বতারোহীরা। কারণ এসময়ে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ থাকে বেশি। বরফ ঝড়ের সম্ভাবনাও অনেক কম থাকে। দলের অন্যান্য সদস্যরা ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে থাকল। রিনাও ক্যামেরা ঠিক করে শাটার টিপল। যতদূর চোখ যায় কেবলই বরফ। মাঝেমধ্যে কয়েকটি দুর্লভ প্রজাতির বড়ো গাছ।

হঠাৎ-ই দলটা দাঁড়িয়ে পড়ল। গাইড তামাং কিছু বলছে। উৎকর্ণ হল রিনা। তামাং সকলকে তাদের সেফটি বেল্টের সঙ্গে দড়ির প্রান্ত বেঁধে নিতে নির্দেশ দিচ্ছে। এখান থেকেই শুরু হচ্ছে অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায়।

উচ্চতা যতই বাড়তে থাকল, ততই অভিযাত্রী দলের সদস্যদের মাথাও ঘুরতে শুরু করল অল্পবিস্তর। আশপাশের বড়ো গাছগুলির পাতা ও কাণ্ড থেকে ভেসে আসা তীব্র কটু গন্ধে অনেকে বমি করতে শুরু করল। ডা. যোশী তাদের সকলকেই ওষুধ দিলেন। কিন্তু কলকাতার আর-এক অভিযাত্রী মৃদুল সরকার বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ল। ওষুধেও কমল না তার অস্বস্তি।

গাইড তামাং ঝুঁকি নিতে চাইল না। মৃদুলকে দলের এক শেরপার সঙ্গে বেস ক্যাম্পের দিকে রওনা করিয়ে দিল। ব্যবস্থাপনায় সময় গেল কিছুটা। তারপর, আবার সকলে সামনের দিকে যাত্রা শুরু করল। দু-কিলোমিটারের মতো হেঁটে, আরও দুজন সদস্যের শারীরিক অস্বস্তি বাড়তে থাকল। অদূরে বরফের মধ্যে সুদীর্ঘ পরিখা। অসতর্ক থাকলে তার মধ্যে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। ওই দুজন সদস্য তেমন মানসিক জোর পেলেন না। এক শেরপাকে দ্রুত পাঠিয়ে মৃদুলদের থামিয়ে, তাদের সঙ্গেই এই দুজনকেও বেস ক্যাম্পে পাঠানোর বন্দোবস্ত করল তামাং। ভীষণ শীত আর পায়ের তলায় পুরু বরফ থাকার জন্য হাঁটতে অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছিল। সদস্যদের দিকে ফিরে তাকিয়ে তামাং সতর্ক করল, আপনাদের মধ্যে কেউ যদি ফিরে যেতে চান তো এখনই উপযুক্ত সময়। এরপর আমরা বরফের গ্লেসিয়ার পাব। উচ্চতাও বাড়বে। অক্সিজেনের সমস্যাও হবে। মনে রাখবেন, আমরা কিন্তু অক্সিজেন ছাড়াই এই অভিযানে নেমেছি!’

তামাংয়ের সাবধানবাণী শুনে, পুষ্পা যাদব আর রীতা সান্যাল বেঁকে বসল। বেস ক্যাম্পের ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল তারা। ডা. যোশী রিনার কাছে এসে বললেন, ‘এখনও সময় আছে রিনাদেবী। আপনি আর-একবার ভেবে দেখুন।

মৃদু হেসে রিনা জবাব দিল, ‘আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না ডাক্তাবাবু।’

সকাল আটটা বেজে দশ মিনিটে কামেট শিখরে পৌঁছে গেল অভিযাত্রী দলটি। অন্যান্য অনেক দেশের পতাকা দণ্ড এখনও সেখানে পোঁতা আছে। বরফ আর আবহাওয়ার অত্যাচারে পতাকার রং বেশ ধূসর। ডা. যোশী, তামাং আর ক্যাপ্টেন ডোগরার মুখে তৃপ্তির হাসি খেলে গেল। ডা. যোশী বরফের মধ্যে পুঁতে দিলেন পর্বতারোহী অ্যাসোসিয়েশন এবং দেশের পতাকা। সাফল্যের আনন্দে বিহ্বল হয়ে, এই অনন্ত পৃথিবীর বুকে চারটি আপাতনিঃসঙ্গ চরিত্র পরস্পরকে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসিয়ে দিল।

ডা. যোশী হাসিমুখে এগিয়ে এসে রিনার হাত নিজের হাতে নিয়ে বললেন, ‘অভিনন্দন রিনাদেবী। আপনি আমাদের সব আশংকাকে ভুল প্রমাণিত করেছেন।’

‘ধন্যবাদ তো তামাং দাজু পাবে। সে আমাকে প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়ে গেছে, ঠান্ডায় হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে কোনওরকমে বলল রিনা।

ক্যাপ্টেন ডোগরা ওয়াকিটকিতে বেস ক্যাম্পে নগেন্দ্র রাইকে বললেন, ‘স্যার, আমরা কামেট শৃঙ্গে পৌঁছে গেছি–!’ তার গলার উচ্ছ্বাস যেন কোনও বাধা মানছিল না।

ওপাশ থেকে নগেন্দ্র রাই জানতে চাইলেন, ‘রিনা মল্লিক সুস্থ আছেন তো?’

‘স্যার, শি ইজ পারফেক্ট.. আমরা তিনজনই সুস্থ আছি!’ ডা. যোশী আড়াচোখে একবার রিনার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠলেন।

ওয়াকিটকি বন্ধ করে দিলেন নগেন্দ্র রাই। খানিক ঈর্ষাও হল তার, সেইসঙ্গে অপমানও। মুখের মতো জবাব দিয়েছে রিনা, এর থেকে বেশি রাগের কারণ কী আর হতে পারে তার কাছে!

কামেট শিখরে অভিযাত্রী দলের সদস্যরা একে অন্যের ছবি ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রিনা তামাংকে বলল, পশ্চিমদিকে বরফের নীচে পড়ে থাকা অস্থি-পাঁজরের ছবি তুলে নিয়ে যাবে।

জাপানের এক সাহসিনী পবর্তারোহী ফু তরিকোর শবদেহ এই বরফের তলাতেই খুঁজে পাওয়া গেল। তার একটি হাতে পরে থাকা সোনার ব্রেসলেটটি তখনও অটুট। ক্যামেরায় ছবি তুলে নিল রিনা। তামাং তাড়া দিল, বরফপাত শুরু হওয়ার আগে বেস ক্যাম্পে ফিরতেই হবে।

বেস ক্যাম্পে সন্ধেবেলা সেলিব্রেশনের খাওয়াদাওয়া সারতে সারতে রিনা রসিকতা করেই বলেছিল, ‘নগেন্দ্রজি, আপনি তো বলেছিলেন, শারীরিক অবস্থার জন্য আমি নাকি শৃঙ্গে পৌঁছোতেই পারব না। কিন্তু আমি পেরেছি!’

নগেন্দ্র রাই উত্তর দেননি।

পরের দিন বরফ ঝড় থামার পরে নীচের দিকে যাত্রা শুরু করল অভিযাত্রী দল। দিল্লিতে পৌঁছোল বারো দিন পরে। প্রশাসনের তরফে স্বাগত জানানোর জন্য কেউ না থাকলেও, পর্বতারোহী সংঘের কর্তারা ছিলেন। সেদিনই নগেন্দ্র রাইয়ের সই করা প্রেস বিজ্ঞিঀ৫ পৌঁছে গেল খবরের কাগজের অফিসে। পরের দিন সকালে বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছেপে বের হল খবরটা, আর সবকটা কাগজ খুঁটিয়ে পড়ে, রিনার চোখের জল যেন কোনও বাধা মানতে চাইল না। খবরে অভিযাত্রী দলের সদস্য হিসাবে বাকি সকলের নাম থাকলেও, কোথাও নাম নেই তার। মনের বেদনা ক্রমে ভয়ানক ক্রোধে বদলে গেল। চোখের জল শুকিয়ে ঠিকরে পড়ল আগুন। রিনার নাম তো নেই-ই, এমনকী তামাংয়ের নাম-ও নেই। রাজনীতিটা বুঝতে অসুবিধা হল না রিনার। তামাং শেষ পর্যায়ের অভিযানের গাইড হলেও, রিনাকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য নগেন্দ্র রাইয়ের কোপে পড়েছে।

পরদিন থেকেই শুরু হল প্রকৃত যন্ত্রণাটা। অফিসে কিংবা পাড়ায়, যারই সঙ্গে দেখা হয়, সে-ই কৗতূহলী হয়ে নানা কথা জানতে চায়। সকলের কাছে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতে ধরতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল রিনা।

পর্যটন সচিবকে চিঠি লিখল। কিন্তু জানতে পারল, সেই চিঠিও সচিবের টেবিলে পৌঁছোয়নি শেষমেশ। নগেন্দ্র রাই-ই যে-এর পিছনে রয়েছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ রইল না রিনার। নানা কারণে কর্তাদের গুডবুকে রয়েছে নগেন্দ্র। ফলে, তার হাতটাও অনেক লম্বা।

কয়েকদিন পরে, অফিসে যেতেই এমডি-র ঘরে ডাক পড়ায় একটু অবাক-ই হয়েছিল সে।

এমডি সামনের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলেছিলেন তাকে। তারপর চশমাটা খুলে কপালে উদ্বেগের রেখা ফুটিয়ে তুলে বলেছিলেন, ‘আপনার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে।’

‘আপনি খবরের কাগজে ছাপা হওয়া খবরটার কথা বলছেন কি স্যার?’

এমডি চশমাটা পরে নিয়ে বলে উঠলেন, ‘না, না, সেসব নয়। তবে পর্যটন দফতর থেকে আপনার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের তদন্ত চালানোর নির্দেশ দিয়ে ফ্যাক্স এসেছে। সঙ্গে আপনাদের টিম লিডারের অভিযোগপত্রের কপি।’

‘কিন্তু স্যার, আমার সঙ্গে কার্যত প্রতারণা করা হয়েছে। আর এর জন্য টিম লিডার নগেন্দ্র রাই-ই দায়ী, রিনা প্রায় মরিয়া হয়েই বলে ওঠে, ‘আমি কামেট শৃঙ্গে উঠেছি। এই দেখুন তার ছবি। অসংখ্য ছবি তুলেছি, দেখুন না…!’

এমডি শান্ত গলায় বললেন, ‘আমি কী করব বলুন তো! আমার তো হাত-পা বাঁধা। আপনি নিজেই বরং পর্যটন সচিবের সঙ্গে দেখা করুন!’

রিনা বুঝল, এখানে কথা বাড়ানো বৃথা। তার অফিস এ ব্যাপারে হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছে। হয়তো খুব শিগগির নানা চার্জে সাসপেনশনের চিঠিও পৌঁছে যাবে তার বাড়িতে।

কিন্তু পর্যটন সচিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য এমডি-র পরামর্শ মাথায় ঘুরছিল তার। ইতিমধ্যে খবরের কাগজগুলিতেও তার সাক্ষাৎকার বের হতে শুরু করেছে। পর্যটন সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় পাওয়াটাও তাই মোটের উপর সহজ হল।

সচিব বললেন, ‘দেখুন ম্যাডাম, নগেন্দ্র রাই তার রিপোর্টে লিখেছেন, আপনি কামেট শিখরে পৌঁছোনইনি। সবচেয়ে বড়ো কথা, ওনার নির্দেশ অমান্য করেছেন।’

‘স্যার, এই ছবিগুলো দেখুন। আর এই ব্রেসলেটটা। এই সবই তো কামেট শৃঙ্গের।’ স্পষ্ট

ভাষায় বলে উঠেছিল রিনা।

সচিব বললেন, ‘কিন্তু, দলের ক্যাপ্টেন যতক্ষণ না সেকথা মানছেন এবং সে ব্যপারে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, আমরা কী করতে পারি বলুন! আপনি বরং নগেন্দ্র রাইয়ের সঙ্গে দেখা করে ক্ষমা চেয়ে নিন। মানে, একটা ‘সরি’ বলা আর কি! সচিব হাসলেন।

শেষপর্যন্ত নগেন্দ্র রাইয়ের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা! মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না রিনা। খবরের কাগজগুলো এসময় ত্রাতা হয়ে দেখা দিল। মনে হচ্ছিল, যুদ্ধটা যেন তার একার নেই, সকলের। রিনার সমর্থনে রীতিমতো জনমত তৈরি হতে থাকল। পর্বতারোহী সংঘের দফতরে আর সরকারের কাছেও, প্রতিবাদীদের স্বাক্ষরের সংগ্রহ পৌঁছোল হাজারে হাজারে। চাপের কাছে মাথা নত করতেই হল কর্তাদের। নগেন্দ্র রাইয়ের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হল। তার পরেরটুকু ইতিহাস। কামেট শৃঙ্গের মতোই, এই যুদ্ধটাও জিতে গেল রিনা।

সেই সংঘর্ষের আর সহনাগরিকদের ভালোবাসার কথা মনে পড়লে আবেগে চোখে জল চলে আসে আজও। সেরকম বিহ্বলতার মধ্যেই যেন অনেক দূর থেকে কেউ ডাক দিল তার নাম ধরে। যেন অনেক উঁচুতে সর্বোচ্চ শিখর থেকে পর্বতে পর্বতে ধাক্বা খেতে খেতে পৌঁছোল সেই স্বর, ‘আমরা রিনাদেবীকে মঞ্চে আসতে অনুরোধ করছি!’

সেই স্বর যেন বাস্তবে ফিরিয়ে আনল রিনাকে। দূরে ঝাপসা একটা মঞ্চ। সারা হল ফেটে পড়ছে করতালিতে।

বিব্রত রিনা, আর-একটা শৃঙ্গজয়ের দিকে এগোল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...