শপিং করতে গিয়ে অনেক সময়ে নজরে আসে মা-বাবার সঙ্গে আসা বাচ্চারা, কোনও কিছু কিনে দেওয়ার জন্য অথবা চিপ্স, কোল্ড ড্রিংক অথবা কোনও ফাস্ট ফুড খাওয়ার জন্য এতটাই জেদ করতে থাকে যে, তাদের মা-বাবাকে সমস্ত লোকের সামনে রীতিমতো লজ্জায় পড়তে হয়। জেদ মাঝেমধ্যে এমন পর্যায় পৌঁছোয় যে, বাচ্চা চ্যাঁচামেচি করতে করতেই জেদ বজায় রাখতে রাস্তাতে শুয়ে পড়তেও দ্বিধাবোধ করে না।

অনেক সময় খিদে পেলে অথবা ঘুম পুরো না হলেও বাচ্চা ঠিকমতো অসুবিধাটা বোঝাতে পারে না। চ্যাঁচামেচি  করে বা জেদ দেখিয়ে অসুবিধাটা অন্য ভাবে প্রকাশ করতে চেষ্টা করে।

বাচ্চাদের অযথা এই ধরনের টেম্পারামেন্ট এবং ট্যানট্রাম অভিভাবকদের চিন্তা, অবসাদ, ফ্রাস্ট্রেশনের কারণ হয়ে ওঠে। বাচ্চাদের জেদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া বড়োদের জন্য বেশিরভাগ সময়েই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

রাগের বহিঃপ্রকাশ, জেদ প্রকাশ করার নানা উপায় বাচ্চা নিজেই বার করে। রাগ দেখিয়ে, কেঁদে, চ্যাঁচামেচি করে, জিনিসপত্র ছুড়ে, ভেঙে, মাটিতে শুয়ে পড়ে, এমনকী বড়োদের গায়ে হাত তুলেও নিজেদের জেদ মেনে নেওয়ার জন্য বড়োদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। এই ক্ষেত্রে বাচ্চাদের বমি করতে দেখা যায়, নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখতে, এমনকী অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্তও বহু রয়েছে। এই সবই, জেদ বজায় রাখার জন্যই বাচ্চারা সাধারণত করে থাকে।

সাধারণত ১ থেকে ৪-৫ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের মধ্যে ট্যানট্রামের সমস্যা বেশি দেখা যায়। এই বয়সে বাচ্চাদের মধ্যে সোশ্যাল এবং ইমোশনাল স্কিল্স ডেভেলপ হওয়া শুরু হয়ে যায় অথচ নিজেদের ইমোশন এক্সপ্রেস করার মতো মাধ্যম ওদের কাছে তখনও অজানা থাকে। সেই সময় বড়োদের থেকে স্বাধীনতা কাম্য হলেও বাচ্চারা অভিভাবকদের ছত্রছায়া থেকে দূরে যেতেও ভয় পায়। এই অবস্থায় বাচ্চারা চায়, বড়োরা ওদের কথা শুনে চলুক, ওদের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাক যাতে তারা নিজেদের ইচ্ছে বড়োদের উপর সহজে চাপাতে পারে।

বাচ্চাদের জেদ করার প্রধান কারণ

টেম্পারামেন্ট – যে-বাচ্চারা খুব সামান্য কারণে আপসেট হয়ে পড়ে তাদেরই বেশি জেদ দেখাবার প্রবণতা থাকে।

স্ট্রেস – একাকিত্ব, খিদে, ক্লান্তি ইত্যাদি ইমোশন বাচ্চারা ঠিকমতো হ্যান্ডেল করতে পারে না। ফলে জেদ দেখিয়ে ওই অভাবটা পূরণ করে নেওয়ার চেষ্টা করে। এছাড়াও কেউ ওদের পছন্দের খেলনা জোর করে কেড়ে নিলে কিংবা ওদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে কোথাও নিয়ে যাওয়া হলে, ওদের প্রতিবাদ জানাবার ভাষা হল জেদ।

স্ট্রং ইমোশনস ভয়, চিন্তা, রাগ, শক ইত্যাদি। জেদ করাটা বাচ্চাদের বিকাশ প্রক্রিয়ার একটা স্বাভাবিক অংশ। এটা কিছুতেই অ্যাভয়েড করা সম্ভব নয়। কিন্তু চেষ্টা করলে বাচ্চার জেদ অবশ্যই কম করা যেতে পারে। প্রত্যেক বাচ্চার স্বভাবই একে অপরের থেকে আলাদা। সুতরাং একজন বাচ্চার জেদ কম করবার জন্য যে উপায় নেওয়া হবে, সেটা অন্য বাচ্চার উপর কার্যকরী নাও হতে পারে।

বাচ্চার এই সমস্যা দূর করার কয়েকটি উপায়

বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখুন – বাচ্চা যদি একাকিত্ব অনুভব করে বা বোর ফিল করে, তাহলে নিজের বিরক্তি এবং খিটখিটে মেজাজ কোনও ভাবে বাইরে প্রকাশ করবেই এবং কোনও কারণ ছাড়াই কান্নাকাটি, চ্যাঁচামেচি করে সকলকে নাজেহাল করে ছাড়বে। তাই বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখুন। নানারকম মজাদার অ্যাক্টিভিটি করান বাচ্চাকে, অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করার সুযোগ করে দিন। এতে বাচ্চার জেদ অনেকটাই কন্ট্রোল করা যাবে।

জেদের কারণ বোঝার চেষ্টা করুন – বাচ্চা যখন কিছু নিয়ে জেদ করবে এবং সেটা না পাওয়া বা না হওয়া পর্যন্ত  জেদ দেখাতেই থাকবে, তৎক্ষণাৎ চেষ্টা করুন বুঝতে যে বাচ্চাটির, কথা না শোনার পিছনে কী কারণ রয়েছে। যদি জেদের মাত্রা বাড়াবাড়ির পর্যায় চলে যায় তাহলে সেই মুহূর্তে বাচ্চাকে কিছু না বলাই বাঞ্ছনীয়।

বাচ্চা কোনও জিনিস চাওয়া নিয়ে জেদ করতে থাকলে মুখের উপর ‘না’ বলে না দিয়ে বরং কেন জিনিসটি আপনি দিতে চান না তার কারণ বিস্তারিত ভাবে বাচ্চাকে বুঝিয়ে বলুন। এতে বাচ্চা কারণটি সম্পর্কে জানতেও পারবে আবার তার ইগো-ও আঘাত পাবে না।

দীর্ঘ শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে বলুন – বাচ্চা জেদ দেখানো শুরু করলে সঙ্গে সঙ্গে ওর সঙ্গে একটি ব্যায়াম করা শুরু করুন। আপনার পাশে বসিয়ে ওকে দীর্ঘ শ্বাস নিতে বলুন। এতে ইমোশনাল রিয়্যাকশনের প্রভাব অনেকটাই কমে যায়। বাচ্চা যদি এই ব্যায়াম করতে অস্বীকার করে তাহলে আপনি নিজেই এটা ট্রাই করে দেখুন। ডিপ ব্রিদিং আপনার নিজের ইমোশনকে কন্ট্রোল করতে সাহায্য করবে। এতে আপনার স্ট্রেস-ও কম হবে।

শাস্তি দেবেন না – বড়োরা সবথেকে বড়ো ভুল করেন, বাচ্চা জেদ দেখালে তাকে শাস্তি দিয়ে। এতে বরং বাচ্চা আরও বেশি জেদি হয়ে পড়ে। অভিভাবকেরা এই ক্ষেত্রে ভেবে নেন, তাদের বাচ্চার মধ্যেই কোনও অসঙ্গতি রয়েছে যার জন্য বাচ্চা জেদী হয়ে যাচ্ছে অথবা মনে করেন নিজেরাই বাচ্চার ঠিকমতো প্রতিপালনে অক্ষম এবং সেই কারণেই বাচ্চার স্বভাব বিগড়ে যাচ্ছে। আসলে এসব কোনও কারণই নয়। বাচ্চা মানুষ করতে ধৈর্যের প্রয়োজন। নিজেকে শান্ত রাখা খুব দরকার এবং প্রয়োজনে বড়োদের নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে সঠিক রাস্তা বেছে সেইমতো বাচ্চাকে শিক্ষা দিতে হবে।

শান্ত করার চেষ্টা করবেন না – বাচ্চা যখন জেদ করতে থাকে, তাকে সম্পূর্ণ ইগনোর করা উচিত যতক্ষণ না সে নিজের কোনও ক্ষতি করবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাচ্চাকে ছেড়ে ঘর থেকে বাইরেও বেরিয়ে আসতে পারেন। যদি বাচ্চা রাগের মাথায় কাউকে মারা (গায়ে হাত তোলা) কামড়ানো, লাথি মারা ইত্যাদি করতে থাকে বা জিনিসপত্র ছুড়ে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে– তাহলে বাচ্চাকে তৎক্ষণাৎ ওই জায়গা থেকে অন্যত্র সরিয়ে দিন। বাচ্চাকে বুঝতে দিন ওর এই অত্যাচার করা বা জিনিস ছুড়ে ভেঙে ফেলার মতো ব্যবহার কিছুতেই বরদাস্ত করা হবে না। যতটা সম্ভব হয় ততক্ষণ পর্যন্ত নিজের কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। এতে বাচ্চাটি বুঝতে পারবে এই ধরনের জেদ দেখিয়ে ও কারও মন জয় করতে পারবে না, কেউ ওকে সমর্থন করবে না।

তবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, বাচ্চাকে কখনও কখনও নিজের রাগ বাইরে প্রকাশ করতে দেওয়া উচিত। এর ফলে ভিতরের ফিলিংস বাইরে বেরিয়ে এসে বাচ্চাকে অবসাদমুক্ত রাখতে সাহায্য করে।

বাচ্চার প্রতি নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করুন – কখনও কখনও বাচ্চা যখন জেদবশত ট্যানট্রাম দেখাতে থাকে তখন কিছু না বলে বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে নিজের বুকে টেনে নিন এতে বাচ্চা নিজেকে সুরক্ষিত মনে করবে। আপনার ভালোবাসা পেলে ও বুঝতে পারবে আপনি বাচ্চার ভালো-মন্দ বিষয়ে কেয়ার করেন। ক্লান্তি এবং খিদে সাধারণত বাচ্চার জেদ বাড়ায়। তাই সব সময় খেয়াল রাখা দরকার বাচ্চা যেন অভুক্ত না থাকে এবং ঠিকমতো যেন তার ঘুম হয়। সময় নিয়ে দুধ এবং জল খাওয়ান এবং বাচ্চার কমফর্ট-এর সবসময় খেয়াল রাখুন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...