শিলিগুড়ি শহরের জাঁকজমক গাঢ়-শহুরে বাতাবরণ থেকে একটু আধা-শহুরে পরিবেশে বেরিয়ে এলে, পথে পড়বে চামটা নদীর ব্রিজ, সেই ব্রিজ থেকে একটু এগিয়ে বাঁদিকে টার্ন নিলে ছোটো গাড়ি বা অন্য কোনও যানবাহন অনায়াসে মেলে। সেই পথ ধরে এগিয়ে গেলে ঘন জনবসতিপূর্ণ স্থান মাটিগাড়া। বাস, অটো, মিনিডোরে যাতায়াতের মাধ্যমে এখানকার মানুষ অতি সহজেই শিলিগুড়ির সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখে।

এই মাটিগাড়ার প্রতিরাম নামক স্থানের এক গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা প্রমোদ মৈত্র। প্রমোদবাবু তার স্ত্রী ও এক পুত্রকে নিয়ে কালু সমাদ্দারের বাড়িতে ভাড়া থাকেন। মাস গেলে এক-দু তারিখের মধ্যেই ভাড়ার দু’হাজার টাকাটা চকচকে লাল নোটে মিটিয়ে দিতে হয় কালুবাবুকে। না হলে মদ খেয়ে বাড়িতে ঢুকে দাঁড়কাকের মতো উচ্চকণ্ঠে তার মুখ-খিস্তি ও ভাষণ শুরু হয়ে যায়। সেইসঙ্গে ভাড়াটিয়ার ঘরের জিনিসপত্র ছুড়ে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করে না। এই কান্ড-কারখানায় পাড়ার লোক তখন বড়োই অস্বস্তিতে পড়ে। এ নিয়ে পাড়ার লোকজন প্রায়শই বলাবলি করে এই লোকটি যে কি! ওই আবার শুরু হল বোধ হয় পাগল-ছাগলের প্রলাপ!

ভোর থাকতে থাকতেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন প্রমোদবাবু। তিনি তার রুটিন মতো ঘুম থেকে উঠে, ব্রাশ করে, প্রাতঃক্রিয়া সেরে এক ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে বসে পড়েন প্রাণায়াম ও আসনে। এরপর বসেন সিংহাসনে, তখন ওনার গলার আওয়াজে ঘর লাগোয়া প্রতিবেশীরা মাঝেমধ্যেই ভয়ে চমকে ওঠেন। খাটে শোয়া থাকা অবস্থায় আশপাশের অনেককেই মাঝেমধ্যেই বলতে শোনা যায়, ‘ভাড়া বাড়ির দিকের জানালাটা বন্ধ করো! সাত সকালে সিংহের গর্জনে গভীর ঘুমটা আমার ভাঙল।’ কেউ আবার কখনও বলে ‘কাল রাতে দেরি করে শুয়েছি এত তাড়াতাড়ি এখন উঠতে পারব না, জানলাটা বন্ধ করে দাও।‘ এ যেন রোজকার ব্যাপার হয়ে উঠেছে, এরকম নানা অভিযোগ সপ্তাহে তিন চারদিন বলতে গেলে কানে এসেই যায়। কিন্তু তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই প্রমোদবাবুর। উনি ওনার পরিশ্রমকে ঠিক যথারীতিই সার্থক করে তোলেন।

এ পাড়াতেই থাকেন জলধর দত্ত, যিনি খুব ধুরন্ধর ও পাক্বা বিজনেস মাইন্ডেড লোক, যার কাছে এক পয়সাও ফাদার-মাদার। এই জলধর দত্তের দু’নম্বরি, এক-নম্বরি সব বিজনেসই রয়েছে, তবে তাঁর কাছে মূল বিষয়বস্তু কিন্তু টাকাই। তিনি বহু যুবক যুবতিদের চ্যানেল করে লাইন হোটেলের হিসাব রক্ষক, বিউটি পার্লারের কর্মী, মোবাইলের স্টলের স্টাফ, পিৎজা ডেলিভারি বয়, বেসরকারি অফিসের সিকিউরিটি গার্ড, কুরিয়ার অফিসের ডেলিভারি ম্যান –এসব কাজ পাইয়ে দিয়েছেন। তবে বহু লোকের এই কাজের লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ভাগ্য খুব একটা খোলেনি। যারা বেশি টাকা দিয়ে তাকে ফিটিং করতে পেরেছে, শুধুমাত্র তাদেরই এই কাজগুলি হয়েছে। এই তো সেবার এক-দু লাখ করে টাকা নিয়ে আরব কান্ট্রি ও নেপালে কুড়িজনকে কারখানায় মিস্ত্রির কাজ, বেকারির কাজ, গাড়ির ড্রাইভারের কাজ, ফ্যাক্টরির কাজ তিনি পাইয়ে দিয়েছেন। তার জন্য সেখানে যেতে পাসপোর্ট থেকে ভিসা যাই দরকার হয়েছে, সবই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনিই। কিন্তু টাকাটা লেগেছে অনেকই। প্রমোদের কাছ থেকেও চল্লিশ হাজার টাকা খেয়ে তিনি ওনাকে আরব কান্ট্রির এক বড়ো আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে কাজে যুক্ত করিয়েছেন। উনি স্ত্রী ও পুত্রকে এখানে রেখে খুব শীঘ্র রওনা হবেন বলে প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছেন।

সেদিন প্রমোদবাবু জগাই কুণ্ডুর মিষ্টির দোকানে হেমকান্তি দত্তকে বলছিলেন– ভালো আছেন দাদা? জয় গুরু! শুনেছেন তো, আমি এই দু-দিন পরই রওনা হয়ে যাচ্ছি আরবের দিকে।

–হ্যাঁ শুনেছি, আমাকে বলল আমাদের বন্ধু-স্বজন সুজন ভৌমিক।

সেই দিনও দেখতে দেখতে এসে উপস্থিত হয়। সব লাগেজ, বেডিংপত্র গুছিয়ে নিয়ে উনি ওনার স্ত্রী সোমা-কে আলিঙ্গন করে, ছেলে সৌমিত্রকে জড়িয়ে ধরে বলেন– বাবা ভালো মতো পড়াশোনা করিস, তোর মাকে দেখিস। বেরোবার সময় চোখের জল নিয়ে স্ত্রী ও ছেলেকে বলেন– আমি তাহলে আসি! তোমরা ভালো ভাবে থেকো, আমি ফোন করব মাঝেমধ্যে, প্রতিমাসে টাকাও পাঠাব। রামকৃষ্ণ দেব ও স্বামিজির প্রতিকৃতিতে প্রণাম করে জয় ঠাকুর-জয় স্বামিজি বলে কাঁধে বেডিং, হাতে লাগেজ নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন।

প্রমোদবাবুর স্ত্রী খুব কান্নাকাটি করতে থাকেন, সৌমিত্র মাকে জড়িয়ে ধরে বলে– মা শান্ত হও! এখানে তো বাবা কত কাজ খুঁজল, কিন্তু সেরকম তো কোনও ভালো কাজই জুটল না! ঈশ্বরের ওপর ভরসা রাখো, মা.. একটু শান্ত হও।

এরপর ছ-মাস টাকাপয়সা পাঠানোর পাশাপাশি স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে রাতে মাঝেমাঝে ফোনে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথাও বলতেন প্রমোদবাবু। কিন্তু বেশ কিছুদিন হল ওনার ফোন ও মানি অর্ডার কিছুই আসছে না! খুবই ভেঙে পড়েছেন প্রমোদবাবুর স্ত্রী। তিনি ভরা দুপুরবেলা কর্কশ কাকের ডাক শুনলেই চমকে উঠছেন এবং ছেলেকে বলছেন, ‘না না আজ বাইরে যাস না বাবা! কোনও অমঙ্গল খবরই এসে পৌঁছোয় নাকি।’

–মা…তুমি অত বাজে চিন্তা কোরো না তো, হয়তো বাবা কিছুদিনের মধ্যেই টাকা পাঠিয়ে দেবে, কোনও অসুবিধের জন্য হয়তো বাবা টাকা পাঠাতে পারছে না বলে সৌমিত্র সান্ত্বনা দেয় মাকে।

সৌমিত্র পড়াশোনাতে খুব ব্রিলিয়েন্ট, গতবার মাধ্যমিকে স্টার মার্কস পেয়েছে, এবার ওর চিন্তা উচ্চ মাধ্যমিকে কীভাবে খুব ভালো ফল করা যায়। তাই রাত জেগে পড়াশোনা করে। অধিক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যায়। যে করেই হোক তাকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। চোখের নীচে রাতজাগা কালো দাগ দেখলেই বোঝা যায় ওর পড়াশোনার খুব চাপ বেড়েছে।

ছেলের পড়াশোনার খরচা আর সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে সোমাকে। বাজারের জিনিসপত্রের যা দাম! জমানো টাকায় আর কতদিন চলে! তাই অগত্যাই তাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে হয় এখন। মাস খানেক হল এই কাজটা হাতে নিয়েছে। পাশাপাশি নিজের পড়ার খরচা চালাতে সৗমিত্রও আজকাল টিউশনি করতে শুরু করেছে।

ছুটির দুপুরে মা-ছেলে খেতে বসে তাদের সুখ-দুঃখের কথা বলছে। সোমা তার ছেলেকে বলছে,

–দ্যাখ বাবা, কত বড়ো বাড়ির বউ ছিলাম! কিন্তু আজ ভাগ্যের পরিহাসে ওই মৈত্রবাড়ির বউকে পরের বাড়িতে কাজ করে খেতে হচ্ছে!

সোমা মাস গেলে হাতে গোনা হাজার তিনেক টাকা পায়। তার সঙ্গে ছেলে সৌমিত্রর টিউশন পড়িয়ে হাজার দেড়েকের মতো ইনকাম। সব মিলিয়ে মেরেকেটে ওই চার সাড়ে চার হাজার টাকা হবে। আজকালকার এই চড়া বাজার দরে কি সেভাবে চলে? বলতে গেলে বড়ো কষ্টেই দিন কাটে দুজনের!

চার সপ্তাহ পর সেদিন সকালে ছোটো অল্প মাছ কিনে এনেছিল সৌমিত্র, বুল্টিদের বাড়ি থেকে পড়িয়ে ফেরবার সময়। তার খুব ইচ্ছে হয়েছিল মায়ের হাতে মৌরলা মাছের অম্বল খাবে। মা-ও ছেলের মনের মতো করে তা রেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু রাতের খাবারের পাতে সে মাছ সৌমিত্রর মুখে কিছুটা উঠলেও মা-র মুখে সে মাছ ওঠেনি। উঠবে কি করে! ওই অল্প মাছে কি আর দুজনের দুবেলা হয়? সৌমিত্র রাতে ঘুমোবার সময় বিছানায় শুয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলে মা, ‘আমাকে একটা পাঞ্জাবি কিনে দেবে? আমার স্কুলে এর মধ্যে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আছে। বন্ধুরা বলেছে সেদিন নাকি সবাই ওরা পাঞ্জাবি পরবে, আমার তো পাঞ্জাবি নেই তাই বলছিলাম আর কি।’

আচ্ছা দেখব বাবা, মাইনের টাকাটা আগে হাতে পেয়ে নিই তারপর না হয় ভাবা যাবে। এবারের কাজ করে আয় করা মাসের টাকাটা পেয়ে সোমা ছেলেকে পাঞ্জাবি বানিয়ে দেবে বলে একটা কাপড়ের পিস কিনে নিয়ে আসে বাজার থেকে। পাশের বাড়ির সৃজার মায়ের থেকে হাত সেলাইয়ের মেশিনটা চেয়ে নিয়ে এসে ওইদিন রাত থেকেই শুরু করে দেন ছেলের পাঞ্জাবি তৈরির কাজ। কাজ থেকে বাড়ি ফিরে, রান্নাবান্না সেরে নিয়ে সেদিন রাতেই বসে যান পাঞ্জাবি তৈরি করতে।

সৌমিত্র পড়তে পড়তে মাকে বলে– মা শুয়ে পড়ো এবার, অনেক রাত হল তো! তোমার আবার শরীর খারাপ করবে! তাছাড়া তোমাকে তো আবার ভোর থাকতেই উঠতে হবে। পড়তে পড়তে টেবিলের বইয়ের ওপর মাথা রেখে সৌমিত্র ঘুমিয়ে পড়ে।

সোমা ছেলের চোখ থেকে চশমাটা খুলে রেখে তুলে রাখে বইয়ের তাকে। তিন দিন পরেই ছেলের স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান। তাই রাত-দিন এক করে তৈরি করে ফেলেন আকাশি রঙের সুন্দর একখানা পাঞ্জাবি।

সৌমিত্র স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানের বিতর্ক সভায় প্রথম স্থান অধিকার করে। বিতর্ক সভার বিষয়বস্তু ছিল –জনসংযোগ ও বইয়ের প্রয়োজনীয়তা। পুরস্কার পেয়ে আনন্দে লাফাতে লাফাতে বাড়িতে এসে বলে– মা আমি প্রথম হয়েছি বিতর্ক সভায়। উঃ কি আনন্দ! এই দ্যাখো পুরস্কার।

মা আদর করে বলে, –আমার সোনা বাবা, তুই এবার ভালো করে পরীক্ষাটাও দে। আমি জানি, চেষ্টা করলে তুই তাতেও ভালো ফল করবি।

মা তুমি মুখটা একটু খোলো তো। স্কুল থেকে অনুষ্ঠানে

অংশগ্রহণকারীদের একটা বড়ো মিষ্টির প্যাকেট দিয়েছে।

–তুই খেলেই তো হতো, আবার আমাকে…।

মাকে জড়িয়ে ধরে–মা আমার দ্বিতীয় জন্ম যদি হয় তোমার গর্ভেই যেন হয়, তোমার কোলেই মাথা রেখে যেন আমি শান্তিতে ঘুমোতে পারি। আচ্ছা মা, বাবা না জানি এখন একা একা সেখানে কী করছে তাই না?

দেয়ালে টাঙানো নিজে, স্বামী এবং ছেলের একসাথে তোলা একটা পারিবারিক ফটোর দিকে তাকিয়ে বলেন– এই ভরা সন্ধেবেলায় কী আবার করছে? সেখানে দ্যাখগে সঙ্গীসাথিদের সাথে দাবা নয়তো তাস খেলায় মত্ত।

হ্যাঁরে সমু, তোর বাবার জন্য মনটা আনচান করে না! সেখানে একা একা দুবেলা যে কী রেঁধে খাচ্ছে! শরীরটাই বা কেমন আছে! সুগারটা আয়ত্তে আছে কিনা! খুব চিন্তা হয়রে…। আচ্ছা সমু এত দিন হয়ে গেল তোর বাবার ফোন কেন আসছে না রে? এতগুলো সপ্তাহ পার হয়ে গেল। দেখিস তো তোর ছোটো ফোনটা দিয়ে ফোন করা যায় কিনা।

মা… ওই ফোনের সিম কার্ডটা রিচার্জ করতে হবে, তারপর সেখানে কল করা যাবে। ঠিক আছে মা, আমি এ মাসে টিউশনের টাকাটা পেলে সিমটা রিচার্জ করিয়ে নেব। তুমি মন খারাপ কোরো না, কেঁদো না।

এক একটি দিন চলে যেতে থাকে দুচোখের নীরব অশ্রুবন্যায়। বিবাহিত জীবনের কষ্টকর এতগুলি বছর, সেই বর্ষণমুখর রাতের কাহিনি, সন্তানের জন্মলগ্ন এবং অর্ধাহারে থাকা দুর্বিষহ ঝোড়ো হাওয়ার রাতগুলি সোমাকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করতে থাকে। এক স্বামী, এক পিতার দূর হয়ে যাওয়া সেই ভালোবাসা যেন এক স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিমেষে ভালোবাসা শূন্যতার শামিয়ানায় আস্তরিত করতে থাকে।

সৌমিত্র সেদিন ওর মাকে বলছিল– মা বহুদিন থেকে তুমি কিছু খেতে পারছ না। যা খাচ্ছ সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস ফর্ম করছে তোমার, চলো কাল তোমাকে শিলিগুড়িতে একজন ডাক্তার দেখিয়ে আনি।

–নারে বাবা, আমি ঠিকই আছি, ওটা হয়েই থাকে। বরং আমাকে দু-পাতা ভালো অ্যান্টাসিড এনে দিস, তাতেই আমি ভালো থাকি।

এর ঠিক পরের দিন সোমা কাপড় গোছাচ্ছে, এমন সময় সৌমিত্রর স্কুলের দুজন বন্ধু দৗড়োতে দৗড়োতে এসে বলল– কাকিমা সৌমিত্র মাথা ঘুরে স্কুলের ক্লাসরুমে পড়ে গেছে। গোপাল স্যার আর তমাল স্যার ওকে নিয়ে গিয়েছে শিলিগুড়ি হসপিটালে।

–একি অলক্ষুনে কথা বলছিস তোরা! হায় ঈশ্বর! আবার কোন নতুন বিপদ হল আমার! জয় ঠাকুর, জয় ঠাকুর… কোনও রকমে শাড়িটা পরে, ব্যাগে সম্বল টাকাটুকু নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সোমা। পথে জ্যাম! হসপিটালে এক ঘন্টা দেরিতে পৌঁছোন। গিয়ে দেখেন ছেলে জেনারেল বেডে শুয়ে আছে, মাথায় ব্যান্ডেজ।

ডাক্তার কৃষ্ণেন্দু সেনগু৫ রাউন্ড থেকে এসে ওনাকে বলেন–জখম খুবই সামান্য, কিন্তু একটি কথা বলুন তো এই ঘটনা কি ওর প্রথম বার? নাকি এর আগেও এরকম ঘটেছে?

সোমা বলে– ডাক্তারবাবু আমার যতদূর মনে পড়ছে, যখন ও ক্লাস এইটে পড়ে তখন একবার পিকনিকে গিয়ে বাসের দরজা থেকে মাথা ঘুরে বাইরে পড়ে গিয়েছিল।

ব্যাপারটা কিন্তু আমার ভালো ঠেকছে না, এই ব্লাড টেস্টগুলো আজকেই কোনও প্যাথোলজি থেকে তাড়াতাড়ি করিয়ে নিন, সন্ধেবেলায় আমি রিপোর্ট দেখব, বলে ডাক্তারবাবু বেরিয়ে গেলেন।

ডাক্তারের পরামর্শ মতো সোমা এক প্যাথোলজি সেন্টার থেকে তাড়িতাড়ি ব্লাড টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে সন্ধেবেলায় হাসপাতালে হাজির হল।

রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন– ইয়েস আই অ্যাম কারেক্ট। যেটা সন্দেহ করেছিলাম সেটাই। ওর লিউকোমিয়া পজিটিভ, ভালো হবার সম্ভাবনা খুবই কম!

ডাক্তারের মুখে এই কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে সোমা। ডাক্তারবাবুকে বলেন, ‘ডাক্তারবাবু ওকে কি আমি আজ বাড়ি নিয়ে যেতে পারি?’

ডাক্তারবাবু বলেন– নিয়ে যান তবে প্রত্যেক মাসে ওর

চেক-আপটা খুবই জরুরী। এটা মাথায় রাখবেন!

এই মায়ের কাছে জীবনের সব উত্তর-প্রত্যুত্তর যেন এক নিমেষে বিলীন হয়ে যায়। অভাব তাড়া করে তাকে মানুষের ভিড়ে, দুচোখের জল নিত্যসঙ্গী হয়ে ওঠে এই অভাগিনী মায়ের। খুদে ইচ্ছেগুলো পিশে মরে যায় ব্যথার তাড়নায়। সেই মাকেই নিজের সম্মান বজায় রাখার সামাজিকতা ছারখার করে দেয় এক নিমেষে। সোমা জীবনযুদ্ধে পরাস্ত হতে থাকে ছেলের জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে। ছেলের প্রাণ রক্ষার্থে নিজের সম্মান বিক্রি করার কথা চিন্তা করলেও কোথায় যেন আটকে যায় সোমা।

একদিকে তার একমাত্র ছেলের জীবন আর অন্যদিকে সমাজ-সংসার লোকলজ্জার ভয়, তাকে কুরে কুরে খায়। এই কঠিন পরীক্ষায় দগ্ধ হতে থাকে সোমা। না, অন্যের কাছে নিজের সতীত্ব সেদিন নষ্ট করতে পারেনি, এক একটি জ্বালাময় রাত্রি খুন করেছে তার জীবনের মায়া। সোমা দাঁড়িয়েছে ছেলের জীবন-ভিক্ষুক হয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে। কিন্তু কই! কেউ তো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। দেখা মেলেনি মানবরূপী কোনও মহাপুরুষের! বরং তার মধ্যে পেয়েছে বাড়ির মালিকের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা কিছু যন্ত্রণাদায়ক বাক্যশূল।

মদ খেয়ে এক রাতে বাড়িভাড়া চাইতে এসে কালু সমাদ্দার অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে বলে, এতদিন তো বাড়িতে মা-ব্যাটা মিলে দুজন থেকেছেন! দু-মাসের ভাড়া বাকি পড়ে গেছে। অনেক হয়েছে, আমি আর কোনও কথা শুনব না। কিছু বুঝতেও চাইছি না। ভাড়া মিটিয়ে দিলে থাকবেন, নয়তো আমার অন্য ভাড়া রেডি।

–কোথায় যাব? কী করে যাব এই অবস্থায়? ছেলের মারণ রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হসপিটালে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। একটু দয়া করুন, আর একটু সময় দিন, আপনার পায়ে পড়ি!

কালু বলে, কী! ক্যানসার হইছে? বলেন নাই তো, এই কর্কট রুগিকে এখানে রাখা যাবে না। আমার বাড়ির অন্য মানুষজন ইনফেক্টেড হয়ে যাবে।

সোমা বলে, দাঁড়ান, ঠাকুরের লক্ষীঘটে কিছু খুচরো পয়সা রেখেছিলাম নিয়ে আসছি।

হু…উ খুচরো পয়সা? সমাদ্দারকে আপনি খুচরো পয়সা দেখাচ্ছেন! আমার সঙ্গে মসকরা করছেন। টাকা না দিতে পারলে তিন দিনের মধ্যে ঘর ছেড়ে দেবেন, বলে গেলুম। একদম চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। লোক ডাকাডাকি করবেন না, তাহলে পুলিশ কেস দিয়ে দেব।

এদিকে সৌমিত্র-র শারীরিক অবস্থা দিন কে দিন খারাপ হতে থাকে। অহরহ জ্বর, মাথা ঘোরা, বমি, দুর্বলতা কিছুই বাকি থাকে না।

ডাক্তার বলেছে, ওর শরীরের অস্থি-মজ্জা পরিবর্তন করতে হবে। সে তো অনেক টাকার ব্যাপার। অত টাকা পাবে কোথায় সোমা? দুঃশ্চিন্তা গ্রাস করতে থাকে তাকে।

কালু সমাদ্দারের দেওয়া সময় পার হয়ে যায়। বাড়ি ভাড়া দিতে না পারায় দুদিন পর এক বর্ষণ মুখর সন্ধ্যায় অসুস্থ ছেলেকে সঙ্গে করে সোমা ব্যাগ-পত্তর নিয়ে বেরিয়ে পড়ে এক অজানা ঠিকানায়। পায়ে হেঁটেই চলতে থাকে তারা। আকাশে বিদ্যুত চমকাচ্ছে ঘনঘন সেইসঙ্গে মেঘের গর্জন। হঠাৎ এক গর্জনের ভীষণ শব্দে সৗমিত্র রাস্তায় পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারায়। সঙ্গে সঙ্গেই আশপাশের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ছেলেকে টানতে টানতে একটু মাথা গোঁজার মতো এক আস্তানায় পৌঁছোয় তারা। মিনিট দশেক পরে সেখানকার দুটি ফিলামেন্ট লাইট টিমটিম আলোয় জ্বলে ওঠে। সেই আলোয় সোমা দেখে, এটা তো একটা শ্মশান! যেখানে মানুষকে শেষ বিদায় দেওয়া হয়। মৃত মানুষের শেষ ঠিকানা।

ঠিক এমন সময় বলো হরি হরি বোল, বলো হরি হরি বোল ধবনি ভেসে আসতে থাকে পেছন থেকে। মনে হচ্ছে কারা যেন তার সন্তানকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতেই এগিয়ে আসছে। মা তার সন্তানকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে আগলাবার চেষ্টা করে। পাথরের মতো চোয়াল শক্ত হয়ে যায় সোমার। অজানা আশঙ্কায় তার চোখ-মুখ অন্ধকারে ঢেকে যায়।

কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখেন, না তারা দুটি মৃতদেহ নিয়ে এই নির্জন শ্মশানে এসেছে। মৃতদেহের সাথে লোকজন খুবই কম। হাতে গোনা মাত্র এসেছে আটজন। বোধ হয় বৃষ্টির জন্যই এই অবস্থা!

রাতভর ছেলেকে বুকে আগলে ধরে সোমা শ্মশানে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে দেখে, মৃতদেহ দুটির সৎকার হয়ে গেছে। সৎকার করতে আসা লোকজনও চলে গিয়েছে। শ্মশান নিস্তব্ধ, চারিদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক, সেখানে শুধু এক মা। আর তার সদ্যমৃত ছেলে।

সব খেলা শেষ! সোমা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, কখন তার আদরের ছেলে সব মায়া-বন্ধন কাটিয়ে চির বিদায় নিয়েছে। তাকিয়ে দেখে চিতায় দেবার মতো কিছু কাঠ তখনও অবশিষ্ট আছে। আগের জ্বালানো চিতার কাঠ তখনও নদীর ধারে জ্বলছে।

সোমা নিজেই চিতা সাজায়। চিতার জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে এসে সেই আগুন নিজ সন্তানের চিতায় দেয়। বহুক্ষণ চেষ্টার পর দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে চিতা। সৌমিত্র-র দেহ জ্বলতে থাকে, দেহ পুড়ে যেতে থাকে সেই আগুনে আর সেই সঙ্গে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় সেই মায়ের জীবনের সব কিছু। সেই মুহূর্তে একাকী শ্মশানে দাঁড়িয়ে তার মনে হয় তাদের দেহ, মন, ইচ্ছাগুলোকে এক শ্রেণির মানুষ যেন পিষে মেরে ছাইয়ের গাদার মতো শ্মশানে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।

অভাগি মা আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে কেঁদে ওঠে– হায় ঈশ্বর! এই জীবন রেখে আমি আর কী করব? একমাত্র সহায়-সম্বল ছেলে আজ আমায় ছেড়ে চিরতরে চলে গেল, স্বামীও আমার কাছে নেই, জানি না উনি কেমন আছেন? আদৗ আছেন কিনা! সব হারালাম, আমার সব আশা-আকাঙক্ষাগুলো আমার এই সন্তানের জন্যই গুছিয়ে রেখেছিলাম তিলে তিলে। আজ আমিও নিজেকে শেষ করে দেব। এই সমাজকে শিক্ষা দিয়ে যাব ছেলের চিতায় আমার এই রক্তমাংসের শরীর বিসর্জন দিয়ে।

—–                           

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...