প্রায় তিনমাস হতে চলল সমীরণের সিয়াটেল আসার। দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছে। এটাই তো সমীরণ বরাবর চেয়ে এসেছিল। মা-বাবা দুজনেই ডাক্তার। বাড়িতে সবথেকে ছোটো ও। ছোটো থেকেই মেধাবী। দিল্লি আইআইটি থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেই মাইক্রোসফ্ট-এর নতুন এই চাকরিটা ও পেয়ে যায়। স্কুলে থাকতেই টিভি-তে আমেরিকান সিরিয়াল এবং ফিলমগুলো দেখতে ও পছন্দ করত। আমেরিকা সম্পর্কে জানার আগ্রহ ওর মধ্যে যতটা ছিল ততটা বোধহয় নিজের দেশ নিয়ে ছিল না। স্বপ্ন দেখত আমেরিকা যাওয়ার এবং শেষমেশ পৌঁছেও গেল চাকরির সুবাদে। সিয়াটেলের সৗন্দর্যে সমীরণ একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। চারিদিকে সবুজের সমারোহ, যতদূর চোখ যায় পরিষ্কার নীল আকাশ, বড়ো বড়ো লেক, সমুদ্র, পাহাড়। প্রকৃতি যেন নিজের সবটুকু সৗন্দর্য উজাড় করে দিয়েছে শহরটাকে সাজিয়ে তুলতে। সমীরণের দেখেও আশ মিটত না। সারাটা সপ্তাহ কাজে ডুবে থাকত আর উইকএন্ড-এ বেড়াতে বেরিয়ে পড়ত ও। কখনও গ্রিন লেক পার্ক তো কখনও লেক ওয়াশিংটন, মাউন্ট বেকার, কাসকেড রেঞ্জ, স্নোকোয়ালমি ফল্স আরও কত কী।

সমস্ত দেশের খাবারেরও অঢেল দোকান সারা শহর জুড়ে। সমীরণ এমনিতেই খাদ্যরসিক, তার ওপর দুপা এগোলেই একটা করে খাবারের দোকান। সুতরাং কখনও চিজ ফ্যাক্টরি, কখনও অলিভ গার্ডেন আবার কখনও বা কাবাব প্যালেস-এর মতো রেস্তোরাঁগুলোতে ও মোটামুটি চেনা মুখ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

মাইক্রোসফ্ট কোম্পানির হেড কোয়ার্টার যেহেতু সিয়াটেল-এর কাছেই রেডমন্ডে ছিল, সমীরণ কাছেই একটি ওয়ান বেডরুম অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে থাকত। মাইক্রোসফ্ট-এ কাজের সুবাদে বিভিন্ন দেশের এবং বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থান সেখানে। নানা বর্ণের মানুষেরও আনাগোনা লেগে থাকত জাগয়গাটায়।

সমীরণের অফিসে ভারতীয় প্রচুর ছিল। দক্ষিণ ভারতীয় বেশি তবে ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকেও বহু ভারতীয় এখানে কাজ করতেন। চেনা জানা না থাকলেও হাসিমুখে একে অপরকে অভিবাদন জানানো এখানকার একটা পরম্পরা ছিল।

ট্রেনিং শেষ হতেই সমীরণ প্রোজেক্টের দায়িত্ব পেল। পাঁচজনের একটা টিম। একজন দক্ষিণ ভারতীয়, দু’জন বিদেশি এবং একটি মেয়ে। মেয়েটি সম্ভবত আমেরিকান, নাম ‘এমন’। প্রথম দেখাতেই সমীরণ মেয়েটির স্বভাব এবং সৗন্দর্যে প্রভাবিত হয়। মেয়েটি তন্বী, লম্বা, একমাথা কোঁকড়ানো চুল, চোখের রং নীল। আমেরিকান অ্যাক্সেন্টে কথা বলে, কথাবার্তা এবং পোশাক-আশাক অত্যন্ত শালীন-মার্জিত। অফিসে সকলেই ওকে ‘এমি’ সম্বোধন করত।

একসঙ্গে কাজ করতে করতে সমীরণও বুঝতে পারে এমি নিজের কাজে অত্যন্ত দক্ষ এবং বুদ্ধিমতীও বটে। ফলে ওদের পাঁচজনের টিমে স্বাভাবিক ভাবেই একটা সহূদয়তা গড়ে ওঠে সকলের মধ্যে।

একদিন দুপুরে সমীরণ এমিকে একসাথে লাঞ্চ খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। এমি রাজি হয়ে গেল। কোম্পানির ক্যান্টিনে সমীরণ একটা বার্গার অর্ডার দিল আর এমি স্যালাড। সমীরণ লক্ষ করেছিল এমি দুপুরে হালকা খেতেই পছন্দ করে। গল্প করতে করতে সমীরণ প্রশ্ন করল, ‘এখানে ভালো খাবার কোথায় পাওয়া যায়?’

‘আই লাইক কাবাব প্যালেস’, এমির উত্তর।

সমীরণ আশ্চর্য হল। এমি আমেরিকান অথচ ওর পছন্দ ভারতীয় খাবার। কৗতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, ‘ইন্ডিয়ান খাবার তোমার ভালো লাগে?’

‘ইয়েস, ইন্ডিয়ান অ্যান্ড পাকিস্তানি কুইজিনস্ আর অলমোস্ট অ্যালাইক। আই লভ্ দেম বোথ।’ সমীরণ একটু আশ্চর্য হল। অনেকদিন ধরে যে-প্রশ্নটা ওর মাথায় ঘুরছিল সেটা ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘এমি, তোমার ন্যাশনালিটি কি? তুমি কী আমেরিকান?’

সমীরনের প্রশ্ন শুনে এমি হেসে ফেলল, ‘হ্যাঁ, আমি আমেরিকান। ১৯৬০ সালে আমার ঠাকুরদা পাকিস্তান থেকে আমেরিকায় এসে এখানকার ন্যাশনালিটি গ্রহণ করেন।’

এমিকে দেখে কারও পক্ষেই বলা সম্ভব ছিল না যে ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী। ধর্মের কোনওরকম গোঁড়ামি ওর মধ্যে ছিল না। এমিকে দেখে সমীরণের মুক্ত আকাশে ওড়া বিহঙ্গের কথাই মনে পড়ত। ধীরে ধীরে দুজনেই একে অপরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে শুরু করে। এতদিন সমীরণ সারা সপ্তাহের কাজের পর একাই উইক এন্ডগুলোতে ঘুরে বেড়াত, এখন এমি ওর সঙ্গী হল। এমি ওকে আরও নতুন নতুন জায়গায় নিয়ে যেত। সারাদিন ঘুরে ঘুরে বেড়াত, কখনও সমুদ্রতটে হাত ধরাধরি করে বসে থেকে প্রকৃতিকে উপভোগ করার চেষ্টা করত। কখনও আবার এমির পছন্দের রেস্তোরাঁগুলোতে গিয়ে নানা ধরনের কুইজিনের স্বাদ গ্রহণ করত।

এরই ফাঁকে ফাঁকে গল্প করতে করতে দুজনেই একে অপরের সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারল। এমির ঠাকুরদার পরিবার ১৯৪৭ সালে লখনউ ছেড়ে ভারত থেকে করাচি চলে যায়। এমির ঠাকুরমা লখনউ-র মেয়ে ছিলেন। ওনার আত্মীয়রা এখনও লখনউ-তে রয়েছেন আর ঠাকুরদার পরিবার ১৯৬০ সালে নিউইয়র্ক চলে আসে তখন এমির বাবা আর জেঠু দুজনেই ছোটো।

আমেরিকার উন্মুক্ত বাতাসেও এমির ঠাকুরদা দুই সন্তানকে নিজের সংস্কৃতির শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। অনুশাসনের গন্ডিতে বেঁধে রাখেন যাতে খোলা হাওয়ায় যত্রতত্র তারা ভেসে বেড়াতে না পারে। বড়ো সন্তানের প্রতি শাসন বেশি করার ফলে এমির জ্যাঠামশাই অল্প বয়সেই ধার্মিক পথ অবলম্বন করে মৌলবি হয়ে যান। এখনও তিনি নিউইয়র্কেই থাকেন।

এমির জ্যাঠামশাইকে কট্টর ধর্মাবলম্বী হয়ে উঠতে দেখে এমির ঠাকুরদা ছোটো ছেলেকে অর্থাৎ এমির বাবার উপর অতটা শাসন চাপাবার সাহস করেননি। এমির বাবা ইকোনমিক্সের প্রফেসর এবং তিনি নিজের আমেরিকান সহপাঠিনীকে পরবর্তী কালে বিয়ে করেন। ‘ন্যান্সি’ নাম ও ধর্ম পরিবর্তন করে ‘নার্গিস’ নাম নেন এবং মুসলিম পরিবারের আদর্শ বউমা হয়ে ওঠেন। এমির ঠাকুরদা আজ আর বেঁচে নেই কিন্তু ঠাকুমা আজও জীবিত এবং এমির পরিবার অত্যন্ত সুখী পরিবার।

এমি বড়ো হয়ে ওঠে আমেরিকা ও ভারতীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণে। বাড়িতে উর্দু ভাষায় কথা বলার চলন ছিল। এমি উর্দু ভালো মতোই জানত কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলতেই ও বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করত। নানা বিষয়ের উপর এমির দক্ষতা ও জ্ঞান সমীরণকে মুগ্ধ করত। সমীরণ বেশ বুঝতে পারত ওর নিজের মনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে এমি। কিন্তু মনের ভিতর চলতে থাকা দ্বন্দ্বটাও সমীরণ অস্বীকার করতে পারত না –এই সম্পর্কের পরিণাম কী? হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের মানুষরা কী চোখে দেখবেন এই বন্ধুত্বের গভীরতাকে, বিশেষ করে দুটি ভিন্ন দেশের ধর্মাবলম্বী দুটি মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা প্রেমকে?

ছয় মাসের বেশি হয়ে গিয়েছিল দুজনের পরিচয়ের। এর মধ্যেই সমীরণ আর এমি একে অপরকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। নিজের বাড়ির সকলের সঙ্গে পরিচয় করাবার জন্য এমি সমীরণকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করল। অফিসের কলিগ এবং বন্ধু হিসেবেই বাড়ির সকলের সঙ্গে সমীরণের পরিচয় করিয়ে দিল। এমির ঠাকুমাকে দেখে সমীরণের নিজের ঠাকুমার কথা মনে হল। এমির বাবা প্রফেসর হলেও অত্যন্ত হাসিখুশি একজন মানুষ। সমীরণের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগল না। তার ওপর আবার দুজনেই ফুটবলপ্রেমী। বিশেষ করে সিয়াটেল-এর নিজস্ব ফুটবল টিমের প্রশংসায় দু’জনেই একমত।

এমির মা-কেও সমীরণের খুব ভালো লাগল। অত্যন্ত রুচিশীল এবং শালীনতা বোধ সম্পন্ন। এমিও একদম ওর মায়ের মতনই হয়েছে বলেই মনে হল সমীরণের। এমির ঠাকুমা নিজের দেশের লোক পেয়ে একেবারে গদগদ হয়ে পড়লেন। লখনউ শহরে ছোটোবেলার কাটানো নানা গল্পের ঝোলা খুলে বসলেন সমীরণকে পেয়ে।

সমীরণ লক্ষ্য করল সকলে ওর সঙ্গে উর্দু মিশ্রিত হিন্দি ভাষায় কথা বললেও নিজেদের মধ্যে শুধুমাত্র উর্দুতেই কথা বলছেন অবশ্য সমীরণের বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না। হস্টেলে থাকতে সমীরণের দু’তিনজন উর্দুভাষী বন্ধু ছিল, ফলে আজ এমির বাড়িতে ওর খুব একটা অসুবিধা হল না। আর একটা জিনিস খেয়াল করল সমীরণ, এমির সঙ্গে সকলে উর্দুতে কথা বললেও এমি উত্তরগুলো সবই ইংরাজিতে দিচ্ছে এবং মাঝেমধ্যে হিন্দিও ব্যবহার করছে ও।

সবমিলিয়ে এমির বাড়ির পরিবেশে এমন একটা আপনত্ব ছিল যেটা প্রবাসের মাটিতে সমীরণের একাকিত্ব সম্পূর্ণ মুছে দিল। সারাটা দিন হাসি-গল্পে কাটিয়ে সন্ধের মুখে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সমীরণ বাড়ি ফেরার জন্য উঠে পড়ল। এমির পরিবারও সমীরণের কাছ থেকে আবার আসার প্রতিশ্রুতি নিয়ে তবে সমীরণকে ছাড়ল।

সমীরণ চলে যাওয়ার পর এমি নিজের পরিবারের মুখোমুখি হল, সমীরণ সম্পর্কে সকলের মতামত চাইল। সকলেরই সমীরণকে ভালো লেগেছিল। সকলে একমত হলে এমি এই প্রথম সকলকে জানাল যে ও সমীরণকে বিয়ে করতে চায়।

‘কিন্তু ছেলেটি হিন্দু এবং ভারতীয়। সুতরাং ওর সঙ্গে তোমার বিয়ে কখনওই সম্ভব নয়’, এমির বাবা প্রথম প্রতিবাদ জানালেন।

এমির মা-ও এতক্ষণ চুপ করে মেয়ের কথা শুনছিলেন। এবার তিনিও মুখ খুললেন, ‘এমি, ছেলেটির সঙ্গে তোমার পরিচয় মাত্র কয়েক মাসের। এমনও তো হতে পারে, গ্রিন কার্ড পাওয়ার লোভে ও তোমাকে বিয়ে করতে চায়। আমেরিকান সিটিজেন না হলে তোমার হুটহাট কাউকে বিয়ে করা উচিত নয়।’

সবার কথা শোনার পর এমি ধীরে ধীরে সমীরণ সম্পর্কে সব কথা খুলে বলল বাড়ির সকলকে। সমীরণ হিন্দু, ভারতীয় এবং ওর পুরো পরিবার ভারতে থাকে। চাকরিসূত্রে ও আমেরিকায় এসেছে এবং যে-কোনও দিন ও ভারতবর্ষে ফেরত যেতে পারে।

এমির কথা শুনে ওর মা-বাবা আর ঠাকুমা সকলেই এক বাক্যে আপত্তি জানাল যে, হিন্দু ছেলের সঙ্গে এমির বিয়ে কিছুতেই হতে পারে না।

‘কিন্তু এতক্ষণ তো তোমাদের সকলেরই খুব পছন্দ ছিল সমীরণকে। এখন ও হিন্দু আর ভারতীয় হওয়াতে হঠাৎ কী করে খারাপ হয়ে গেল সেটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না’, এমি না বলে পারে না। ‘ড্যাডি, তুমি আর মম-ও তো আলাদা আলাদা ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে করেছিলে। তাহলে তোমরা কী করে এই কথা বলতে পারছ?’

‘এমি, আমি তোমার মম-কে বিয়ে করে নিজের বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। এই পরিবারের সংস্কৃতিকে ও আপন করে নিয়েছিল। এছাড়াও ইসলাম ধর্মে ও ধর্মান্তরিত হয়েছিল। কিন্তু তুমি বিয়ে করে অন্য বাড়িতে যাবে সুতরাং তফাত তো আছেই। ছেলেটি যদি তোমাকে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে তাহলে তো তোমার আখরত (মৃত্যুর পর জীবন)-ও বরবাদ হয়ে যাবে।’

এমি বুঝতে পারে, এই মুহূর্তে তর্ক চালিয়ে কোনও লাভ নেই বরঞ্চ সমীরণের সঙ্গে বসে একটা সিদ্ধান্তে আসা দরকার।

পরের দিন অফিস ছুটির পর এমি সমীরণের সঙ্গে বেরিয়ে একটা রেস্তোরাঁয় এসে মুখোমুখি বসল। ‘সমীরণ আমার বাড়িতে কারও মত নেই যে আমি তোমাকে বিয়ে করি। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে তুমি হিন্দু এবং ভারতীয়। আমার জীবনের এত বড়ো একটা টার্নিং পয়েন্টে আমি চেয়েছিলাম বাড়ির সকলে আমার পাশে থাকুক। ধর্ম বা দেশ নিয়ে আমাদের যেখানে কোনও প্রবলেম নেই সেখানে ওদের অসুবিধাটা কোথায়? আমরা যখন খুশি বিয়ে করতে পারি, কেউ আমাদের আটকাতে পারবে না। কিন্তু সমীরণ আমি চাই আমাদের দুজনের ফ্যামিলি খুশিমনে আমাদের বিয়েতে মত দিক।’

এমির কথা শুনে সমীরণ এমিকে আশ্বাস দেয়, ‘চিন্তা কোরো না, শুধু বলো তুমি আমার পাশে আছো তো?’

‘অবশ্যই, সমীরণ।’

‘ঠিক আছে। তাহলে একটা কাজ করো, তোমার বাড়ির সকলের সঙ্গে আমার আর একটা দিন দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও।’

রবিবার সমীরণ এমিদের বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিল। ঠাকুমা হিন্দি সিনেমার ভক্ত সুতরাং নতুন কয়েকটা ছবির ডিভিডি আর এমির মায়ের জন্য কাবাব কিনে সমীরণ ওদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছোল। ডিভিডি এবং কাবাব পেয়ে ওনারা খুশি হলেন, সমীরণকে ধন্যবাদ জানালেন। এমির বাবার ঠান্ডা ব্যবহারে সমীরণ বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। প্রফেসর সাহেবের সঙ্গে বসে ওনার পছন্দের ফুটবল খেলা নিয়ে নানা আলোচনা করতে করতে মানুষটিকে অনেক সহজ করে তুলল সমীরণ।

পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হলে সমীরণ সোজাসুজি যে-জন্য এখানে আসা সেই বিষয়টি উত্থাপন করল, ‘আন্টি, আংকল, দাদি, আপনারা তিনজনেই জানেন আমি আর এমি পরস্পরকে ভালোবাসি, বিয়ে করে সারাজীবন একসঙ্গে থাকতে চাই। কিন্তু বিয়ের জন্য আপনাদের সম্মতি পাওয়া আমাদের জন্য খুব জরুরি। সিটিজেনশিপ পাওয়ার জন্য আমি এই বিয়ে করছি না। আপনাদের জেনে রাখা ভালো, যে-কোম্পানিতে আমি আছি ওরাই আমার গ্রিন কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করে দিয়েছে। হ্যাঁ আমি হিন্দু এবং আমি ভারতীয় যেটা আমি বদলাতে পারব না বা বলতে পারেন বদলাতে চাই-ও না। ইন্ডিয়া আমার দেশ সুতরাং মাঝেমধ্যেই আমি ওখানে যাব।

আর মা-বাবার প্রয়োজনে আমি নিশ্চয়ই তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াব… একই ভাবে আপনাদের প্রয়োজনেও আমি আপনাদের পাশে থাকব। আর ধর্ম নিয়ে আপনাদের আপত্তি কিন্তু ধরুন আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলাম কিন্তু মনে মনে হিন্দুই রয়ে গেলাম, এই ক্ষেত্রে আপনারা কি কিছু করতে পারবেন? ধর্মের নামে আমরা মনে মনে যার পুজো করি বা মানি তাকে কি আমরা কেউ চোখে দেখেছি? শুধু কোন নামে তাকে ডাকা হবে সেই নিয়ে লড়াই। দুটো মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে অথচ তারা ঈশ্বরকে আলাদা আলাদা নামে ডাকে বলে তারা বিয়ে করতেপারবে না, এ কেমন ধর্মের বিচার?’ সমীরণ চুপ করে।

সমীরণের বলা শেষ হলেও সকলে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে কারণ সকলেই মনে মনে জানে সমীরণ যা বলেছে তা পুরোপুরি সত্যি।

কিন্তু প্রফেসরের মনে ভয় ছিল ওখানকার মুসলিম সমাজ এবং তাঁর নিজের বড়ো দাদা এই বিধর্মী বিয়েতে মত দেবে কিনা। আমেরিকাতে এসেও একটা আলাদা পাকিস্তানি মুসলিম সমাজ কেমন করে যেন নিজে থেকেই গড়ে উঠেছিল। সব ধর্মের লোক পাশাপাশি থাকলেও বিয়ে এবং অন্যান্য রীতি রেওয়াজ নিজের নিজের ধর্মের মধ্যেই করাটা সকলে পছন্দ করত।

হ্যাঁ, স্কুল, কলেজ, অফিসের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে বিয়ে হয় না এমন নয়, সে আলাদা আলাদা জায়গারই হোক না কেন, তবুও মন্দির বা মসজিদে যারা নিত্য সঙ্গী তারা এই ব্যাপারটা পছন্দ করে না এটা ঠিক। প্রফেসরের ভয় এদেরকে নিয়েও ছিল না। তাঁর প্রধান ভয়ের কারণ ছিল নিজের বড়ো দাদা…

এমির পরিবার ধীরে ধীরে সমীরণকে আপন করে নিল। প্রায়শই আসা-যাওয়া করতে করতে নিজের স্বভাবের গুণে সকলের মন জয় করে নিল সমীরণ। ছুটির দিনে এমির বাড়িতে এসে ঠাকুমাকে হিন্দি ফিলম দ্যাখানো থেকে শুরু করে প্রফেসর সাহেবকে নানা কাজে সাহায্য করা এমনকী এমির মা-কেও কিচেনে হেল্প করত সমীরণ।

এমির বাবা মাঝে মাঝে হেসে বলতেন, ‘এতদিন বাড়িতে তিনজন মহিলার তত্ত্বাবধানে আমাকে থাকতে হতো… সমীরণ তুমি আসাতে আমি নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচছি।’

বাড়ির বড়োরা আশেপাশে না থাকলে সমীরণ এমির কাছে দুঃখ করত, ‘এমি তোমাকে ভালোবেসে আমি বাড়ির জামাই তো এখনও হতে পারলাম না, কিন্তু রামু হয়ে উঠছি। তুমি যদি আমাকে ডিচ্ করে পাকিস্তানি কাউকে বিয়ে করে নাও তাহলে?’

এমিও সঙ্গে সঙ্গে হেসে উত্তর দিত, ‘ইউ নেভার নো।’

প্রফেসর, মনের আয়নায় সমীরণ আর এমিকে একসঙ্গে কল্পনা করতেন। সমীরণকে দেখে এমির চোখে মুখে খুশি উপচে পড়তে দেখতেন। নিজের মনকে বোঝাতেন, আল্লাহ্-কে কেউ যদি ঈশ্বর বলে তাতে দোষের কি আছে? পুজো করাটা তার নিজের ইচ্ছে… এমিকে তো সমীরণ জোর করছে না পুজো করতে…

সাহস করে একদিন নিউইয়র্কে নিজের দাদাকে ফোন করলেন প্রফেসর, ‘ভাইজান, এমি বিয়ে করবে বলে নিজেই একটি ছেলেকে পছন্দ করেছে। ওরা খুব তাড়াতাড়ি বিয়েটা করতে চাইছে। তবে ছেলেটি হিন্দু।’

‘হিন্দু ছেলে কেন? পাকিস্তানি ছেলের কি আকাল পড়েছে?’

‘এমির সমীরণকেই পছন্দ।’

‘হ্যাঁ হবেই তো, আমেরিকান মায়ের মেয়ে তো।’

‘ভাইজান, ছেলেটি খুবই ভালো।’

‘কী বলছিস তুই? কাফের-কে জামাই করবি?’ ভাইজান চিৎকার করে ওঠেন।

প্রফেসর ভাইজানকে শান্ত করার বৃথা প্রচেষ্টা চালিয়ে যান,’ ভাইজান আপনি তো জানেন এখানে বাচ্চারাই কোনও কথা শুনতে চায় না, বেশি জোরজবরদস্তি করলে কল করে পুলিশ ডেকে নেয়। আর বড়ো হয়ে তো ওরা আরও স্বাধীনচেতা হয়ে ওঠে। এমি আমাদের সম্মতি চাইছে এটাই তো বড়ো কথা। আমরা হ্যাঁ করলেই ওদের লাইফটা সেটল হয়ে যায়।’

ভাইজান কী ভেবে সম্মতি জানান, ‘ঠিক আছে। ছেলেটি যদি ইসলামে ধর্মান্তরিত হয় তবে এই বিয়ে হওয়া সম্ভব।’

‘না ভাইজান, ছেলেটি এতে রাজি নয়। ও তো এমিকেও ধর্ম পরিবর্তন করতে বলেনি।’

ফোনের ভিতরেই বাজ পড়ল মনে হল। ভদ্রতার মুখোশ খসে পড়ল ভাইজানের। চিৎকার করে উঠলেন ফোনের ওপার থেকে, ‘কাফেরের সঙ্গে নিকাহ্ কিছুতেই হতে পারে না। তুমি যদি এই বিয়ে দাও তাহলে আমার সঙ্গে তোমার আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না… আমাকেও সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে হবে। যদি সবাই জেনে যায় আমার ভাইয়ের মেয়ে হিন্দু বিয়ে করেছে, তাহলে সমাজে আমার সম্মান থাকবে না।’

ভাইজানের সম্মতি না পাওয়াতে প্রফেসর মনে মনে আরও দমে গেলেন। চিন্তায় চিন্তায় রাতের ঘুম চলে গেল। অসুস্থ হয়ে পড়াতে এমি জোর করে হাসপাতালে ভর্তি করে দিল। সমীরণ আর এমি পালা করে প্রফেসরের দেখাশোনা করতে লাগল এমনকী মা আর দাদিকেও বেশি হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে দিত না ওরা।

কিছুদিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রফেসর বাড়ি চলে এলেন। কিন্তু তখনও শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে না ওঠাতে যত্নের যেমন প্রয়োজন ছিল, তেমনি খাবারদাবারেও প্রচুর রেস্ট্রিকশন ডাক্তার বেঁধে দিয়েছিল। সমীরণ ছেলের সমস্ত দায়িত্ব পালন করল এমনকী অফিসে এমির কাজেও সাহায্য করে দিত, যাতে মেয়ে বাবাকে বেশি সময় দিতে পারে।

প্রফেসরের বন্ধুবান্ধব দু’একবার এসে ওনার খোঁজখবর নিয়ে গেল। ভাইজানও ফোনেই ভাইয়ের খবরাখবর করলেন।

অসুস্থ অবস্থায় কেউ দেখতে এলে ভালোই লাগে তবে আমেরিকায় এসবের জন্য কারও কাছেই সময় থাকে না। সমীরণ প্রতিদিন প্রফেসরকে দেখতে আসত অফিস ফেরত। প্রফেসরের ভালো লাগত। ওনার মনে হতো নিজের ছেলে থাকলেও সেও বোধহয় সমীরণের মতো এতটা যত্ন করত না। সবার যত্নে প্রফেসর তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলেন। সুস্থ হয়েই সমীরণকে ডেকে ডিজ্ঞেস করলেন, ‘বাড়ির সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলেছ? ওনাদের কী মত?’

সমীরণ জানাল, ‘মা-বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি ওনাদের রাজি করিয়ে নিয়েছি… প্রথমটা একটু অমত করেছিলেন কিন্তু এমির সঙ্গে কথা বলাতেই ওদের এমিকে খুব ভালো লেগে যায়। আমার মা-বাবা ধর্ম, জাতি এইসব নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামান না। শুধু পাকিস্তানি বলে একটু দ্বিধায় ছিলেন। ওনাদের কাছে আমার পছন্দই শেষ কথা।’

সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠে প্রফেসর একটা পার্টির আয়োজন করলেন। যেখানে সমস্ত বন্ধু, প্রতিবেশীদের সামনে এমি এবং সমীরণের বিয়ের ঘোষণাও করে দিলেন। প্রফেসর খুব ভালো করেই জানতেন এই বিয়েতে খুব বেশি অতিথি আসবে না। দুই পরিবারের উপস্থিতিতে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট-এ কোর্টে রেজিস্ট্রি করে সমীরণ আর এমির বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর হোটেলে রিসেপশন রাখা হল যেখানে পরিচিতরা এবং অফিসের কলিগরা এসে পার্টি জমজমাট করে তুললেন।

ভাইজান এবং তাঁর বিচারধারায় বিশ্বাসী কিছু মানুষ নিজেদের দূরত্ব বজায় রেখে অনুষ্ঠানে যোগদান করলেন না। কিন্তু তাতে কিছুই আটকাল না। শুধু দুজন মানুষ প্রেমের উড়ানে স্বপ্নের জগৎ গড়ে তুলতে আরও কয়েক ধাপ অগ্রসর হল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...